তেল বেচে যে ৬ কোম্পানির লাভ সাড়ে ২১ হাজার কোটি ডলার

0
133
ছয়টি জ্বালানি তেল কোম্পানি ২০২২ সালে মুনাফা ২১ হাজার ৫৪০ কোটি মার্কিন ডলার

এক্সন মবিল
২০২২ সালে লাভের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তেল কোম্পানি এক্সন মবিল। কোম্পানিটি লাভ করেছে ৫৬ বিলিয়ন ডলার বা ৫ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। এটা শুধু এক্সন মবিলের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি লাভ তাই–ই নয়, বরং পশ্চিমা যেকোনো তেল কোম্পানির জন্যও এটি একটি ঐতিহাসিক রেকর্ড।

হিসাব বলছে, মার্কিন কোম্পানিটি প্রতি ঘণ্টায় ৬৩ লাখ ডলার ঘরে তুলেছে।
এক্সন এর আগে সবচেয়ে বেশি লাভ করেছিল ২০০৮ সালে। ওই বছর তাদের মুনাফা হয়েছিল সে সময়কার রেকর্ড ৪ হাজার ৫২০ কোটি ডলার। ২০০৮ সালে তেলের দাম ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ব্যারেলপ্রতি ১৪২ ডলারে উঠেছিল। ওই দাম ছিল গত বছরের গড় মূল্যের চেয়েও ৩০ শতাংশ বেশি।

গত বছর রেকর্ড ৫৬ বিলিয়ন ডলার মুনাফা করলেও এই অঙ্ক হয়তো আরও বড় হতে পারত। বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কোম্পানির ওপর উইন্ডফল কর আরোপ করার ফলে ১৩০ কোটি ডলারের লোকসান হয় বলে জানিয়েছে এক্সন। কোম্পানিটি অবশ্য এর জন্য ইইউর বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তাদের দাবি, ইইউর আইনি এখতিয়ারের বাইরে এই করারোপ করা হয়েছে।

শেল
২০২২ সালে লাভ করার তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ব্রিটিশ কোম্পানি শেল। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর তেলের উচ্চ মূল্যের ওপর ভর করে বছর শেষে এই কোম্পানি আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ মুনাফা করে, যার পরিমাণ ছিল ৪০ বিলিয়ন বা ৪ হাজার কোটি ডলার।

ব্রিটেনের করপোরেট ইতিহাসে শেলের মুনাফার এই অঙ্ককে অন্যতম বড় হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। কোম্পানিটির ১১৫ বছরের ইতিহাসে এটি ছিল সবচেয়ে বড় অঙ্কের মুনাফা। আর এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়েছে, ব্রিটেনের কোনো কোনো ট্রেড ইউনিয়ন এই মুনাফার অঙ্ককে অভিহিত করেছে ‘কদর্য’ বলে।

গত সপ্তাহে শেল এই খবর নিশ্চিত করেছে যে তারা ২০২২ সালে ব্রিটেনে মাত্র ১৩ কোটি ৪০ লক্ষ ডলার উইন্ডফল ট্যাক্স দিয়েছে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘সলিডারিটি কন্ট্রিবিউশন’–এ ৫০ কোটি ২০ লাখ ডলার পরিশোধ করেছে, যেটিকে উইন্ডফল কর হিসেবে দেখা হয়।

গত অক্টোবরে শেল তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে, যখন এটি জানায় যে ওই সময় পর্যন্ত তারা যুক্তরাজ্যে কোনো উইন্ডফল কর দেয়নি। তবে কোম্পানিটি জানিয়েছে, ২০২৩ সালে তারা সম্ভবত ৫০ কোটি ডলার কর দেবে।
২০২১ সালে শেলের লাভ ছিল ১৯ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৯০০ কোটি ডলার।

শেভরন
আমেরিকার দ্বিতীয় বড় তেল কোম্পানি শেভরন ২০২২ সালে মুনাফা করেছে ৩ হাজার ৬৫০ কোটি ডলার। মুনাফার এই অঙ্কও এই কোম্পানির জন্য একটি রেকর্ড এবং আগের বছরের লাভের অঙ্কের দ্বিগুণ।

তবে শেভরনের এই মুনাফা ওয়াল স্ট্রিটের প্রত্যাশার চেয়ে কম ছিল, বিশেষ করে চতুর্থ প্রান্তিকের আয়ে। তৃতীয় প্রান্তিকে যেখানে কোম্পানিটি মুনাফা করেছে ১ হাজার ১২০ কোটি ডলার, সেখানে বছরের শেষ তিন মাসে তাদের মুনাফা দাঁড়ায় ৬৪০ কোটি ডলার। শেভরন এর জন্য দায়ী করেছে তেল ও গ্যাসের দাম কমে যাওয়াকে।

তবে চতুর্থ প্রান্তিকের মুনাফাও তাদের আগের বছরের একই সময়ের মুনাফার চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি ছিল। শেভরন ঘোষণা করেছে যে ৭ হাজার ৫০০ কোটি ডলার খরচ করে তারা তাদের শেয়ারবাজার থেকে কিনে নেবে।

টোটালএনার্জি
বড় পরিমাণ মুনাফা করেছে ফরাসি কোম্পানি টোটালএনার্জি। ২০২২ সালে তাদের লাভের পরিমাণ ৩ হাজার ৬২০ কোটি ডলার এবং এটি কোম্পানির জন্য একটি রেকর্ড।

কোম্পানির প্রধান নির্বাহী প্যাট্রিক পুয়েন বলেছেন, জ্বালানি খাতের কোম্পানিগুলোর জন্য পুরো বিশ্বের পরিস্থিতি অত্যন্ত অনুকূলে রয়েছে, সঙ্গে যোগ হয়েছে চীনে কোভিড বিধিনিষেধ শিথিল করার ব্যপারটি, ফলে জ্বালানির চাহিদা বেড়েছে।

তবে কোম্পানিটি আগেই জানিয়েছে যে উইন্ডফল কর দিতে তারা চতুর্থ প্রান্তিকের জন্য ১৭০ কোটি ডলার আলাদা করে রেখেছে। এ ছাড়া টোটালএনার্জি ২০২৩ সালে ১৬০০–১৮০০ কোটি ডলার বিনিয়াগ করতে প্রত্যাশা করছে, যার মধ্যে ৫০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ হবে স্বল্প কার্বনযুক্ত জ্বালানিতে।

বিপি
আরেক ব্রিটিশ কোম্পানি বিপি (যেটি একসময় বেশি পরিচিত ছিল ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম নামে) ২০২২ সালে রেকর্ড পরিমাণে লাভ করে। তাদের লাভের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। এর আগে বিপির সবচেয়ে মুনাফা ছিল ২০০৮ সালে, ২ হাজার ৬০০ কোটি ডলার।

কিন্তু বিপির বিশাল মুনাফার ঘোষণা অন্য একটি কারণে জলবায়ু আন্দোলনকারীদের ক্ষুব্ধ করেছে। বিপি এর আগে পরিকল্পনা করেছিল যে তারা তেল ও গ্যাসের উৎপাদন ধীরে ধীরে কমিয়ে আনবে। কিন্তু কোম্পানিটি এখন বলেছ, ২০৩০ সাল নাগাদ তারা প্রতিদিন ২০ লাখ ব্যারেল তেলের সমপরিমাণ জ্বালানি উৎপাদন করবে। এই পরিমাণ ২০১৯ সালের তাদের উৎপাদনের তুলনায় মাত্র ২৫ শতাংশ কম। আগের পরিকল্পনা ছিল ৪০ শতাংশ উৎপাদন কমানো।

তিন বছর আগে বার্নার্ড লুনি বিপির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব নিয়ে বলেছিলেন যে তেল–গ্যাস থেকে তারা নবায়নযোগ্য ও কম কার্বনযুক্ত জ্বালানির দিকে যাবে। কোম্পানি এখন বলছে, এই দুই খাতে তারা প্রতিবছর আরও ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে।

কনোকোফিলিপস
মার্কিন কোম্পানি কনোকোফিলিপস ২০২২ সালে মুনাফা করেছে ১ হাজার ৮৭০ কোটি ডলার, যা গত বছরের দ্বিগুণ। ২০১২ সালের পর এটি ছিল তাদের সবচেয়ে বেশি মুনাফা।

এই কোম্পানির লাভের গল্প একই। অপরিশোধিত তেলের দামে বড় রকমের লাফ, যা ছিল মহামারির পর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরুর কারণে জ্বালানির চাহিদা বেড়ে যাওয়া এবং রাশিয়ার ইউক্রেন হামলার ফলাফল।

কনোকোফিলিপস যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য আলাস্কায় সবচেয়ে বড় অপরিশোধিত তেলে উৎপাদনকারী কোম্পানি। তাদের হাতে রয়েছে সেখানকার সবচেয়ে বেশি তেলক্ষেত্র।

জাতিসংঘ মহাসচিবের সমালোচনা

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জ্বালানি কোম্পানিগুলোকে উদ্দেশ্য করে বেশ জ্বালাময়ী এক বক্তব্য দিয়েছেন। ২০২৩ সালে তাঁর অগ্রাধিকার সম্পর্কে দেওয়া এক বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আপনাদের মূল পণ্য হলো আমাদের মূল সমস্যা। আমাদের  প্রয়োজন নবায়নযোগ্য পণ্যের বিপ্লব, আত্মঘাতী জীবাশ্ম জ্বালানির পুনরুত্থান নয়।’

জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদকদের মুনাফাকে ‘দানবীয়’ হিসেবে বর্ণনা করে আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘আপনারা যদি কার্বন নিসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার উদ্দেশ্যে ২০২৫ ও ২০৩০ সালের জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে না পারেন, আপনাদের এই ব্যবসায় থাকা উচিত নয়।’

বিশ্বের দেশগুলো কার্বন নিসরণ ২০৩০ সালে অর্ধেক এবং ২০৫০ সালে শূন্যে বা নিট–জিরোতে নামিয়ে আনতে চাপে রয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.