পায়রার ঘাটতি কমাতে আদানি ও বাঁশখালীর বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে

0
88
পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।

তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। তবে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালুর আগে বন্ধ হবে না লোডশেডিং।

তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে এক সপ্তাহ আগে দিনে গড়ে দুই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং শুরু হয় সারা দেশে। এরপর দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা বন্ধের পর লোডশেডিং তিন হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যায়। এখন ভারতের আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এসএস পাওয়ারও উৎপাদন শুরু করছে। এতে পায়রা বন্ধের ফলে বিদ্যুতের যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা কমতে পারে। তবে লোডশেডিং থামবে না।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র বলছে, পায়রা থেকে দিনে গড়ে ১ হাজার ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া গেছে। এটি বন্ধের ফলে বড় ঘাটতি তৈরি হয়। ঘাটতি পূরণে ভারতের ঝাড়খন্ডে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাড়তি ৩০০ মেগাওয়াট নেওয়া হবে। আর বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পাওয়া যাবে ৫০০ মেগাওয়াট। এর সঙ্গে তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। দু-এক দিনের মধ্যে সব মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়তে পারে। এতে লোডশেডিং কিছুটা সহনীয় হয়ে আসতে পারে বলে মনে করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

আদানির কেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ আবার শুরু

আদানি গ্রুপের কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ আসা শুরু হয় গত মার্চে
আদানি গ্রুপের কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ আসা শুরু হয় গত মার্চেফাইল

আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৮০০ মেগাওয়াট করে দুটি ইউনিট আছে। প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ আসা শুরু হয় গত মার্চে। দিনে তারা গড়ে ৭৪০ মেগাওয়াট সরবরাহ করছে। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় ইউনিট থেকে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করেছে তারা। এক সপ্তাহের মধ্যে এ কেন্দ্র থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আর বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রে (এস আলম গ্রুপ ও চীনের সেপকো থ্রির মালিকানাধীন) ৬৬০ মেগাওয়াট করে দুটি ইউনিট আছে। এর প্রথমটিতে পরীক্ষামূলকভাবে এখন সর্বোচ্চ ২০০ মেগাওয়াট করে দিনে সরবরাহ করছে তারা। এটি থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে এক সপ্তাহ পর। আর ২৫ জুন থেকে আবার উৎপাদনে ফিরতে পারে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র।

আদানির বিদ্যুৎ বেড়ে এক হাজার মেগাওয়াট হবে। বাঁশখালী থেকে ৫০০ মেগাওয়াট আসবে ১৩ জুন। তেলচালিত কেন্দ্রে আজ (বৃহস্পতিবার) থেকে এক হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন বাড়ানো হবে। আজ থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। ২৫ জুনের পর বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বলছে, জ্বালানির অভাবে দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রের তিন ভাগের এক ভাগ সক্ষমতা অনুসারে উৎপাদন করতে পারছে না। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করেও গ্যাসের ঘাটতি পূরণ করা যাচ্ছে না। ডলার-সংকটে কয়লা আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। পায়রা বন্ধ হয়ে গেছে কয়লার অভাবে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রও কয়লাসংকটে অর্ধেক উৎপাদন করছে। ফার্নেস তেলচালিত ৬৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ২৫ থেকে ২৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন করা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকায় জ্বালানি তেল কিনতে পারছে না এসব কেন্দ্র।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল বুধবার বলেন, আদানির বিদ্যুৎ বেড়ে এক হাজার মেগাওয়াট হবে। বাঁশখালী থেকে ৫০০ মেগাওয়াট আসবে ১৩ জুন। তেলচালিত কেন্দ্রে আজ (বৃহস্পতিবার) থেকে এক হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন বাড়ানো হবে। আজ থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। ২৫ জুনের পর বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

গতকাল মধ্যরাতে আদানির কেন্দ্র থেকে আবার বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়েছে। বেলা পৌনে তিনটায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের রোহনপুরে ঝড়ের কারণে সঞ্চালন লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরবরাহ। এতে গতকাল বিকেল চারটায় সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৪১৯ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে বলে জানিয়েছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। সব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা এটি।

ডলার-সংকটে কয়লা আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। পায়রা বন্ধ হয়ে গেছে কয়লার অভাবে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রও কয়লাসংকটে অর্ধেক উৎপাদন করছে। ফার্নেস তেলচালিত ৬৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ২৫ থেকে ২৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন করা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকায় জ্বালানি তেল কিনতে পারছে না এসব কেন্দ্র।

পিজিসিবির তথ্য বলছে, এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন আড়াই থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হচ্ছে। এতে ঢাকায় দিনে গড়ে তিন ঘণ্টা হলেও ঢাকার বাইরে কোনো কোনো জেলার গ্রাম এলাকায় ১২ ঘণ্টার বেশি লোডশেডিংয়ের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। আদানির সরবরাহ বন্ধের পর টানা তিন ঘণ্টা লোডশেডিং ছিল গড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট। এরপর তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদন বাড়িয়ে ঘাটতি কমানো হয়।

শহরে-গ্রামে বড় বৈষম্য

ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলার বিদ্যুৎ পরিস্থিতির তথ্য নিয়ে দেখা গেছে, পৌর শহর ও গ্রাম এলাকার মধ্যে লোডশেডিংয়ে বড় ধরনের বৈষম্য রয়েছে। মুন্সিগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি বলছে, মুন্সিগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রামে ১২ থেকে ১৩ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। শহরে লোডশেডিং ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা।

পাবনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর অধীনে বেড়া সার্কেলের সহকারী মহাব্যবস্থাপক হাবিবুর রহমান জানান, ১৬ মেগাওয়াটের বিপরীতে পাচ্ছেন ৮ মেগাওয়াট। ১২ থেকে ১৩ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। আর পাবনা জেলা শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান নেসকো অঞ্চল-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মাজেদুল হক জানান, ২৮ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে পাচ্ছেন ২০ মেগাওয়াট পর্যন্ত।

কিশোরগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির তথ্য বলছে, কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের শোলাকিয়া এলাকার ১২ নম্বর ফিডারে (একটি নির্দিষ্ট এলাকা) গত ২৪ ঘণ্টায় ১ ঘণ্টা লোডশেডিং ছিল। আর একই জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার ২ নম্বর ফিডারের আওতায় থাকা গ্রামে লোডশেডিং হয়েছে ১২ ঘণ্টা।

ঠাকুরগাঁও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বালিয়াডাঙ্গী কার্যালয়ের এজিএম কামরুল হাসান জানান, উপজেলার বড় পলাশবাড়ী, বাদামবাড়ী, পারিয়া এলাকায় মঙ্গলবার দুপুর ১২টা থেকে গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত লোডশেডিং হয়েছে ১২ বার। একই সময়ে শহরের পুরোনো বাসস্ট্যান্ড, হাজিপাড়া, কালীবাড়ি এলাকায় ৮ বার লোডশেডিং হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঠাকুরগাঁও নেসকোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম বলেন, শহর ও গ্রামের মধ্যে বৈষম্য না করে লোডশেডিং সমহারে ভাগ করে দিতে পারত। এতে গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং অসহনীয় হতো না এবং মানুষের ভোগান্তিও কমত।

ডলার জোগান নিয়ে সংশয়

সরকারের পক্ষ থেকে পায়রার ঘাটতি পূরণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও ডলারের জোগান নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে। আদানির বিদ্যুৎ বিল এখন পর্যন্ত পরিশোধ শুরু হয়নি। বিদ্যুৎ বিলের বিপরীতে নিরাপত্তা জামানত হিসেবে ব্যাংকে ঋণপত্র খুলে রাখার কথা থাকলেও ডলার-সংকটে তা করতে পারেনি পিডিবি। বড় চারটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা আমদানির ডলার জোগান নিয়েও শঙ্কা আছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম বলেন, নিজস্ব সম্পদের ব্যবহারে জোর না দিয়ে আমদানির দিকে গেছে দেশের জ্বালানি খাত। দেশীয় কয়লা তোলা হয়নি, গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দেয়নি সরকার। এখন আদানি ও বাঁশখালী মিলে হয়তো পায়রার ঘাটতি কমাবে, কিন্তু লোডশেডিং বন্ধ হবে না। বৃষ্টি হলে বরং স্বস্তি আসবে।

[তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন ফয়সাল হোসেন, মুন্সিগঞ্জ; সরোয়ার মোর্শেদ, পাবনা; তাফসিলুল আজিজ, কিশোরগঞ্জ; মজিবর রহমান খান, ঠাকুরগাঁও]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.