ফরিদপুরে জাঁকজমক দুর্গাপূজায় ফুটে উঠেছে পৌরাণিক নানা কাহিনি

মহানবমী আজ

0
92
ফরিদপুর সদর উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের ধোপাডাঙ্গা চাঁদপুর গ্রামের যশোদা জীবন দেবনাথের বাড়ির মণ্ডপ

ফরিদপুর জেলায় এবার ৮৩৪টি মন্দির-মণ্ডপে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছে। এর মধ্যে ব্যতিক্রমী আয়োজনের মাধ্যমে মানুষের নজর কেড়েছে সদর উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের ধোপাডাঙ্গা চাঁদপুর গ্রামের যশোদা জীবন দেবনাথের বাড়ির মণ্ডপ ও আলফাডাঙ্গা উপজেলা সদরের কুশুমদী মহল্লার শ্রীশ্রী হরিমন্দিরের মণ্ডপ।

যশোদা জীবন দেবনাথ ফরিদপুর জেলা পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সভাপতি। তাঁর বাড়িতে বৃহৎ পরিসরে তিন শতাধিক প্রতিমা নিয়ে দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এসব প্রতিমার মাধ্যমে পৌরাণিক নানা কাহিনি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আলফাডাঙ্গার শ্রীশ্রী হরিমন্দিরে ২০১টি প্রতিমা নিয়ে পূজার আয়োজন করা হয়েছে।

ফরিদপুরে এ বছর ৮৩৪টি মন্দির-মণ্ডপে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছে। গত বছর জেলায় পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ৮২৯টি। এক বছরের ব্যবধানে মণ্ডপের সংখ্যা বেড়েছে পাঁচটি। জেলা পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বিধান সাহা বলেন, ফরিদপুর জেলায় দুর্গাপূজা সারা দেশের মধ্যে ব্যতিক্রম। এ পূজাকে কেন্দ্র করে আলোকসজ্জা ও বিভিন্ন ধরনের প্রদর্শনীর আয়োজন করায় দর্শনার্থীরা হুমড়ি খেয়ে পূজা দেখতে আসেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আশপাশের জেলা থেকেও বিভিন্ন ধরনের যানবাহন নিয়ে ভক্তরা গভীর রাত পর্যন্ত শহরে ঘুরে ঘুরে পূজা দেখেছেন। আবহমানকাল ধরে ফরিদপুরের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আড়ম্ভরের সঙ্গে দুর্গাপূজার আয়োজন করে যাচ্ছেন।

শারদীয় দুর্গোৎসবে আজ সোমবার সকালে ছিল নবমী পূজা। ফরিদপুর শহরের শরৎ সাহার বাড়ির পূজামণ্ডপের পুরোহিত মণিগোপাল চক্রবর্তী বলেন, নবমী পূজায় চণ্ডীপাঠ শেষ করা হয়। ১৩ অধ্যায়ের চণ্ডীপাঠ ষষ্ঠী থেকেই শুরু করা হয়। এরপর সপ্তমী, অষ্টমীতে ধারাবাহিকভাবে চণ্ডী পাঠ করে নবমী পূজার সময় শেষ করা হয়। এরপর যজ্ঞ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নবমীর পূজার সমাপ্তি ঘটে। আজ সকাল ৯টার দিকে নবমী পূজা শুরু হয়েছে। নবমী পূজা, চণ্ডীপাঠ ও যজ্ঞ শেষ করতে বিকেল ৪টা বেজে যাবে।

মণিগোপাল চক্রবর্তী বলেন, অষ্টমী তিথির শেষ ও নবমী তিথির শুরুটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর সময়কাল মাত্র ৪৭ মিনিট। এ সময় সন্ধিপূজা করতে হয়। পুরাণ অনুযায়ী, অবতার শ্রীরামচন্দ্র দেবী দুর্গার কৃপা পাওয়ার জন্য দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। এই অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে রামচন্দ্রের সঙ্গে দেবী দুর্গার মতবিনিময় ও সন্ধি হয়। এ সন্ধি হওয়ার পরই সীতাকে হরণকারী রাবণকে বধ করেন শ্রীরামচন্দ্র। কাল মঙ্গলবার বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে শেষ হবে পাঁচ দিনব্যাপী দুর্গোৎসব।

দুই মাস ধরে কাজ করে রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন প্রতিমাশিল্পীরা। ফরিদপুর সদরের যশোদা জীবন দেবনাথের বাড়ির মণ্ডপ
দুই মাস ধরে কাজ করে রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন প্রতিমাশিল্পীরা। ফরিদপুর সদরের যশোদা জীবন দেবনাথের বাড়ির মণ্ডপ

ফরিদপুর সদরের যশোদা জীবন দেবনাথের বাড়ির সুবিস্তার পূজামণ্ডপজুড়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মহাভারত ও রামায়ণের গল্পকথা। ৫২টি খণ্ডে শোভা পাচ্ছে আলাদা আলাদা কাহিনি। প্রতিমাশিল্পীরা দুই মাস ধরে রাতদিন পরিশ্রম করে যেন মূর্ত করে তুলেছেন পৌরাণিক নানা চরিত্র। ব্যতিক্রমী এই পূজার আয়োজন দেখতে বিভিন্ন এলাকা থেকে দর্শনার্থীরা আসছেন।

প্রতিমাশিল্পী সুজয় কুমার পাল বলেন, দুই মাস ধরে কাজ করে রামায়ণ ও মহাভারতের মূল কাহিনি ফুটিয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে হরিশ্চন্দ্র, রাম–লক্ষণ, মুচি রুহি দাশের কাহিনি। এতে সব মিলিয়ে মোট ৩০০টি প্রতিমা রয়েছে। এটি দেশের কয়েকটি পূজার মধ্যে অন্যতম একটি সেরা পূজা। সপ্তমী-অষ্টমীর দিন ও রাতে এ মন্দিরে দর্শকের ঢল নামে। দূরদূরান্ত থেকে সর্বস্তরের জনগোষ্ঠী এ মন্দিরে ভিড় করেন।

ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার শ্রীশ্রী হরিমন্দিরের ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পৌরাণিক কাহিনি
ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার শ্রীশ্রী হরিমন্দিরের ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পৌরাণিক কাহিনিছবি: প্রথম আলো

যশোদা জীবন দেবনাথ বলেন, এক যুগ ধরে তিনি এভাবে পূজা আয়োজন করে যাচ্ছেন। এ বছর ওই পূজামণ্ডপে তিন শতাধিক প্রতিমা স্থাপনের মাধ্যমে দেশের অন্যতম বড় পরিসরে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছে। পূজার স্থানসহ আশপাশের এলাকার আলোকসজ্জার মাধ্যমে এক মায়াবী রূপ দেওয়া হয়েছে। সামনে নির্মাণ করা হয়েছে বিশাল আকারের সুসজ্জিত একটি তোরণ। বিশাল আয়োজনে প্রায় ৫০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।

বিশাল এই আয়োজন দেখতে মাগুরা সদরের রাউতারা গ্রাম থেকে এসেছিলেন মানিক কুমার কুণ্ডু। তিনি বলেন, অনেক দূর থেকে অনেক কষ্ট করে তিনি পূজা দেখতে এসেছেন। এখানে আসার পর আলোঝলমল পরিবেশে পূজা আয়োজন দেখে তাঁর সব কষ্ট চলে গেছে। তিনি আরও বলেন, ‘এখানে না এলে বুঝতেই পারতাম না আয়োজনটা কত বড় এবং বর্ণাঢ্য।’ পূজা দেখতে এসে বিমোহিত হওয়ার কথা জানালে ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার চরযশোহরদী ইউনিয়নের লক্ষ্মণ মণ্ডলও।

আলফাডাঙ্গা উপজেলা সদরে কুশুমদী মহল্লার উপজেলা কেন্দ্রীয় শ্রীশ্রী হরিমন্দিরে এবার নির্মাণ করা হয়েছে ২০১টি প্রতিমা। গত বছর ছিল ১০১টি প্রতিমা। ২০০৫ সালে এ মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে বড় কলেবরে দুর্গাপূজার আয়োজন শুরু হয় গত বছর।

মন্দির কমিটির সভাপতি প্রদীপ বিশ্বাস বলেন, সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলিযুগের বিভিন্ন ধর্মীয় ঘটনাকে নিয়ে এ প্রতিমাগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। আগামী বছর ৩০১টি প্রতিমা নির্মাণ করে দুর্গাপূজা আয়োজনের ইচ্ছা রয়েছে তাঁদের।

আলফাডাঙ্গার শ্রীশ্রী হরিমন্দিরে এবার নির্মাণ করা হয়েছে ২০১টি প্রতিমা
আলফাডাঙ্গার শ্রীশ্রী হরিমন্দিরে এবার নির্মাণ করা হয়েছে ২০১টি প্রতিমা

এ ছাড়া ফরিদপুরে বর্ণাঢ্য পরিবেশে পূজার আয়োজন করা হয়েছে শহরের গোয়ালচামট মহল্লায় বাস মালিক গ্রুপ, মিনিবাস মালিক সমিতি, শ্রীঅঙ্গন দক্ষিণ পল্লি, ওয়েস্টার্নপাড়া, নীলটুলি সর্বজনীন দুর্গাপূজা মন্দির, ঝিলটুলির সেবা সংঘ সর্বজনীন পূজামন্দিরে। ঝিলটুলির সেবা সংঘের পূজার আয়োজন ফরিদপুর শহরের প্রাচীনতম পূজার আয়োজন হিসেবে ধরা হয়।

শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গাপূজার শেষ করতে সব প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান। তিনি বলেন, এবার বেশির ভাগ মন্দির ও মণ্ডপ সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ মণ্ডপে সার্বক্ষণিক পুলিশি পাহারার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি মণ্ডপে আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিটি মণ্ডপ ঘিরে গঠন করা হয়েছে সম্প্রীতি কমিটি। এ কমিটিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশাপাশি আশপাশের অন্য সম্প্রদায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও দায়িত্ব পালন করেছেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.