দুস্থের চাল যাচ্ছে সচ্ছলদের হাতে

0
148
গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর মানচিত্র

আকমিনা বেগমের বাড়িটি হোসেনপুর গ্রামের বড় বাড়িগুলোর একটি। পাঁচ-ছয় বিঘা কৃষিজমিও আছে তাঁদের। এই আকমিনার নাম আছে দুস্থ নারীদের চাল সহায়তা দেওয়ার সরকারি কার্যক্রম ভালনারেবল উইমেন বেনিফিটের (ভিডব্লিউবি) তালিকায়।

গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার হোসেনপুরের বাসিন্দা আকমিনা নিজ বাড়ির উঠানে বসে জানালেন, তালিকায় নাম থাকার কথা জানেন। কিন্তু চাল তোলেননি।

আকমিনার স্বামী জিয়াউর রহমানও বাড়িতে ছিলেন। বললেন, তিনি হোসেনপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমানের পক্ষে নির্বাচনে কাজ করেছেন। তাই চেয়ারম্যান তাঁর স্ত্রীর নামে এই কার্ড করে দেন।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভিডব্লিউবি কার্যক্রম সারা দেশে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করছে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভোগা দুস্থ ও অতিদরিদ্রদের স্বনির্ভর করতে সহায়তার জন্য এই কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। উপকারভোগী ব্যক্তিরা ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল সহায়তা পাবেন।

পলাশবাড়ী উপজেলা ও মহিলাবিষয়ক কার্যালয়ের করা ভিডব্লিউবির চূড়ান্ত তালিকা ধরে গত ১৯ থেকে ২২ মে দৈবচয়নের ভিত্তিতে বেদকাপা, বরিশাল ও হোসেনপুর ইউনিয়নে সরেজমিনে খোঁজ করেছে।

প্রতিটি ইউনিয়নে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে সচ্ছলদের নাম বাদ দিয়ে দুস্থ নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
মো. কামরুজ্জামান, ইউএনও, পলাশবাড়ী

এতে দেখা গেছে, পলাশবাড়ীর আটটি ইউনিয়নে ভিডব্লিউবি তালিকায় জায়গা পাওয়া অনেকের অবস্থা আকমিনা বেগমের মতো। সরকারি চাকরিজীবী, পাকা বাড়ি, কয়েক বিঘা জমির মালিক ও ব্যবসায়ী পরিবার এ তালিকাভুক্ত হয়ে চাল পাচ্ছেন। বাদ পড়েছেন সংসারে সচ্ছলতা নেই এমন অনেকে।

হোসেনপুর ইউনিয়নের শালমারা গ্রামের আরজিনা পারভীনের বাবা অলিউল মন্ডল ইউপি সদস্য। আরজিনা বগুড়ায় থাকেন। স্বামী সরকারি চাকরি করেন। আরজিনার নাম কেন তালিকায় জানতে চাইলে তাঁর মা মিনা বেগম বললেন, নাজমা নামের এক নারীকে তাঁরা এই চাল দেন।

হোসেনপুর ইউনিয়নে ভিডব্লিউবির তালিকাভুক্ত ২৬৬ জন। তাঁদের মধ্যে আকমিনা বেগম বললেন, তিনি চাল তোলেননি। তাঁর কার্ড ইউপি চেয়ারম্যানের সহযোগী হেলালের কাছে।

ইউপি চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমানের দাবি, যাঁর কার্ড তাঁর কাছেই আছে। তিনি উল্টো অভিযোগ করেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ, সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যান ২৬৬ কার্ডের ৩৫ শতাংশ ভাগ নিয়েছেন।

তবে গাইবান্ধা-৩ আসনের (পলাশবাড়ী ও সাদুল্যাপুর) সংসদ সদস্য উম্মে কুলসুম স্মৃতি দাবি করেন, তিনি কোনো ভাগ নেননি। বরং উপজেলা প্রশাসনকে বলেছিলেন, প্রকৃত দরিদ্র পরিবারগুলোকে ভিডব্লিউবির কার্ড দিতে।

বেদকাপা ইউনিয়নের ডাকেরহাট গ্রামে পাশাপাশি বাড়িতে বাস করা দুই নারী রুবী বেগম ও রত্না বেগম ভিডব্লিউবি সুবিধার জন্য আবেদন করেন। রুবী বেগমের একতলা পাকা বাড়ি। স্বামী সরকারি চাকরি করেন। আবাদি জমিও আছে। অন্যদিকে রত্না বেগমের দুটি টিনের ঘর। জমি বলতে বাড়িভিটার দেড় শতক। স্বামী কাঠমিস্ত্রির কাজ করে সংসার চালান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপকারভোগীর তালিকাভুক্ত হয়েছেন রুবী বেগম। তাঁর দাবি, ইউপি চেয়ারম্যান তাঁকে এই কার্ড করে দিয়েছেন। তাঁর ‘গরিব’ ভাই এই চাল তোলেন।

একই ইউনিয়নের উপকারভোগীর তালিকায় থাকা পূর্ব নয়নপুরের রেহেনা আক্তারের বাড়ি খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, তাঁর একতলা পাকা বাড়ি। স্বামী সরকারি চাকরি থেকে কিছুদিন আগে অবসর নিয়েছেন।

এই প্রতিবেদক রেহেনার বাড়িতে থাকতেই সেখানে আসেন ওই ওয়ার্ডের গ্রাম পুলিশ আশরাফ আলী। রেহেনাকে মামি উল্লেখ করে তিনি বলেন, মামির নামে তিনিই এই চাল তোলেন।

উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বেদকাপা ইউনিয়নে ভিডব্লিউবি সুবিধাভোগী ২৯০ জন। তাঁদের মধ্যে অনুসন্ধানে অন্তত ৬০ জনকে পাওয়া গেছে, যাঁরা এই সুবিধাপ্রাপ্তির আওতায় আসার মতো নন।

পূর্ব গোপালপুর গ্রামের মোজাফফর হোসেনের ডিশের ব্যবসা আছে। তাঁর স্ত্রী মুক্তা বেগমের নামও আছে তালিকায়। প্রতিবেশীরা মোজাফফরকে বড় ব্যবসায়ী বললেন। তবে মুক্তার বাড়িতে গেলে দাবি করেন, তাঁদের জমাজমি নেই। ব্যবসা দিয়ে চলেন।

কার্ড পেতে কোনো টাকাপয়সা খরচ হয়েছে কি না, জানতে চাইলে মুক্তা বলেন, ‘চেয়ারম্যান করে দিয়েছেন। খরচ তো কিছু লাগবে।’

ভিডব্লিউবির তালিকা নিয়ে বেদকাপা ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে ৯ ইউপি সদস্যের দ্বন্দ্ব আছে। গত ডিসেম্বরে ইউপি সদস্যরা ইউএনওর কাছে অভিযোগ দেন। ইউপি সদস্যদের অভিযোগ, তাঁরা দুস্থ নারীদের তালিকা দিলেও চেয়ারম্যান সে তালিকা বাদ দিয়ে ইচ্ছেমতো তালিকা করেছেন।

মোস্তাফিজুর অবশ্য দাবি করেন, সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা সবাই উপকারভোগীদের নাম দেন। কিন্তু দোষ হয় শুধু ইউপি চেয়ারম্যানের।

পলাশবাড়ী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এ কে এম মোকছেদ চৌধুরী বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান বা সরকারি দল হিসেবে তাঁরা চেয়ারম্যানের কাছে কয়েকটি নাম সুপারিশ করেন।

বরিশাল ইউনিয়নে ২৯৩ সুবিধাভোগীর মধ্যে ৬১ জন সচ্ছল ও বিত্তশালীর পরিবারের নাম পাওয়া গেছে। তাঁদের কেউ চার-পাঁচ বিঘা জমির মালিক, কেউ সরকারি চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ী পরিবারের।

তবে ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘নীতিমালা অনুসরণ করে দুস্থ পরিবার খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই তালিকায় কিছু সচ্ছল পরিবার ঢুকে পড়েছে।’

ওই ইউনিয়নেরই ভবানীপুর গ্রামের মোরশেদা বেগম আক্ষেপ করে বললেন, ‘কী কষ্ট করে খাই। ঘরদুয়ার ঠিক নাই। কিন্তু চেয়ারম্যান, মেম্বার, অফিসারেরা এগুলো দেখে না। দালানবাড়ির মানুষ ঠিকই কার্ড পায়।’

পলাশবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান ভিডব্লিউবির তালিকার উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি। তিনি বলেন, ভিডব্লিউবির তালিকা সচ্ছল ব্যক্তিদের নাম থাকার অভিযোগ ওঠায় প্রতিটি ইউনিয়নে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে সচ্ছল ব্যক্তিদের নাম বাদ দিয়ে জুন মাসের মধ্যে দুস্থ নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.