আয়তনে ভারতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম প্রদেশ সিকিম। সেখানে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা রোমাঞ্চকর। পূর্ব হিমালয়ের মাঝে অবস্থিত হিল স্টেশন থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। তিব্বতি মনাস্ট্রিতে বৌদ্ধ শিল্পকলা, সমগো বা চাঙ্কু লেকে নীলপানি, বরফে ঢাকা পাহাড় দেখতে পাবেন। পাবেন কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার পরশ।
ট্রাভেল কার্ড ও পরিচয়পত্র: সিকিমে প্রায় সব দর্শনীয় স্থানে পৌঁছতে গেলেই গাড়ির পারমিট করতে হয়। এ জন্য প্রত্যেকের কাছে অরিজিনাল পরিচয়পত্র (ভোটার কার্ড থাকলেই ভালো হয়), অন্তত ৪ কপি ফটো ও পরিচয়পত্রের ফটোকপি থাকতে হবে। এ ছাড়া সিকিম ট্যুরিজমের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রত্যেক ভ্রমণকারীর ফটো ও পরিচয়পত্র আপলোড এবং অন্যান্য তথ্য পূরণ করে ট্রাভেল কার্ড বানিয়ে নিতে হবে। এ কাজটা বেড়াতে যাওয়ার আগে নিজেই করে নেবেন।
যাই হোক সিকিম গেলে তিব্বতি মনাস্ট্রি, বসন্তের ইয়ুমথাং ফুলের উপত্যকা, সাজং, কুপাপ লেক, আরিতার, জুলুক ইত্যাদি স্থান ঘুরে আসতে পারেন।
সিকিমের সমগো বা চাঙ্কু লেক আমাদের মন কেড়েছে। চারপাশের বরফ, বরফে ঢাকা পাহাড়ের সৌন্দর্যে হারিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে বরফ বিছানো পথে ইয়াকের পিঠে চড়ে ঘোরা যায়। নাথুলা পাস, জিরো পয়েন্ট ও আরও কিছু স্থানে বিদেশিদের যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে। সেসব জায়গায় যাবেন না। স্থানীয় গাইডের পরামর্শ নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন।
গ্যাংটক থেকে সকাল ৭টায় রওনা দিতে হবে ইস্ট সিকিমের সমগো বা চাঙ্কু লেক, নিউ বাবা মন্দির ও নাথুলা পাসের উদ্দেশে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি নিউ বাবা মন্দিরের কাছ থেকে কুপুপ যাওয়া যায়। কিন্তু পারমিট না থাকলে কুপুপ লেক যাওয়া যায় না। তাই গুগল ম্যাপ দেখে ড্রাইভারকে অযথা অতিরিক্ত টাকা দিয়ে কুপুপ লেক যাওয়ার চেষ্টা না করা ভালো। বিকেলে গ্যাংটকে ফিরে রাত কাটাতে পারেন বা সেদিন রাতেই শিলিগুড়ি ফিরে আসতে পারেন। গ্যাংটক থেকে ছাঙ্গু, নিউ বাবা মন্দির ও নাথুলা পাস নর্থ সিকিম ঘোরার আগে অর্থাৎ দ্বিতীয় দিনেও যাওয়া যায় সবটাই পরিস্থিতি, আবহাওয়া এবং আপনার ট্যুর প্ল্যানের ওপর নির্ভরশীল।
লাচেন থেকে সকাল ৭টা নাগাদ রওনা দিতে হবে ইয়ুমথাং ভ্যালি ও জিরো পয়েন্টের উদ্দেশে। তারপর দুপুরে হোটেলে খাওয়া-দাওয়া সেরে রওনা দিতে হবে গ্যাংটকের উদ্দেশে। লাচেন থেকে গ্যাংটকে পৌঁছতে প্রায় ৫ ঘণ্টা মতো সময় লাগবে। লাচেন থেকে ফেরার পথে বচ্চন ফলস নামে একটি ঝরনা পাবেন। তবে নর্থ সিকিমে বরফ দেখার পর আর ঝরনার কাছে দাঁড়াতে ভালো নাও লাগতে পারে।
লাচেন পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। ওখানে রাত ৮টার মধ্যেই ডিনার সেরে ফেলতে হবে। আমরা তাই করেছি। লাচেন থেকে ভোরবেলা রওনা দিই কালাপাথর ও গুরুদংমার লেকের উদ্দেশে। এ ছাড়া ওখান থেকে চোপ্তা ভ্যালিতেও যাওয়া যায়। সমগ্র পথজুড়েই রয়েছে অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। তবে গুরুদংমার যাওয়ার রাস্তার অবস্থা যথেষ্ট খারাপ। গুরুদংমার থেকে দুপুরে লাচেনে ফিরে দুপুরের খাবার খেয়েই রওনা দিই ইয়ুমথাং ভ্যালির উদ্দেশে। সেখানে পৌঁছতেও সন্ধ্যা হয়ে যায় এবং রাত ৮টার মধ্যেই ডিনার সেরে নিই।
নর্থ সিকিম ভ্রমণ অভিজ্ঞতা: সকাল ১০টায় গ্যাংটক থেকে লাচেনের উদ্দেশে রওনা হলাম। লাচেন যাওয়ার পথে কয়েকটি ঝরনা যেমন– সেভেন সিস্টার ফলস, নাগা ফলস ইত্যাদি দেখা যায়। আমরা প্রাণভরে সেসব দর্শনীয় স্থানের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। যদি আরও অধিক সময় সেখানে থাকতে পারতাম, আরও ভালো লাগত। শীত ও গ্রীষ্মে ঝরনায় জলের প্রবাহ স্বাভাবিকভাবেই অনেকটা কম থাকে। অন্যান্য সময়ে ঝরনার জলের উদ্দামতা বেশি থাকে।
আমরা ভোরের মধ্যেই পৌঁছে যাই শিলিগুড়ি স্টেশনে। ওখানে নাশতা শেষ করে গাড়ি দিয়ে সরাসরি নর্থ সিকিমের উদ্দেশে রওনা দিই। চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে বিকেল ৫টায় পৌঁছে গেলাম সেই কাঙ্ক্ষিত বরফের স্বর্গ নর্থ সিকিমের গ্যাংটক শহরে। পাহাড় এবং সমুদ্রের মধ্যে পাহাড়ই আমার প্রিয়। কারণ পাহাড়ের শান্ত পরিবেশ মনকে স্থির ও চাপমুক্ত করে। আর সিকিম এমনই একটা জায়গা, যেখানে বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করা যায়। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারিতে চারপাশে প্রচুর বরফ আর মার্চের শেষ থেকে মে’র প্রথম পর্যন্ত রডোডেনড্রনের অপরূপ শোভা থাকে সেখানে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে পাহাড়ি ঝরনার প্রবল প্রবাহ ভ্রমণপিপাসুদের মন ভোলায়। মার্চের শেষ থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ সময়ই নর্থ সিকিম যাওয়ার জন্য উপযুক্ত সময়।
বন্ধুরা মিলে পরিকল্পনা করলাম বরফের স্বর্গরাজ্য নর্থ সিকিমে ঘুরতে যাব। ভিসার যাবতীয় কার্যক্রম শেষ করলাম। তারপরের দিন রওনা দিলাম কলকাতার উদ্দেশে। ঢাকা থেকে বাসে করে কলকাতা পৌঁছলাম বেলা ৩টায়। ওখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল জাবেদ। আমাদের খুব কাছের একজন ভাই এবং আমাদের নর্থ সিকিম ভ্রমণের সফরসঙ্গী। ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর শুনতে পারি ওইদিন নিউ জলপাইগুড়ির ট্রেন ছিল না। তাই এক রাত থেকে যেতে হলো কলকাতা নিউ টাউনে আকিব ভাইয়ের বন্ধুর বাসায়। পরের দিন রাতে ট্রেন ধরে নিউ জলপাইগুড়ির উদ্দেশে রওনা হই। খুব সকালে ট্রেনে যাওয়ার একটা আলাদা মজা আছে। মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা যায়। নানা রকম বাঁধও দেখা যায়।
যেভাবে যাবেন
বাস অথবা ট্রেনে প্রথমে আপনাকে বেনাপোল যেতে হবে। কিছু কিছু বাস যেমন গ্রিন লাইন, সৌহার্দ্য, শ্যামলী ইত্যাদি সরাসরি কলকাতা পর্যন্ত সার্ভিস দেয়। আপনি চাইলে এগুলোতেও যেতে পারেন। বেনাপোল নামার পর বর্ডার পার হতে হবে। বর্ডার পার হওয়ার পর কলকাতা চলে যাবেন। কলকাতা থেকে ট্রেনে ১ হাজার ১০০ টাকা ভাড়া দিয়ে শিলিগুড়ি পৌঁছে যাবেন এবং সেখান থেকে জিপ গাড়িতে করে সিকিম পৌঁছে যাবেন। খরচ পড়বে ৩ হাজার টাকার মতো।
কোথায় থাকবেন
সিকিমে অনেক হোটেল আছে। বাজেটের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন হোটেলে বিভিন্ন রুম পেয়ে যাবেন। আপনি যেমন রুম চান, তেমন খরচ করতে হবে। যদি ৬-৭ জনের গ্রুপ করে সিকিমে যান এবং রুম শেয়ার করেন তাহলে খরচ অনেক কম পড়বে। সাধারণত ৬ দিন ৭ রাতের জন্য জনপ্রতি খরচ হয় ১৭-২২ হাজার টাকার মতো।
সিকিম ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লিখেছেন: মো. মিরাজ মিয়া