ধ্বংসস্তূপে ফের ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম

সারোয়ার সুমন ও আব্দুর রহমান শাহপরীর দ্বীপ থেকে

0
86

মোকায় উপকূলে হাজার কোটি টাকার ক্ষতি

মেরিন ড্রাইভ থেকে পাঁচ কিলোমিটার এগোলেই প্যান্ডেলপাড়া। সেখানেই কাঠমিস্ত্রি কাসেমের সঙ্গে দেখা। উদাম শরীরে দাঁড়িয়ে আছেন ঢেউটিন হাতে। ছেলে মামুনকে নিয়ে লন্ডভন্ড ঘরে ছাউনি দিচ্ছেন তিনি। কাসেম বলছিলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় আমার পুরো ঘরের চালা নিয়ে গেছে। দূর থেকে ঢেউটিন কুড়িয়ে এনে আবার ঘর মেরামত করেছি। এভাবেই থাকতে হবে, এটাই আমাদের নিয়তি।’

আট সন্তান নিয়ে জালিয়াপাড়াতে থাকেন রোজিনা আক্তার। তাঁর স্বামী আবদুল মোতালেব চালান ঠেলাগাড়ি। বছর তিনেক আগে পলিথিন দিয়ে দুই রুমের এই ঘর তৈরি করেছিলেন তাঁরা। মোকার আঘাতে পুরো ঘরটি এখন লন্ডভন্ড। সেই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়েই গতকাল আবার নতুন জীবন শুরু করেছেন রোজিনা ও মোতালেব। রোজিনাদের পাশে থাকেন কাছিম আলী। তাঁর মা ও দুই সন্তান ভালোভাবে হাঁটতে পারেন না। ঘূর্ণিঝড় মোকা তাঁকেও ছাড়েনি। গতকাল দুপুরে ঘরে ছাউনি দিতে দেখা গেছে তাঁকে।

শুধু কাসেম, রোজিনা, কাছিম আলীই নন; ঘূর্ণিঝড় মোকাতে এমন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা অন্তত ১৫ হাজার। ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়েই আঁধার পেরিয়ে আলোর পথ খুঁজছেন তাঁরা। এদিকে, সরকারি কোনো ত্রাণ গতকাল সোমবার পর্যন্ত পৌঁছেনি দুর্গত এলাকায়। প্রশাসন ব্যস্ত ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা নিয়ে। ব্যক্তিগত ও বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে কিছু ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায়। তবে তা প্রয়োজনের চেয়ে কম।

বিশুদ্ধ খাবার পানি ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও উপেক্ষিত বিধ্বস্ত উপকূলে। ঘূর্ণিঝড় মোকা বড় আঘাত না করলেও তছনছ করে গেছে জনজীবন। মানবপ্রাণ না নিলেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতি করে গেছে হাজার কোটি টাকার।
শতকোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিনের পর্যটন খাতে। উপকূলে থাকা ফসলের জমি ও লবণের মাঠেও ক্ষতি ছাড়িয়েছে শতকোটির ঘর।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. শাহীন ইমরান বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় মোকাতে প্রাণহানি না ঘটলেও আর্থিক ক্ষতি ব্যাপক। আমরা তালিকা করছি। আগামীকাল থেকে ত্রাণ দেওয়ার কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হবে। আর পর্যটন খাত ও ফসলের মাঠে যে ক্ষতি হয়েছে, তা নির্ধারণ করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

ত্রাণের জন্য হাহাকার
শাহপরীর দ্বীপে আছে ৫৫০ মিটার দীর্ঘ একটি জেটি। সেখান থেকে মাটির রাস্তা ধরে এক কিলোমিটার গেলে শাহপরীর দ্বীপ জালিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেটি এখন আশ্রয়কেন্দ্র। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত চার শতাধিক নারী ও পুরুষ ঠাঁই নিয়েছেন সেখানে। তাঁদের একজন টমটমচালক সালাম। থাকেন জালিয়াপাড়াতে। গতকাল সোমবার দুপুর ১টায় তিনি বলেন, ‘শনিবার থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে আসা-যাওয়া করছি। গত দু’দিনে এক ছটাক ত্রাণও পাইনি। সোমবার সকাল থেকে ত্রাণের জন্য বসে আছি। ঘরের ছাউনি উড়িয়ে নিয়ে গেছে ঘূর্ণিঝড়। এখন রান্নারও কোনো ব্যবস্থা নেই। আজ দুপুরে কী খাব, জানি না।’ সালাম যখন কথা বলছিলেন, তখন আশ্রয়কেন্দ্রে চার শতাধিক নারী-পুরুষের জট লেগে আছে। বেসরকারি সংস্থা ইপসা ত্রাণ দেবে– এমন খবর পেয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছে তারা সবাই। তবে তখনও ত্রাণের গাড়ি এসে পৌঁছেনি আশ্রয়কেন্দ্রে। দুপুর আড়াইটায় একটি পিকআপ আসে কিছু বস্তা নিয়ে। উপস্থিতির তুলনায় এটি ছিল নগণ্য। সরকারি ত্রাণ নিয়ে স্থানীয় ইউপি মেম্বার মোহাম্মদ আবদুস সালামকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করছে প্রশাসন। এটি করতে কিছুটা সময় লাগবে। আশা করছি, দু-এক দিনের মধ্যে তালিকার কাজ শেষ হবে।’ যাদের ঘরে ছাউনি নেই, রান্নাঘরে চাল নেই, তাদের এখন কী হবে– পাল্টা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি ছোট মানুষ। এত বড় প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নেই।’ টেকনাফের ইউএনও মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হচ্ছে। সবাই ত্রাণ পাবে। একটু সময় লাগবে। সরকারি ত্রাণ দেওয়ার বিধিবদ্ধ নিয়ম আছে। সেগুলো মেনে কাজ করতে হয় আমাদের।’

খাবার পানির সংকট, নেই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাও
জালিয়াপাড়াতে আছে ১ হাজার ৮০০ জেলে পরিবার। ছয়টি সমাজে বিভক্ত হয়ে বাস করছে তারা। কালু মিয়ার সমাজে বাস করছেন ২০ বছর বয়সী বেলাল উদ্দিন। পরিবারের চার সদস্যকে নিয়ে থাকছেন তিনি জালিয়াপাড়াতে। তাঁর সঙ্গে যখন কথা হয়, তখন ঘড়ির কাঁটায় ২টা ১৫ মিনিট। ঘড়ির দিকে তাকিয়েই বেলাল উদ্দিন বললেন, ‘পরিবারের আরও চারজনকে নিয়ে গতকাল দিনভর ছিলাম এই আশ্রয়কেন্দ্রে। তবে কোনো দানাপানি পাইনি। প্রশাসনের কেউ কোনো খাবার দেয়নি। পুরোদিন উপোস ছিলাম। খাবার পানিও পাইনি। এর মধ্যে আমার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসা দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না এখানে।’

ফসল ও লবণ মাঠে শতকোটি টাকার ক্ষতি
মোকার কারণে সেন্টমার্টিন ও টেকনাফ উপকূলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে চিংড়ি মাছের ঘের, লবণের মাঠ ও পানের বরজের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। টেকনাফ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল আলম বলেন, এবার লবণের বাম্পার ফলন হয়েছিল। ৬০ হাজার একর জমিতে ৩৫ হাজার টন লবণ উৎপাদন হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে অনেকে মাঠের লবণ ওঠাতে পারেনি। মাছের ঘেরও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, প্রাণ নেয়নি ঘূর্ণিঝড় মোকা। তবে সর্বস্বান্ত করে গেছে দ্বীপের ১২ হাজার মানুষকে। কক্সবাজারের আট উপজেলায় চার ধরনের ফসল ছিল বলে জানান জেলা কৃষি সম্প্রসারণের উপপরিচালক কবির হোসেন। তিনি বলেন, ‘এখন মাঠে রয়েছে বোরো ধান, আউশের বীজতলা, সবজি ও পান। সব মিলিয়ে ৭ হাজার ৮০৯ হেক্টর জমিতে ফসল ছিল। এর মধ্যে ১ হাজার ১৪৬ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’

পর্যটন খাতে বেশি ক্ষতি
ঘূর্ণিঝড় সরাসরি আঘাত না করলেও পর্যটন খাতে ব্যাপক ক্ষতি করে গেছে। কক্সবাজার শহরের কলাতলী হোটেল-মোটেল জোনে পাঁচ শতাধিক আবাসিক হোটেলের একটি রিম রিসোর্ট। এ রিসোর্টে ৫০টির বেশি কক্ষ রয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে এ রিসোর্টে কোনো কক্ষই ভাড়া হয়নি। রিসোর্টটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নাছির উদ্দিন বলেন, সবকিছু মিলিয়ে রিসোর্টে দৈনিক ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। বৃহস্পতিবার থেকে এখন পর্যন্ত কোনো রুম ভাড়া হয়নি। শুধু রিসোর্টই নয়, কক্সবাজারের চার শতাধিক হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টের অধিকাংশের একই হাল। সেন্টমার্টিন দ্বীপের দেড় শতাধিক হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টেরও অভিন্ন চিত্র।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোকার কারণে কক্সবাজারে চার শতাধিক আবাসিক হোটেলের গড়ে প্রতিদিন অন্তত দুই কোটি টাকা করে ক্ষতি হচ্ছে। এ দুর্যোগের মধ্যে সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে কক্সবাজারের সব হোটেল-মোটেল-রিসোর্টকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। এতে করে পুরো ব্যবস্থাপনা এলোমেলো হয়ে গেছে। এগুলো স্বাভাবিক হতে আরও দীর্ঘ সময় লাগবে। কক্সবাজার হোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেলিম নেওয়াজ বলেন, শহরের চার শতাধিক হোটেলের দৈনিক ধারণক্ষমতা ১ লাখ ৩০ হাজার। এখন কোনো পর্যটকও নেই।

ক্ষতির তালিকা করছে প্রশাসন
ঘূর্ণিঝড় মোকাতে ফসল ও বসতঘরের ক্ষতি হওয়ার তালিকা করছে প্রশাসন। প্রাথমিকভাবে তারা ১২ হাজার বসতঘর ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে। এর মধ্যে ১০ হাজার বসতঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং দুই হাজার বসতঘর পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। ক্ষতির চিত্র দেখতে জেলা প্রশাসক মো. শাহীন ইমরান গতকাল পরিদর্শন করেছেন সেন্টমার্টিন। সেখান থেকে ফিরে তিনি জানান, মঙ্গলবার থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে; দেওয়া হবে ত্রাণও।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.