‘পুতুল, আবিদের খবর কিছু জানো, ও তো কক্সবাজারে ডুবে গেছে’

0
107
বিভিন্ন সময়ে তোলা ছবিতে পুতুল ও আবিদ

১২ বছর আগের এই দিনে কক্সবাজারের সাগরে ডুবে মারা যান ক্লোজআপ তারকা আবিদ শাহরিয়ার। এই মৃত্যু সেদিন হতবাক করে পরিবার ও তাঁর বন্ধুবান্ধব সবাইকে। প্রতিবছর এই দিনে তাঁকে অনেকে নানাভাবে স্মরণ করেন। তাঁর সংগীতশিল্পী বন্ধু সাজিয়া সুলতানা পুতুল যেন আবিদের সেই অকালমৃত্যুর যন্ত্রণা আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন। এই দিনে তাঁকে নিয়ে নানা স্মৃতিকথা লিখে থাকেন। আজও তাঁর ব্যতিক্রম হয়নি।

আবিদ ও পুতুল খুবই ভালো বন্ধু ছিলেন। একসঙ্গে উপস্থাপনাও করতেন। আড্ডাবাজি আর ঘুরে বেড়াতেও ভালোবাসতেন তাঁরা। পুতুলের সেই বন্ধু আজ ১২ বছর পৃথিবীতে নেই। নিজের ফেসবুক দেওয়া পোস্টে এভাবেই লিখলেন—
‘আজ থেকে ১২ বছর আগের কথা…। ২৯ জুলাই ২০১১, সন্ধ্যা ধেয়ে যাচ্ছে রাতের দিকে। রাতে “কলের গান” অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় যাব, তাই সাজছি। হাতে ধরা কাজল পেনসিল, এক চোখে কাজল পরেছি, অন্য চোখটা বাকি তখনো। একটা ফোন এল।
পুতুল, আবিদের খবর কিছু জানো?
না তো, কেন?
ও তো কক্সবাজারে ডুবে গেছে।
কী বলেন না বলেন! ও কক্সবাজার গেল কবে?
একটা ফোন করে দেখো তো ওকে।
এখনই দেখছি। ধুর এই রকম একটা আজগুবি খবর কে দিল আপনাকে?’
ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে এরপর পুতুল বারবার আবিদের নম্বরে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু কোনোভাবে তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হচ্ছিল না। ফোনের রিং বেজেই চলছে। কিন্তু আবিদ তা ধরছেন না।

সেদিনের সেই ঘটনার বর্ণনা এভাবেই দিলেন পুতুল। বললেন, ‘আবিদের ফোন তো বেজে যাচ্ছে! ডুবে যাওয়া মানুষের ফোন বাজে নাকি? হাসলাম মনে মনে। আমার কান তৈরি, এখনই সে তার স্বভাবসুলভ দুষ্টু কণ্ঠে ফোনটা তুলে বলবে, “সুলতানা, কী খবর?” দুবার ফোনটা বেজে চলল, দ্বিতীয়বার কিন্তু আমি একটু এলোমেলো। তুলল না এবারও। একটু থামলাম, কী যেন ভাবলাম। তৃতীয়বার কেন যেন ভয় লাগল। একটিবার বাজতেই ওপাশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হলো সংযোগ। মনে মনে ঝগড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ফোন না ধরার বাতিক আছে তার। নাছোড় হয়ে গেলাম এবার, আবার কল। এবার কল হতে না হতেই কেটে গেল। বুকের ভেতর ক্যাচ করে উঠল। হাত–পা অসাড় লাগছিল।

ক্লোজআপখ্যাত গায়ক আবিদ মারা যান ১২ বছর আগে
ক্লোজআপখ্যাত গায়ক আবিদ মারা যান ১২ বছর আগে

টিভির ঘর পর্যন্ত কী করে যাব আমি! আমার ঘরটা এত বড় কেন? আমি এ রকম প্রান্তরের মতো একটা ঘরে থাকি, আগে তো কখনো বুঝিনি! টিভি খুলব কিন্তু কোথায় কী খুঁজব? টিভিতে কী দেখাচ্ছে? রিমোট কী করে চালায় ওই মুহূর্তে মনে হলো তাও ভুলে গেছি। এলোমেলো হাতে একটা দুটো চ্যানেলে ঘুরলাম, না তো সব তো ঠিকই আছে! একটা চ্যানেলে খবরের ফাঁকে দুটো মৃতদেহের ছবি ভেসে এল। এরা আবিদ হবে কেন? এরা কি আবিদ হওয়ার কথা ছিল? মৃতদেহের মুখের ছবি দেখাচ্ছে তখন, আবিদের আধবোজা চোখ দেখেও আমার চোখের ধাঁধা মনে হচ্ছিল। দেখি গলায় ঝুলছে এমন একটা লকেট, যা অবিকল আবিদের পরে থাকা লকেটটার মতো। সব শেষ, আবিদ একটা হাসপাতালে তক্তার ওপর পড়ে আছে।’

এদিকে দেশ টিভির ‘কলের গান’ অনুষ্ঠান কর্তৃপক্ষ যে গাড়ি পাঠিয়েছে, ততক্ষণে সেটি পুতুলের বাসায় নিচে পৌঁছে গেছে। মন কোনোভাবে সায় দিচ্ছিল না বন্ধুর এমন একটা খবর পেয়ে অনুষ্ঠান করতে যাবে। বারবার সিদ্ধান্ত নিয়ে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হতে হলো। সেই কথাও ফেসবুক পোস্টে জানালেন পুতুল। বললেন, ‘গাড়ি বাসার নিচে দাঁড়িয়ে। বললাম, “পারব না, আমি মানুষ। আমি আবিদের বন্ধু।” লাভ হয়নি। সে রাতে বুঝেছিলাম দায়িত্বের কাছে আবেগ হেরে যায়। ওই এক চোখে কাজল নিয়েই কাঁদতে কাঁদতে পুরো অনুষ্ঠান সফলভাবে উপস্থাপনা করে দিয়ে এসেছিলাম। আবিদ হয়তো হেসেছে মনে মনে। হয়তো বলেছে, “সুলতানা আজকেও…? এত টাকা কই রাখবি রে?”’

সেদিনের কথা মনে করে ফেসবুক পোস্টে পুতুল বলেন, ‘বাড়ি ফিরলাম মধ্যরাতে। রাতটা দীর্ঘ খুব। ভোরে আবিদের সঙ্গে দেখা হবে। ওর সঙ্গে দেখা করতে এত উতলা আগে কখনো হইনি তো! দেখা হলো সকালে। প্রথমে ধানমন্ডিতে, এরপর শহীদ মিনার, শেষে এনটিভি। জায়গাগুলোয় একসঙ্গে কতবার গিয়েছি! সেদিনও গিয়েছি। শুধু প্রাণহীন আবিদকে সঙ্গে নিয়ে, এটুকুই পার্থক্য। সেদিন হেঁটে যেতে পারেনি, গিয়েছে অন্যের কাঁধে চড়ে। সেদিন সবার হাসির কারণ না হয়ে কান্নার উপলক্ষ হয়েছিল। আমরা মাটির ওপরে আছি, আর ও মাটির নিচে। আমরা স্মৃতি হয়ে যাইনি, ও ছবি হয়ে গেছে। আমরা ওকে ভুলে গিয়েছি, ও আমাদের মনে রেখেছে—এটুকুই পার্থক্য।’

সবশেষে পুতুল বললেন, ‘আবিদ, প্রতিবছর জুলাই মাসে এই এক বিপত্তি। জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর দশ দিনের মাথায় তোকে নিয়ে আবারও বিশাল ইতিহাস লিখতে হয়। যাওয়ার জন্য জুলাই মাসটাই বেছে নিতে হলো তোর? জুলাইতে তোর–আমার জন্মদিন বলে মাসটা একটু আনন্দে কাটাতাম, সেটাও নষ্ট করে দিলি। যত্তসব!’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.