বাজারে এল আইফোন ১৫, কিন্তু চীনা কর্মকর্তাদের জন্য নিষিদ্ধ হলো কেন

আল-জাজিরার বিশ্লেষণ

0
120
নতুন আইফোন দেখছেন দর্শনার্থীরা, এএফপি

চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আইফোন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।

গত বৃহস্পতিবার ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তাদের অ্যাপলের ডিভাইসগুলো ব্যবহার না করতে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। পরদিন শুক্রবার ব্লুমবার্গ তাদের প্রতিবেদনে দাবি করে, এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে সরকার-সমর্থিত সংস্থাসহ রাষ্ট্রায়ত্ত সব সংস্থা। ফলে সরকারের নিয়ন্ত্রিত সব সংস্থাই এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসছে। ফলে এই নিষেধাজ্ঞার পরিধি বেশ বিস্তৃত।

চীনের এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের চলমান বাণিজ্য ও প্রযুক্তিগত যুদ্ধের সর্বশেষ ‘তোপধ্বনি’ বলেই মনে করা হচ্ছে। যদিও নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে এ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি।

এরই মধ্যে ১২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় নতুন পণ্য আইফোন ১৫সহ অন্যান্য পণ্যের উন্মোচন অনুষ্ঠান আয়োজন করে মার্কিন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান অ্যাপল।

আইফোন কেন নিষিদ্ধ করা হলো, আর কেনই-বা তা এখন

যদিও অ্যাপলের জন্য এটা খারাপ খবর ও পশ্চিমা প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এটি সম্ভাব্য অশুভ লক্ষণ, তবে এই নিষেধাজ্ঞা চীনের কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখা পর্যবেক্ষকদের মোটেও বিস্মিত করেনি।

যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয় দেশই একে অপরের ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা কমাতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। কেননা উভয় পক্ষই বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কথিত জাতীয় নিরাপত্তার নিয়ে উদ্বেগকে দিন দিন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

বেইজিং বিদেশি প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি সেনজেন-ভিত্তিক হুয়াওয়েসহ দেশীয় সংস্থাগুলোকে এগিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টায় জোর দিয়েছে। হুয়াওয়ের নতুন ১ হাজার ২০০ ডলারের ‘মেট ৬০ প্রো’কে প্রযুক্তি-বিশ্লেষকেরা অনেকটাই এগিয়ে রেখেছেন। আইফোনের সঙ্গে নতুন এই গেজেটের দৌড়কে অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে না।
মেট ৬০ প্রো-এর বাজারে নিয়ে আসার সময় আইফোনকে নিষিদ্ধ করার সময় মিলে যাওয়াকে ‘কৌতূহলোদ্দীপক’ বলে মন্তব্য করেছে ব্যাংক অব আমেরিকা।

চীন ও যুক্তরাষ্ট্র একে অপরের দেশের প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর সুরক্ষাসংক্রান্ত সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়ে আসছে। তাদের আশঙ্কা, সংবেদনশীল ডেটা হাতিয়ে নেওয়াসহ সরকারি অবকাঠামোতে হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটতে পারে।

গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম অঙ্গরাজ্য হিসেবে মন্টানা চীনের মালিকানাধীন টিকটক নিষিদ্ধ করে। তথ্যের গোপনীয়তা নিয়ে উদ্বেগের ভিত্তিতে তারা এমন পদক্ষেপ নেয়। আরও কয়েকটি অঙ্গরাজ্য একই রকম পদক্ষেপ নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোসহ অনেক রাজ্য সরকারই এরই মধ্যে সরকারিভাবে ইস্যু করা ফোনে টিকটক অ্যাপটি নিষিদ্ধ করেছে।

হুয়াওয়েসহ চীনা অনেক প্রযুক্তি সংস্থার সঙ্গে মার্কিন সংস্থাগুলোর ব্যবসার করার পথ বন্ধ করে দিয়েছে ওয়াশিংটন। একই সঙ্গে মার্কিন চিপ নির্মাতা কোম্পানিগুলোকে চীনের কাছে উন্নতর প্রযুক্তি বিক্রিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে।

উন্নত কিরিন ৯০০০এস প্রসেসর দ্বারা চালিত মেট ৬০ প্রোর বাজারে আনার বিষয়টি এসব রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান গত সপ্তাহে বলেন, আইন লঙ্ঘন হয়েছে কি না, তা নির্ধারণে স্মার্টফোনটির ‘বৈশিষ্ট্য ও গঠন’ সম্পর্কে আরও তথ্য খতিয়ে দেখছে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন।

নতুন স্মার্টঘড়ি এনেছে অ্যাপল
নতুন স্মার্টঘড়ি এনেছে অ্যাপল, এএফপি

অ্যাপল ও অন্যান্য পশ্চিমা প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের জন্য আইফোন নিষিদ্ধ কী বার্তা দেয়

অ্যাপলের স্টক মূল্য গত বুধবার থেকে শুক্রবারের মধ্যে প্রায় ৬ শতাংশ কমে গেছে। ফলে বিশ্বের অন্যতম বড় এই কোম্পানি প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলার খুইয়েছে।

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনে বিদেশি সংস্থাগুলোকে কতটা স্বাগত জানানো হয়—এমন প্রশ্নের মধ্যে নিষেধাজ্ঞাটি সাধারণতভাবে চীনে পরিচালিত পশ্চিমা সংস্থাগুলোকেও একটি ‘শীতল বার্তা’ দিল।

এমনকি কিছু চীনা কর্মকর্তা জোর দিয়ে বলেছিলেন যে কোভিড-১৯-এর ধাক্কার পর ব্যবসার জন্য আবার চীন উন্মুক্ত হয়েছে। কিন্তু মিন্টজ গ্রুপসহ বিদেশি সংস্থাগুলোতে পুলিশের অভিযান ও সম্প্রতি প্রণীত গুপ্তচরবৃত্তিবিরোধী আইন ব্যবসা চালিয়ে নেওয়াসহ তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধার সৃষ্টি করেছে।

ক্রমবর্ধমান উত্তেজনাপূর্ণ নিরাপত্তাজনিত পরিস্থিতি বিদেশি সংস্থাগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়ার মহামারির কারণে মার খাওয়া, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ চুরি, দেশীয় প্রতিযোগীদের প্রতি সরকারের পক্ষপাতমূলক আচরণ ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়গুলো তো রয়েছেই।

যেখানে ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক প্রযুক্তি জায়ান্ট অ্যাপলের সঙ্গে এত দিন পর্যন্ত বেইজিংয়ের সম্পর্ক তুলনামূলক ভালোই ছিল, এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটির ওপর আরোপ করা সর্বশেষ বিধিনিষেধ চীনে ব্যবসা করা নিয়ে সংশয় আরও বাড়াতে পারে।

অ্যাপল বিশ্বব্যাপী যত পণ্য বিক্রি করে, তার প্রায় ২০ শতাংশই চীনে উৎপন্ন। বেইজিংয়ের নিয়ন্ত্রণের (যেমন ভার্চ্যুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক-ভিপিএন সরিয়ে ফেলা) দাবি মেনে নিয়ে তারা এত দিন খুশি মনে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল। গত মার্চ মাসে অ্যাপলের সিইও টিম কুক বেইজিংয়ে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

জনপ্রিয় নিউজলেটার সিনোসিজমের লেখক বিল বিশপ গত শুক্রবার বলেন, ‘অনেকেরই বিশ্বাস ছিল যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার উত্তেজনাকে অ্যাপল একধরনের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম।’

চীনের জন্য আইফোন নিষেধাজ্ঞার অর্থ কী

এই নিষেধাজ্ঞা চীনা নাগরিকদের সদ্য বাজারে আসা আইফোন ১৫সহ অ্যাপলের অন্যান্য পণ্য কেনার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। তবে এই পদক্ষেপ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বেইজিংয়ের যে আকাঙ্ক্ষা ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের যে লক্ষ্য—এ দুয়ের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান উত্তেজনাকে আরও উসকে দিয়েছে।

এর মধ্যেই অ্যাপলসহ প্রতিষ্ঠানগুলো চীন থেকে উত্পাদন অন্যত্র সরিয়ে নেওয়াসহ বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছে। তবে সর্বশেষ এই নিষেধাজ্ঞাসহ সাম্প্রতিক অন্যান্য ঘটনা এই প্রবণতাকে আরও ত্বরান্বিত করতে পারে।

মার্কিন বাণিজ্যসচিব জিনা রাইমন্ডো গত মাসে কোনো রাখঢাক ছাড়াই বলেন, ক্রমবর্ধমান প্রতিকূল ব্যবসায়িক পরিবেশের কারণে চীনকে ‘বিনিয়োগ অযোগ্য’ হিসেবে দেখতে শুরু করেছে বিদেশি প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলো।

সব মিলিয়ে এই ‘তিক্ত অবস্থা’ চীনের মহামারি-পরবর্তী পুনরুদ্ধারের চ্যালেঞ্জগুলোকে আরও কঠিন করে তুলছে, এমনিতেই যা মুদ্রাস্ফীতি, রপ্তানিতে ধীরগতি, রিয়েল এস্টেট খাতে সংকট ও তরুণদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্বের কারণে ধুঁকছিল।

আল জাজিরা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.