প্রতিশ্রুতি রাখেনি আওয়ামী লীগ, অভিযোগ সংখ্যালঘু নেতাদের

0
91
রানা দাশগুপ্ত ও কবির বিন আনোয়ার

দেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও অধিকারের প্রশ্নে দেওয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ রক্ষা করেনি—এমন অভিযোগ তুলেছেন সংখ্যালঘু নেতারা। অসন্তোষ ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের মধ্যে। প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা রাজপথে আন্দোলনও চালিয়ে যাচ্ছেন। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বলেছেন, সরকার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না করায় তাদের নিরাপত্তার প্রশ্নে উদ্বেগ বেড়েছে।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন এই সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হবে আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারি। সংবিধান অনুযায়ী, সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার (২৯ জানুয়ারি) আগের ৯০ দিনের মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে, যার দিন গণনা শুরু হবে আগামী ১ নভেম্বর। এ অবস্থায় সামনে জাতীয় সংসদের আরেকটি অধিবেশন বসতে পারে। যদি অধিবেশন বসে, আর সেখানে কোনো প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা না হয়, তাহলে আর কোনো সুযোগ থাকছে না বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।

তবে আওয়ামী লীগের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কবির বিন আনোয়ার বলেন, ‘আওয়ামী লীগের যে প্রতিশ্রুতি আছে, তার প্রতিটি বিষয় নিয়ে কাজ চলছে। যেমন আইনগুলো প্রণয়ন করা, কোনোটা সংসদে আছে, কোনোটা আইন মন্ত্রণালয়ে আছে, কোনোটা বিল আকারে পেশ হয়েছে, কোনোটা ধর্ম মন্ত্রণালয়ে পেন্ডিং (ঝুলে) আছে। কিছুই হয়নি—এটা বলা যাবে না। উই আর ওয়ার্কিং অন ইট।’

কবির বিন আনোয়ার যেসব আইনের কথা বলছেন, সেগুলো সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনোটি পাস হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘বর্তমান সংসদের আরও একটা অধিবেশন হবে। আমরা এখন সেদিকে তাকিয়ে আছি যে সরকার কী ভূমিকা পালন করে।’

প্রতিশ্রুতি যা ছিল

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রকাশিত ইশতেহারে ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও অনুন্নত সম্প্রদায়’ নামে একটি অনুচ্ছেদ রয়েছে। সেখানেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।

আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতির অগ্রাধিকারের তালিকায় ছিল ‘অর্পিত সম্পত্তি সংশোধনী আইন দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকৃত স্বত্বাধিকারীদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে’।

১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের যাঁরা ভারত চলে গিয়েছিলেন, তাঁদের সম্পত্তিকে ‘শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। দেশ স্বাধীন হলে সেসব সম্পত্তিকে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০১ সালে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন পাস হয়, যা ২০১২ সালে কার্যকর হয়। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সেসব সম্পত্তি মূল মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বললেও এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দাবি, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে দ্রুততম সময়ে মামলাগুলো নিষ্পত্তি করে সেসব সম্পত্তি প্রকৃত মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হোক।

জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন এবং সংখ্যালঘু বিশেষ সুরক্ষা আইন প্রণয়নের প্রতিশ্রুতিও ছিল ইশতেহারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই প্রতিশ্রুতিও বাস্তবায়িত হয়নি।

সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জমি, জলাধার ও বন এলাকায় অধিকার সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণসহ ভূমি কমিশনের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছিল গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে। পাঁচ বছর শেষ হতে চললেও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জমি, জলাধার ও বন এলাকায় অধিকার সংরক্ষণের জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি; বরং এই সময় বহু ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ জমি, জলাধার ও বন এলাকা হারিয়েছেন। এমনকি সরকারি উদ্যোগের কারণেও এসব হুমকিতে পড়েছে, যেমন টাঙ্গাইলের মধুপুর বনে খাল খননের উদ্যোগ, যা সেখানের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের আন্দোলনের মুখে থেমে আছে। এ ছাড়া সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের জন্য ভূমি কমিশনও গঠন করেনি সরকার।

অনগ্রসর ও অনুন্নত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, দলিত ও চা-শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে বিশেষ কোটা এবং সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত থাকবে—এ প্রতিশ্রুতিও ছিল ইশতেহারে। এই ইশতেহার ঘোষণার আগে ২০১৮ সালের শুরুর দিকে কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়। এই আন্দোলনের ফলে সরকারি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে অন্য কোটার মতো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কোটাও বাতিল হয়ে যায়, যদিও তা আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল না। তবে আওয়ামী লীগ সরকার পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় এলেও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য কোটাসুবিধার ব্যবস্থা করেনি। এতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা পিছিয়ে পড়ছে।

ইশতেহারে ছিল সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক সব ধরনের আইন ও অন্যান্য ব্যবস্থার অবসান করা হবে। এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি।

সর্বশেষ প্রতিশ্রুতি ছিল, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের অধিকারের স্বীকৃতি এবং তাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবনধারার স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ ও তাদের সুষম উন্নয়নের জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত হলে এই প্রতিশ্রুতির বড় অংশই বাস্তবায়ন হতো, যা হয়নি। তা ছাড়া ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য সরকার অগ্রাধিকারভিত্তিক কর্মসূচিও বাস্তবায়ন করেনি।

ধারাবাহিক আন্দোলন

সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরেই মাঠে রয়েছে সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ও এর নেতৃত্বে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন সংগঠন। এসব সংগঠন সভা-সমাবেশ ও রোডমার্চের মতো কর্মসূচি পালন করার পাশাপাশি আড়াই লাখ মানুষের স্বাক্ষরসংবলিত স্মারকলিপি প্রধানমন্ত্রীর কাছে দিয়েছে। চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ এবং প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে স্মারকলিপি প্রদান করে তারা।

প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দাবিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে চলতি বছরের ১২ এপ্রিল, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে ১৯ ফেব্রুয়ারি এবং আওয়ামী লীগের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কবির বিন আনোয়ারের সঙ্গে ১৭ জুলাই বৈঠক করেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ও তার নেতৃত্বে সংখ্যালঘু সংগঠনগুলোর ঐক্যমোর্চার নেতারা।

সর্বশেষ গত ৮ থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গণ-অনশন ও গণ-অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন ঐক্য মোর্চার নেতারা।

বর্তমান সংসদের শেষ অধিবেশনে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আইনের সংশোধনী বা সংস্কার করা হবে। এখন সেই আশায় বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ তাদের পূর্বঘোষিত ৬ অক্টোবর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ পিছিয়ে আগামী ৪ নভেম্বর নিয়েছে। অর্থাৎ, বর্তমান সরকার তার শেষ অধিবেশনে সংখ্যালঘুদের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেয়, তা দেখে পরবর্তী সময়ে কর্মসূচি বা প্রতিক্রিয়া জানাবেন সংখ্যালঘু নেতারা।

প্রতিশ্রুতি না রাখার কারণ কী

সংখ্যালঘুদের টানা আন্দোলনের পরও আওয়ামী লীগ নিজেদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি এখনো রক্ষা করেনি। এর কারণ কী, তা জানতে চাইলে উত্তর পাওয়া যায়নি জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কবির বিন আনোয়ারের কাছ থেকে।

আদিবাসী ও সংখ্যালঘুবিষয়ক সংসদীয় ককাসের সদস্য ও আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আরমা দত্ত বলেন, সংখ্যালঘুদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক। তবে টেকনিক্যাল কমিটি, যারা আইনের বিষয়ে কাজ করছে, তারা এখনো কাজ শেষ করতে পারেনি।

প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দাবিতে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচিতে দেখা গেছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননকে। তিনি বলেন, ‘সরকারের আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে অনেক সময় অলসতা থাকে আরকি, এটাই মূল কারণ বলে আমার ধারণা।’

‘তারা (প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন) করেনি, করা উচিত ছিল বহু আগেই,’ বলেও মনে করেন রাশেদ খান মেনন।

তবে সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে সংখ্যালঘু নেতাদের। অবজ্ঞা, অবহেলা ও সংখ্যালঘুদের নাগরিক হিসেবে গণ্য না করার মানসিকতা থেকে এসব দাবি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, ‘বিএনপি ও তার মিত্ররা মনে করে, ওরা (সংখ্যালঘু) চলে গেলে ধর্মও বাঁচবে, দেশও বাঁচবে। আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা মনে করে, ওরা (সংখ্যালঘু) দেশে থাকলে ভোট আমার। চলে গেলে জমিটা আমার। আমরা আর আত্মবিশ্বাস রাখতে পারছি না।’

রানা দাশগুপ্তর এমন অভিযোগ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুই দলের নেতারাই মানতে রাজি নন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.