বাজারে স্বস্তি ফিরছে না

0
75
পণ্যের দাম

চালের বাজারে সরকারি অভিযান, কিছু পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়া, সবজির মৌসুমি সরবরাহ—প্রত্যাশা করা হয়েছিল, এসব কারণে বাজারে স্বস্তি আসবে। কিন্তু বাজারে গিয়ে ভোক্তার স্বস্তি মিলছে না। বছরের শুরুতে চালের দাম বেড়ে যাওয়াকে অস্বাভাবিক হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলেও ঢাকার বাজারে চালের দামে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। উল্টো গত এক সপ্তাহে বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর চারটি বাজার ঘুরে দেখেছেন এই প্রতিবেদক। বাজার চারটি হলো মিরপুরের কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও তালতলা ও মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট। এসব বাজারে দেখা গেছে, শীতের সবজির ভরা মৌসুমে ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউসহ বেশ কয়েকটি সবজির দাম গত এক সপ্তাহের তুলনায় বেড়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে ফার্মের মুরগির ডিমের দামও। সাধারণত বছরের এ সময় সবজির দাম কম থাকে। কিন্তু এবার সবজির দাম এখনো বাড়তি।

বাজারে এখন কোনো অভিভাবক নেই। যে যেভাবে পারছে, দাম বাড়াচ্ছে। আর এতে কষ্ট পাচ্ছে কেবল আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষেরা।বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী সাজিদুল আলম

দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার দীর্ঘদিন ধরে ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ গত ডিসেম্বর মাসের হিসাবে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ। এই মাসে গ্রাম-শহরনির্বিশেষে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ, অর্থাৎ এক বছর আগের চেয়ে অতিরিক্ত দামে মানুষকে খাদ্য কিনতে হচ্ছে। অন্যদিকে, মূল্যস্ফীতির তুলনায় সাধারণ মানুষের আয় তেমন বাড়েনি। উচ্চ মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তুলছে। তবে কোনো ব্যবস্থাই বেশির ভাগ পণ্যের মূল্য কমাতে পারছে না।

চালের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার পর খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার দাম কমাতে ব্যবসায়ীদের চার দিন সময় বেঁধে দেন। ১৭ জানুয়ারি চালের দাম আগের পর্যায়ে নিয়ে আসার এই নির্দেশে সায় দিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরাও। এরপর চালের বিভিন্ন মোকামে ও বাজারে সরকারি অভিযান চলে, জরিমানা করা হয় অনেক ব্যবসায়ীকে। ফলে জেলাপর্যায়ে চালের দাম কিছুটা কমলেও ঢাকার বাজারে এর প্রভাব খুব একটা দেখা যাচ্ছে না।

দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার পর গত সেপ্টেম্বরে আলু, দেশি পেঁয়াজ ও ডিম—তিন পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু বেঁধে দেওয়া দর কখনোই কার্যকর করা যায়নি। এর বাইরে দাম নির্ধারণ করে দেওয়া আছে চিনি, ভোজ্যতেল ও রান্নার গ্যাসের (এলপিজি)। কিন্তু এসব পণ্যের বেশির ভাগই বিক্রি হয় বাড়তি দামে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার জন্য যাঁদের নিয়মিত বাজারে যেতে হয়, তাঁদের অনেকে বেশ কষ্টেই আছেন। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী সাজিদুল আলম গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, ‘বাজারে এখন কোনো অভিভাবক নেই। যে যেভাবে পারছে, দাম বাড়াচ্ছে। আর এতে কষ্ট পাচ্ছে কেবল আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষেরা।’

দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার পর গত সেপ্টেম্বরে আলু, দেশি পেঁয়াজ ও ডিম—তিন পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু বেঁধে দেওয়া দর কখনোই কার্যকর করা যায়নি।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর চারটি বাজার ঘুরে এবং সেখানকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে যে বাজারে নির্দিষ্ট ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য স্বস্তির কোনো খবর নেই। এসব বাজারের বিক্রেতারা জানান, বছরের শুরুতে বাজারে চালের দাম যতটা বেড়েছে, তা এখনো খুব একটা কমেনি। খুচরা পর্যায়ে চালভেদে কেজিতে কেউ কেউ এক-দুই টাকা কম রাখছেন, তবে বেশির ভাগ বিক্রেতা আগের বাড়তি দামেই চাল বিক্রি করছেন।

বিভিন্ন খুচরা বাজারে গতকাল মোটা চাল (স্বর্ণা ও চায়না ইরি) বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৫৩-৫৫ টাকায়। এ ছাড়া মাঝারি মানের চাল (পাইজাম ও বিআর ২৮) প্রতি ৫৬-৬০ টাকা এবং সরু চাল (মিনিকেট ও নাজিরশাইল) ৬৮ থেকে ৭৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের চালের দোকান আল্লাহর দান রাইসের স্বত্বাধিকারী এম এ আউয়াল বলেন, ‘বাজারে চালের দাম বেড়ে স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। দাম কমার কোনো আভাস এখনো পাইনি।’

চালের বাজারের যখন এই অবস্থা, তখন এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে মুরগির ডিম ও দেশি পেঁয়াজের দাম। বাজারে এখন দেশি পেঁয়াজই বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ৮০ থেকে ৯০ টাকা হয়েছে। আর ডিম বিক্রি হচ্ছে প্রতি ডজন ১৩৫ টাকায়। সপ্তাহখানেক আগে ডিমের দাম ছিল ১৩০ টাকা।

সাধারণত জানুয়ারি মাসে দেশে শীতের সব সবজির দাম একবারে নিচে নেমে আসে। কিন্তু এই ভরা মৌসুমেও ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রকলি, লাউ, টমেটো, পেঁপেসহ বেশ কিছু সবজির দাম উল্টো বেড়েছে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এসব সবজির দাম ১০ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তবে স্থিতিশীল রয়েছে মুলা, গাজর, শসা, শিম ইত্যাদি সবজির দাম। সবজির মধ্যে নতুন আলু ও গোল বেগুনের দাম কেজিতে ১০ টাকার মতো কমেছে। রাজধানীর বাজারগুলোতে আলু ৪০ থেকে ৪৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

বাজারে চালের দাম বেড়ে স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। দাম কমার কোনো আভাস এখনো পাইনি।কারওয়ান বাজারের চালের দোকান আল্লাহর দান রাইসের স্বত্বাধিকারী এম এ আউয়াল

মাছের দাম চড়া, কমেছে মুরগির

বাজারে সবজির পাশাপাশি মাছের দামও চড়া। তবে কিছুটা কমেছে মুরগির দাম। গতকাল বাজারে মাঝারি আকারের চাষের রুই প্রতি কেজি ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকা এবং আকারভেদে তেলাপিয়া ও পাঙাশ ২২০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) গতকালের হিসাবে, রুই মাছের দাম এক সপ্তাহে ২০ টাকার মতো বেড়েছে। তবে বিক্রেতারা জানিয়েছেন, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দাম ১০-১৫ টাকা কমেছে। বর্তমানে ব্রয়লার মুরগি ১৮০-১৯০ টাকা ও সোনালি মুরগি ৩০০ থেকে ৩১০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

এক মাস আগে মাংস বিক্রেতা ও খামারিরা মিলে গরুর মাংসের দাম নির্ধারণ করেন প্রতি কেজি ৬৫০ টাকা। বছরের শুরুতেও বাজারে এই দাম ছিল। অধিকাংশ বাজারে এখন প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকায়। আগারগাঁও তালতলা বাজারে গরুর মাংস ৭৫০ টাকায়ও বিক্রি হতে দেখা গেছে। এ ছাড়া বকরি ১ হাজার টাকা এবং খাসির মাংস ১ হাজার ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।

বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম গত রাতে বলেন, ‘নিত্যপণ্যের বাজারে যাতে কোনো ধরনের সরবরাহ ঘাটতি দেখা না দেয়, সেটি নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করছি। বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলে দামও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে গত বুধবার আমার কথা হয়েছে। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেছেন, ভারত থেকে চিনি ও পেঁয়াজ রপ্তানির বিষয়ে তিনি শিগগিরই ব্যবস্থা নেবেন। ভারত থেকে চিনি ও পেঁয়াজ আসা শুরু করলে এ দুটি পণ্যের দাম কমবে বলে আশা করছি।’

বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, এ ছাড়া বেশ কিছু নিত্যপণ্যের আমদানি শুল্ক কমানোরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নিলে তার সুফলও মিলবে বাজারে।

তবে বিক্রেতারা জানিয়েছেন, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দাম ১০-১৫ টাকা কমেছে। বর্তমানে ব্রয়লার মুরগি ১৮০-১৯০ টাকা ও সোনালি মুরগি ৩০০ থেকে ৩১০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব এনবিআরে

পবিত্র রমজান মাসে ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুরের ওপর আরোপিত শুল্ক-কর কমানোর অনুরোধ জানিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি পাঠিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ প্রসঙ্গে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম জানান, তাঁরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব নিয়ে কাজ করছেন।

ঢাকার বাজারে গতকাল পর্যন্ত বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১৭০-১৭৩ টাকা এবং খোলা চিনি প্রতি কেজি ১৪০-১৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অন্যদিকে রমজানের পণ্য হিসেবে পরিচিত ছোলার কেজি ৯০-১১০ টাকা ও ছোলার ডাল ১০০-১১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া ছোট দানার মসুর ১৪০ টাকা, মোটা দানা মসুর ডাল ১১০ টাকা ও মুগ ডাল ১৭০–১৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গত এক মাসের মধ্যে এসব পণ্যের দাম ১০-২০ টাকা বেড়েছে। অন্যান্য পণ্যের মধ্যে খোলা আটা ৫০-৫৫, প্যাকেট আটা ৬৫-৬৮, খোলা ময়দা ৬৫-৭০ এবং প্যাকেট ময়দা ৭০-৮০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।

বাজারের বর্তমান অবস্থায় উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে উচ্চ ‘লোভস্ফীতি’ চলছে বলে মন্তব্য করেছেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি বলেন, ‘সরবরাহ না থাকলে দাম বাড়ে। কিন্তু বর্তমানে উৎপাদন বৃদ্ধি ও সরবরাহ ঠিক থাকলেও অনেক পণ্যের দাম বাড়ছে। সুতরাং পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির এই অস্বাভাবিক কারণ আগে থামাতে হবে। তা না হলে পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়া, বাজারে অভিযান চালানো কিংবা ট্রাকে পণ্য বিক্রি করে পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হবে না।’

গোলাম রহমান আরও বলেন, সাধারণ মানুষ এখন চরম আর্থিক কষ্টে বেঁচে থাকার লড়াই করছে। জিনিসপত্রের দাম যে পর্যায়ে বেড়েছে, তা হয়তো আর আগের পর্যায়ে ফিরে যাবে না। এ জন্য মানুষের আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির দিকেও সরকারকে মনোযোগী হতে হবে।

নিত্যপণ্যের বাজারে যাতে কোনো ধরনের সরবরাহ ঘাটতি দেখা না দেয়, সেটি নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করছি। বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলে দামও নিয়ন্ত্রণে থাকবে।বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.