পাঁচ ইসলামী ব্যাংকে নিয়ম মেনে ধার দেওয়া হচ্ছে

সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংক

0
95
বাংলাদেশ ব্যাংক

বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিস পাঁচটি ইসলামী ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতি পূরণের জন্য সতর্ক করে যে চিঠি দিয়েছে, তা ভবিষ্যতের জন্য সতর্কতা। তবে এসব ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্লিয়ারিং থেকে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত হয়নি। আবার ট্রেজারি বিল, বন্ডের মতো উপকরণ না থাকায় বিশেষ উপায়ে যে ধার দেওয়া হচ্ছে, তা বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়নি। নিয়ম মেনেই বাংলাদেশ ব্যাংক ম্যানুয়ালের আলোকেই তাদের টাকা দেওয়া হচ্ছে। গতকাল রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে এমন তথ্য জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত ওই সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি চিঠির ভিত্তিতে গত শুক্রবার কয়েকটি গণমাধ্যমে পাঁচটি ব্যাংকের বিষয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ব্যাখ্যা দিতে এ সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়। ব্যাংকগুলো হলো– ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংক। শুক্রবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে একটি জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কয়েকটি পত্রিকায় শরিয়াহ ভিত্তিতে পরিচালিত কিছু ইসলামী ব্যাংককে ক্লিয়ারিং হাউস বা নিকাশ ঘর থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার খবরের বিষয়ে সবার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে, নিকাশ ঘর পরিচালিত হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগের তত্ত্বাবধানে। পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগ থেকে এ রকম কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের  বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে জানতে চাইলে মেজবাউল হক বলেন, মতিঝিল অফিস থেকে কয়েকটি শরিয়াহ ব্যাংকের ঘাটতি সমন্বয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে চিঠিতে সতর্ক করা হয়। তবে এটি সিদ্ধান্ত নয়; বরং ভবিষ্যতের জন্য সতর্কতা। ক্লিয়ারিং থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার মতিঝিল অফিসের নেই। ক্লিয়ারিং বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে পারে পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগ। প্রতিটি ব্যাংক ও সরকারের চলতি হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ করে মতিঝিল অফিস। এটা একটা সতর্কতামূলক বাণী, কোনো সিদ্ধান্ত নয়; যা বোঝানোর জন্যই জরুরি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়।

একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, মতিঝিল অফিস  টাকা দেওয়া বন্ধ করলে এসব ব্যাংকের ক্লিয়ারিং কার্যক্রম বন্ধ হবে কিনা এমন জবাবে মেজবাউল হক বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ম্যানুয়াল ১৯৪৫-এর আলোকে শরিয়াহভিত্তিক পাঁচ ব্যাংকে টাকা দেওয়া হচ্ছে। কোনো ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট ঋণাত্মক হলে কী করতে হবে তা ম্যানুয়ালে বলা আছে। নিয়ম অনুযায়ী অ্যাকাউন্ট নেতিবাচক হলে প্রথমে ব্যাংকগুলোকে অবহিত করতে হবে। এরপর তারা তহবিল সংগ্রহ করে ওই হিসাবে জমা করবে। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘সাসপেন্স অ্যাকাউন্ট’ থেকে ব্যাংকগুলোকে টাকা দেওয়ার সুযোগ ম্যানুয়ালেই আছে। এর আগে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক থেকে আইসিবিতে রূপান্তর, ইস্টার্ন এবং এনসিসি ব্যাংক রূপান্তরের সময় একই উপায়ে টাকা দেওয়া হয়েছিল। আগামী ২০ কর্মদিবসের মধ্যে সমন্বয় করতে না পারলে লেনদেন বন্ধ করার যে কথা চিঠিতে বলা হয়েছে তা কার্যকর থাকবে কিনা জানতে চাইলে বলেন, ২০ কর্মদিবস শেষ হোক, তারপর বলা যাবে।

মেজবাউল হক বলেন, ইসলামী ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনা এবং প্রচলিত ধারার ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনা এক নয়। প্রচলিত ধারার ব্যাংকের ১৩ লাখ ২৬ হাজার ৬২০ কোটি টাকা আমানতের বিপরীতে বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ রয়েছে ৩ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। এর মানে মোট আমানতের ২৫ শতাংশের মতো উপকরণ আছে। অথচ এসএলআর রাখতে হয় ১৩ শতাংশ। অন্যদিকে ইসলামী ব্যাংকগুলোর সিআরআর ৪ শতাংশ এবং এসএলআরের সাড়ে ৫ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ সংরক্ষণ করতে হয়। অথচ এসব ব্যাংকের কাছে সুকুকের (ইসলামিক বন্ড) ১৮ হাজার কোটি টাকার মধ্যে মাত্র ১৩ হাজার কোটি টাকার বন্ড রয়েছে। ইসলামিক ব্যাংকগুলোর মোট আমানতের যা ৩ শতাংশ। ফলে এসব ব্যাংকের বিধিবদ্ধ তারল্যের বেশির ভাগই রাখতে হয় নগদে। এখানে ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে প্রচলিত ধারার ব্যাংকের একটি সংস্কৃতিগত পার্থক্য আছে। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করছে।

পাঁচটি ইসলামী ব্যাংকের তারল্য সংকটে পড়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন মূল্যস্ফীতিকে অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে। যে কারণে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নেওয়া হয়েছে। এতে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমানো হচ্ছে। একই সময়ে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির কারণে বাজার থেকে টাকা উঠে আসছে। এতে করে সামগ্রিকভাবে মুদ্রাবাজারে তারল্যের ওপর একটি চাপ তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর কাছে এসএলআর সংরক্ষণ প্রয়োজনীয়তার বেশি বিল, বন্ড থাকায় ইচ্ছে করলেই তারা তা লিয়েন করে টাকা নিতে পারে। তবে ইসলামী ব্যাংকগুলোর কাছে উপকরণ কম থাকায় তাদের এ উপায়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে না। যে কারণে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। আর ব্যাংক খাতের তারল্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মিত একটি কাজ। গত বৃহস্পতিবার ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন উপকরণের বিপরীতে ১২ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। গতকাল রোববার দেওয়া হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা।

তিনি বলেন, সামগ্রিক ব্যাংক খাতে ইসলামী ব্যাংকগুলোর পারফরম্যান্স অনেক ভালো। ব্যাংক খাতের মোট আমানতের পরিমাণ ১৭ লাখ ২৫ হাজার ৫২ কোটি টাকা। আর ঋণের পরিমাণ ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের আমানত ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। আর ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ১৮ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা। বাজারের মোট আমানতের ২২ শতাংশ ইসলামী ব্যাংকের কাছে। যেখানে মোট ঋণের ২৬ শতাংশ ঋণ এসব ব্যাংকের। আবার চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ব্যাংক খাতে মোট পরিচালন মুনাফা হয়েছে ২৮ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা ১ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ইসলামী ব্যাংকগুলোর যা ৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.