বগুড়ার ক্ষুুদ্র শিল্পমেলার প্রধান আকর্ষণ জুয়া

0
90
সাজিয়ে রাখা হয়েছে বগুড়ার ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পমেলার লটারির পুরস্কার

মাইকে ঘোষণা আসছে- ‘ওঠাও বাচ্চা’। চোখ বেঁধে এক শিশু তুলছে লটারির টিকিট। ভাগ্যবান ব্যক্তি পেয়ে যাচ্ছেন মোটরসাইকেল, টিভি, ফ্রিজ, সোনার গহনা। ক্ষুুদ্র ও কুটির শিল্পমেলায় প্রকাশ্যে এই লটারি নামে জুয়া চলছে বগুড়ার শাজাহানপুরে। প্রশাসন বলছে, সেখানে লটারির আয়োজন না করতে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে। তবু সব মহলে ‘সালামি’ দিয়ে ১৮ দিন ধরে চলছে এই অপতৎপরতা। জেলা প্রশাসন, পুলিশ সুপার ও উপজেলা পর্যায় থেকে এই লটারি জুয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস আফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের (রাওয়া) সৌজন্যে বগুড়া মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন এই মেলা চালাচ্ছে। শহরের মাঝিড়া ক্যান্টনমেন্ট এলাকার পাশে বি-ব্লক মার্কেট মাঠে এই মেলার প্রধান আকর্ষণই হলো লটারি। বিশাল গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের কোনো দোকান চোখে পড়েনি। মেলার ফটকে লাগানো হয়েছে বেশ কিছু পোস্টার। তাতে মেলায় কেনাকাটা করা বা কী পাওয়া যাচ্ছে- সে সবের কোনো তথ্য নেই। বরং লটারির পুরস্কার হিসেবে প্রতিদিন দামি মোটরসাইকেল, টিভি, ফ্রিজ, ব্যাটারি রিকশা, সোনার গহনা দেওয়ার প্রলোভন দেখানো হচ্ছে। বাসায় বসে কেবল নেটওয়ার্কে দেখা যাচ্ছে লটারির লাইভ অনুষ্ঠান। এ কারণে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার নেশায় হাজার হাজার টাকায় লটারির টিকিট কিনে প্রতারিত হচ্ছে মানুষ। আর টিকিট বিক্রি হচ্ছে জেলার আনাচে-কানাচে। শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথাসহ পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এলাকায়ও টিকিট বিক্রি হচ্ছে দেদার।

টিকিট বিক্রেতা আবদুল হালিম জানান, টিকিটে তাঁরা নির্দিষ্ট কমিশন পেয়ে থাকেন। যারা সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিংবা ব্যাটারি রিকশা নিয়ে ঘোরাফেরা করেন, তাঁর ভাড়া পান ১ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে প্রতিদিন অন্তত ২০ হাজার টাকার টিকিট বিক্রি করেন তিনি। তাঁর গাড়ির মতো আরও ৪২০ গাড়ি প্রতিদিন এই মেলার টিকিট নিয়ে বগুড়ার ১২ উপজেলায় ঘুরে বেড়ায়। অনেকে আবার পাশের জেলা জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর ও সিরাজগঞ্জের সীমান্ত গ্রামেও টিকিট বিক্রি করছেন। বিক্রেতা হালিমের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন ৪২০ গাড়ি থেকে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকার টিকিট বিক্রি ধরলেও আয় হচ্ছে প্রতিদিন ৮৪ লাখ টাকা। সেই হিসাবে গত ১৮ দিনে এই অঙ্ক দাঁড়ায় ১৫ কোটি ১২ লাখ টাকা।
আরেক বিক্রেতা মামুন জানান, তাঁর গাড়ি থেকে যাঁরা টিকিট কিনছেন তাঁদের বেশির ভাগই রিকশা চালক ও দিনমজুর। মোটরসাইকেল পাওয়ার আশায় রিকশাচালক আবদুস সালাম প্রতিদিন পাঁচটি করে টিকিট কেনেন। পুরস্কার জোটেনি একদিনও। স্কুলছাত্রদের ভিড়ও লটারি ঘিরে। সপ্তম শ্রেণির ছাত্র রিফাত জানায়, তার ভাই মুশফিক টিফিনের টাকা দিয়ে প্রতিদিন তিন-চারটি টিকিট কিনলেও পুরস্কার পাননি।

সোমবার বিকেলে মেলায় গিয়ে দেখা যায়, মাঠে ঘোরাফেরা করছে হাতেগোনা কিছু লোক। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পমেলা বলা হলেও মাঠের পশ্চিম পাশে করা হয়েছে বিশাল মঞ্চ। সেখানে প্রতি রাত ১০টায় লটারি হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক দোকানি বলেন, ৫০ হাজার টাকায় দোকান নিয়েছি। বেচাবিক্রি নেই বললেই চলে। রাতে মেলায় ভিড় হয় ঠিকই, তবে সেটা লটারির মঞ্চ ঘিরে।

সোমবার দিনভর বগুড়ায় ঘুরে দেখা গেছে লটারির টিকিট বিক্রির জমজমাট প্রচারণা। মাইকে বলা হচ্ছে, ‘আপনি নিজের জন্য কেনা টিকিটে মোটরসাইকেল নিন, স্ত্রীর জন্য নিন সোনার গহনা আর বাচ্চার জন্য টেলিভিশন। শ্রমিক ভাইয়েরা মাত্র ২০ টাকাতেই পেতে পারেন একটি করে দেড় লাখের ব্যাটারি রিকশা। বলা তো যায় না, ভাগ্যে থাকলে ঠেকায় কে?’ প্রচারণা গাড়ি লক্ষ্য করে ছুটছেন বিভিন্ন পেশার মানুষ। গত ৪ ফেব্রয়ারি থেকে মেলা শুরু হওয়ার পর ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় লটারির আয়োজন।

সোমবার এই মেলায় পুরস্কার হিসেবে ১০টি মোটরসাইকেল, টেলিভিশন, ফ্রিজ, ব্যাটারিচালিত রিকশাসহ কয়েক লাখ টাকার সোনার গহনা দেওয়ার ঘোষণা হয়েছে। টিকিট বিক্রি বেশি হওয়ায় প্রতিদিন পুরস্কারের সংখ্যা ও দাম বাড়ানো হচ্ছে। শেষের দিন একটি নতুন প্রাইভেট কার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। প্রতিটি টিকিটের দাম ২০ টাকা।
এদিকে গণমাধ্যমে যাতে মেলার নামে জুয়ার বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ না হয়- সে জন্য প্রতিদিন ৫ লাখ টাকার ‘সালামি’ বিভিন্নজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয় বলে নিশ্চিত করেছেন মেলা সংশ্নিষ্ট এক কর্মকর্তা।

শহরের সাতমাথা এলাকার ব্যবসায়ী হাফিজুর রহমান বলেন, জেলা প্রশাসন বলছে, লটারির কোনো অনুমোদন নেই, এটি অবৈধ। তবু থেমে নেই লটারির কার্যক্রম। আমরা অনেকটাই অসহায়।

এই লটারির বিষয়ে গত ১২ ফেব্রুয়ারি জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায়ও আলোচনা হয়। তবু বন্ধ হয়নি এই লটারি। জেলা প্রশাসন থেকে চিঠি দিয়ে মেলায় লটারির নামে জুয়া বন্ধের নির্দেশ দিলেও তা আমলে নিচ্ছে না আয়োজকরা। বরং আয়োজকরা প্রথমে লটারির টিকিট বিক্রি শহরে করেছিল। এখন ছড়িয়ে দিয়েছে গ্রামের আনাচে-কানাচে।
লটারি জুয়া প্রসঙ্গে রাওয়ার এইচআর প্রধান মোস্তফা জামান ডালিম বলেন, আমাদের সংগঠনের সৌজন্যে বগুড়ায় একটি মেলা চলছে, এটি ঠিক। তবে সেখানে লটারি কিংবা এর অনুমতি বিষয়ে আমি কিছু জানি না।

মেলায় লটারি পরিচালনার দায়িত্বে থাকা বগুড়া জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ কবির আহম্মেদ মিঠু বলেন, যারা টিকিট কিনছেন তাঁরা মেলায় না এলেও পুরস্কার পাচ্ছেন, তাই টিকিট কিনছেন। তবে দুই-তিন দিনের মধ্যে আমরা লটারির কার্যক্রম বন্ধ করব।

শাজাহানপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইদা খানম বলেন, মেলার কর্তৃপক্ষকে লটারি বন্ধ করতে বলা হলেও তারা বন্ধ করছে না। বিষয়টি আমি বগুড়া জেলা প্রশাসককে জানিয়েছি। তিনি নির্দেশনা দিলে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেব।

জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা এই মেলা ও লটারির অনুমোদন দেইনি। ইতোমধ্যে আয়োজকদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। জানতে পেরেছি, চিঠি দেওয়ার পরও তারা লটারি বন্ধ করেনি। আমরা কেবল নেটওয়ার্কে লটারির ড্রর সরাসরি প্রচার বন্ধে চিঠি দিয়েছি। লটারির কার্যক্রম বন্ধ না হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) শরাফত ইসলাম বলেন, লটারি বিক্রি কিংবা মেলার ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। বিষয়টি জেলা স্পেশাল ব্রাঞ্চ বলতে পারবে। তবে জেলা স্পেশাল ব্রাঞ্চের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোতাহার হোসেনও একই ধরনের মন্তব্য করেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.