ফের রক্তাক্ত বান্দরবান, গোলাগুলিতে নিহত ৮

0
96
উত্তপ্ত পাহাড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা

ফের রক্তাক্ত বান্দরবান। রোয়াংছড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নের খামতাংপাড়া এলাকায় একসঙ্গে পড়ল ৮টি লাশ। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে তাদের বুক। অচেনা হয়ে গেছে তাদের অনেকের মুখ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি, পাহাড়ের দুই বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক) মধ্যে গোলাগুলিতে এবার রক্তাক্ত হয়েছে পাহাড়। তবে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের দায়িত্বশীলরা বলছেন, কেএনএফের অভ্যন্তরীণ কোন্দলেই লাশ পড়েছে।

নিহতদের মধ্যে সাতজনের পরিচয় মিলেছে। তাদের নিজেদের কর্মী বলে স্বীকার করেছে কেএনএফ। এদিকে একসঙ্গে ৮টি লাশ পড়ার ঘটনায় পাহাড়ে বিরাজ করছে আতঙ্ক। জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। জাতীয় নির্বাচনের আগে এমন সশস্ত্র মহড়া জাগাচ্ছে নতুন শঙ্কাও। তবে হামলার ঘটনায় এখনও কোনো মামলা হয়নি। গঠন করা হয়নি তদন্ত কমিটি।

বান্দরবান জেলা পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘পাহাড়ের দুই বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৭টার দিকে গুলির শব্দ পাওয়া যায়। এর পরদিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে লাশ পড়ে থাকতে দেখে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। শুক্রবার দুপুর ১টার দিকে ঘটনাস্থল থেকে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।’ কারা এ সংঘর্ষের ঘটনায় দায়ী– এমন প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি তিনি।

রোয়াংছড়ির ইউএনও খোরশেদ আলম চৌধুরী বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে কেএনএফের দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে আটজন নিহত হয়েছে। ঘটনার পর সেখানে লাশ উদ্ধারের জন্য সেনাবাহিনীর সদস্য ও পুলিশ পাঠানো হয়। রোয়াংছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি চহাইমং মার্মা বলেন, ‘কুকি-চিনের সঙ্গে গোলাগুলিতে আটজন মারা যাওয়ার খবর পেয়েছি। কুকি-চিনের সঙ্গে কাদের মারামারি হয়েছে, তা আমার জানা নেই।’

রোয়াংছড়ি থানার ওসি আবদুল মান্নান বলেন, লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তাদের প্রকৃত নাম-পরিচয় জানার জন্য কাজ করছে পুলিশ। তারা কীভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেল, সেটিও খুঁজে দেখা হবে।  আইনি প্রক্রিয়া শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

 

বারবার রক্ত ঝরছে বান্দরবানে: গত বছরের ৫ মার্চ এক ঘটনায় বান্দরবানের রুমাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয় চারজন। এর আগে সেনাবাহিনীর একটি টহল দলের সঙ্গে জেএসএস সদস্যদের সংঘর্ষের ঘটনায় এক সেনাসদস্যসহ চারজন নিহত হন। ২০২০ সালের জুলাই মাসে দুটি সশস্ত্র গ্রুপের সংঘর্ষে বান্দরবানের বাঘমারায় ছয়জন নিহত হয়। পুলিশের একটি সূত্র তখন জানিয়েছিল, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) দু’পক্ষের মধ্যে ওই গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।

এদিকে জাতীয় নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা তত বাড়ছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা না হলে ভোটের আগে বান্দরবানে আরও লাশ পড়বে বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

নিহতদের পরিচয়: ঘটনার পর কেএনএফ তাদের ভাটি কুকি নামে ফেসবুক পোস্টে দাবি করেছে, ‘এক সুন্দর শুক্রবারে ব্রাশফায়ারে সাত নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছে’। নিহত ৮ জনের মধ্যে সাতজন তাদের দলের সদস্য বলে দাবি সংগঠনটির। সংগঠনটির বিবৃতি অনুসারে নিহতরা হলেন– ভান দু বম, সাং খুম বম, সান ফির থাং বম, বয় রেম বম, জাহিম বম, লাল লিয়ান ঙাক বম ও লাল ঠা জার বম। নিহত আরেক জনের নাম পাওয়া যায়নি।

নিহত ৬ জন উপজেলার জুরভারাংপাড়া এবং একজন পানখিয়াংপাড়ার বাসিন্দা। তাদের অনেকের বুক গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। রক্তে লাল ছিল পুরো দেহ। লাশগুলো জেলা সদর হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছে। তাদের বিস্তারিত পরিচয় এখনও জানাতে পারেনি পুলিশ।

নিহতদের পোশাক দেখে ধারণা করা হচ্ছে, তারা সবাই কেএনএফের সশস্ত্র শাখা কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএফ) সদস্য। তাদের কাছে ভারী অস্ত্র থাকলেও সরেজমিন পুলিশ কোনো অস্ত্র পায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, বিরোধী সশস্ত্র গ্রুপের সদস্যরা তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করে অস্ত্র নিয়ে পালিয়েছে।

ঘটনাস্থল: গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে খামতাংপাড়া থেকে আধা কিলোমিটার দূরে একটি নির্জন জঙ্গলঘেরা জায়গায়। স্থানটি জেলা সদর থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে। রোয়াংছড়ি উপজেলার খামতাংপাড়ার একটি অংশ পড়েছে রোয়াংছড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নে। আরেকটি অংশ পড়েছে রুমা উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়নে।

যেভাবে সংঘর্ষের শুরু: স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৭টার দিকে খামতাংপাড়া থেকে এক কিলোমিটার দূরে নির্জন জায়গায় গোলাগুলি শুরু হয়। উভয়ের মধ্যে একটানা দুই ঘণ্টা গোলাগুলি চলে। পরে থেমে থেমে গোলাগুলি চলে সারারাত। পরদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান পাড়ার লোকজন।

গোলাগুলির আতঙ্কে খামতাংপাড়া ও এর আশপাশের লোকজন পালিয়ে জঙ্গল, রোয়াংছড়ি সদর ও রুমা উপজেলায় আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা গেছে। খামতাংপাড়ায় মোট ৯০টি পরিবারের বাস। বৃহস্পতিবার রাতে সেখানকার সবাই পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে রোয়াংছড়ি উপজেলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে আছে ১৭০ জন। রুমা উপজেলা সদরের বম কমিউনিটি সেন্টারে আশ্রয় নিয়েছে ৯০ জন। আশ্রয় গ্রহণকারী সবাই খিয়াং সম্প্রদায়ের বলে জানা গেছে। স্থানীয়দের ধারণা, আধিপত্য বিস্তার নিয়েই কেএনএফ ও ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে।

ভিন্ন দাবি করছে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক: ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের বান্দরবান জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক উবামং মার্মা দাবি করেন, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের কোনো সশস্ত্র গ্রুপ বান্দরবানে নেই। তাঁর জানামতে, জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) সংস্কারের কোনো সদস্যও নেই রোয়াংছড়িতে। তাহলে কেএনএফের সঙ্গে কাদের গোলাগুলি হয়েছে– জানতে চাওয়া হলে তিনি  বলেন, কেএনএফের মধ্যে এখন দুই ভাগ। তাদের নিজেদের মধ্যে গোলাগুলি হয়ে থাকতে পারে। অথবা অন্য কোনো দলের সঙ্গেও হতে পারে। তবে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের সঙ্গে কারও গোলাগুলি হয়নি।

হাসপাতালে আসেনি স্বজনরা: খামতাংপাড়া এখন জনমানবশূন্য। আতঙ্কে আছে পুরো পার্বত্য এলাকা। তাদের লাশ বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে জেলা সদর হাসপাতাল মর্গে নিয়ে আসে পুলিশ। কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। এ সময় সাংবাদিকসহ উৎসুক জনতাকে নিরাপদ দূরত্বে রাখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে মর্গে থাকা হাসপাতালের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেখানে ছিল না নিহতদের কোনো স্বজন। আহাজারির কোনো দৃশ্যও ছিল না লাশগুলো ঘিরে।

আতঙ্কে পাহাড়ের অধিবাসীরা: হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আতঙ্কে আছে পাহাড়ের অধিবাসীরা। এ ধরনের ঘটনার পর পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটে পাহাড়ে। অতীতের এমন অভিজ্ঞতা শঙ্কা বাড়াচ্ছে স্থানীয়দের মনে। জেলা সদর হাসপাতালের পাশে দোকান থাকা আজমত আলী বলেন, ‘রক্তের এই হোলিখেলা কবে বন্ধ হবে, জানি না। প্রতিশোধ নিতে হয়তো পাল্টা হামলা হবে কিছুদিনের মধ্যে। তখন হয়তো আবার নতুন লাশ দেখব আমরা। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা না হলে এমন ঘটনা কমবে না।’

চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন কমিটির জেলা সভাপতি জোয়াম লিয়ান আমলাই বলেন, ‘পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে অচিরেই শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন দরকার। যতদিন চুক্তি বাস্তবায়ন হবে না, ততদিন একের পর এক দল সৃষ্টি হবে। আর পাহাড়ে লাশের তালিকা দীর্ঘ হবে। একটি ঘটনার পর জন্ম হবে আরেকটি ঘটনার।’ এদিকে এ ঘটনায় গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি বলে জানান রোয়াংছড়ি থানার ওসি আবদুল মান্নান।

ইউপিডিএফের দাবি– ‘নাটক’:  ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের প্রচার সম্পাদক নিরন চাকমা স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে দাবি করা হয়, ‘দুই পক্ষের গোলাগুলির নাটক সাজিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটানো হয়। শুক্রবার সকাল ৬টার দিকে নব্য মুখোশ ও সংস্কারপন্থি জেএসএসের সদস্যরা জুরভারাংপাড়ায় প্রবেশ করে ফাঁকা গুলি ছোড়ে। ২২ জনকে অস্ত্রের মুখে বন্দি রাখে। সাতজনকে হত্যা করে বাকিদের ছেড়ে দেয়।  এই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে ইউপিডিএফ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.