তিন বিয়ে, ত্রিভুজ প্রেম আর ভণ্ড কবিরাজির খেল

খুলনায় যুবক হত্যার নেপথ্যে যত কাণ্ড

0
95
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)

খুলনায় তিন বছর আগে রবিউল মোল্যা নামে এক যুবকের হাত-পা বাঁধা লাশ মিলেছিল নিজ ঘরে। গলায় ছিল শ্বাসরোধের চিহ্ন। আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল গোলাপজলের বোতল, আগরবাতি ও কালো সুতা। তবে কে বা কারা কেন তাঁকে হত্যা করেছে, তা উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হয় পুলিশ। চার তদন্ত কর্মকর্তার হাত ঘুরে অবশেষে জট খুলেছে খুলনার তেরখাদার ওই হত্যা রহস্যের।

সবশেষ এ মামলার তদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ছিল ত্রিভুজ প্রেম ঘিরে জটিলতা, তিন বিয়ে আর ভণ্ড কবিরাজের কারসাজি। রবিউলের দ্বিতীয় স্ত্রী শামীমা ওরফে পুঁটি এবং তাঁর তৃতীয় স্বামী ইশারত শেখের পরিকল্পনায় ঘটে হত্যাকাণ্ড। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হচ্ছে। আর তদন্তে সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায় রবিউলের প্রথম স্ত্রীসহ ৯ জনকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা হয়েছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই খুলনার এসআই নয়ন চট্টোপাধ্যায় বলেন, বহুমুখী সম্পর্কের জটিলতায় ঘেরা এ হত্যার জট খুলেছে ধাপে ধাপে। একটি সূত্র ধরে এগিয়ে যেতেই মিলেছে পরের সূত্র। শেষ ধাপে এসে দেখা যায়, ঘটনায় জড়িত নিহত যুবকের দ্বিতীয় স্ত্রী। তাঁকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে পুরো বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।

তদন্ত সূত্র জানায়, রবিউল কখনও বিক্রয়কর্মী, আবার কখনও শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। তিনি মাঝেমধ্যে ঢাকায় এসে থাকতেন। প্রথম স্ত্রী সালমা বেগম ওরফে বালিনার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো ছিল না। এক পর্যায়ে শ্যালকের স্ত্রী শামীমার সঙ্গে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরে তারা বিয়ে করে ঢাকায় সংসার পাতেন। তবে কিছুদিন পর তাদের মধ্যে বাগ্‌বিতণ্ডা ও মনোমালিন্য হলে রবিউল ফেরেন প্রথম স্ত্রীর কাছে।

এদিকে একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যান শামীমার ভাই মিকাঈল। সেখানে তাঁর সঙ্গে আরেক কারাবন্দি ইশারত শেখের পরিচয় এবং সখ্য গড়ে ওঠে। জামিন পাওয়ার পর মিকাঈলের বাসায় গেলে ইশারত ও শামীমার পরিচয় এবং ফোন নম্বর বিনিময় হয়। কথোপকথনে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছে জানালেও দ্বিতীয় বিয়ের কথা চেপে যান শামীমা। এর মধ্যে রবিউল আবারও কথা বলে শামীমাকে ঢাকায় নিয়ে যান। দেড় মাস পর ফের তাদের মধ্যে ঝগড়া হলে শামীমা নড়াইলের নড়াগাতিতে বাবার বাড়িতে ফেরেন। এর পর ইশারতের সঙ্গে ফের কথোপকথন শুরু হয়। কিছু দিন পর ঢাকায় এসে তারা বিয়ে করেন।

এর মধ্যে বিয়ের কথা জানতে পেরে শামীমাকে ফোন করেন রবিউল। কথোপকথন শুনে ইশারত স্ত্রীর আগের সম্পর্কের কথা জানতে পেরে তাঁকে মারধর করেন। এতে রাগ করে শামীমা বাবার বাড়িতে চলে যান। সেখানে থেকে তিনি রবিউল ও ইশারত দু’জনের সঙ্গেই ফোনে কথা চালিয়ে যান। এর পর আবার ঢাকায় রবিউলের কাছে ফেরেন। তখন ইশারত তাঁকে কল করলে তা রিসিভ করেন রবিউল। তিনি শামীমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে নিষেধ করলে ক্ষিপ্ত হন ইশারত। এর মধ্যে রবিউলের সঙ্গে শামীমার আবারও কলহ হয় এবং তিনি ফিরে যান। এর পর ইশারতের সঙ্গে কথা বলে রবিউলকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।

পিবিআই সূত্র জানায়, পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইশারত কবিরাজ পরিচয়ে রবিউলের শ্যালক মোজাহিদকে ফোন করে বলেন, শামীমা তাঁর কাছ থেকে তন্ত্রমন্ত্রের ‘তদবির’ নিয়ে রবিউলকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়েছে। এ বিষয়ে তিনি অনুতপ্ত। তাঁর পরামর্শ মেনে চললে রবিউল ও তাঁর বোনের (প্রথম স্ত্রী সালমা) সম্পর্ক আবার ঠিক হয়ে যাবে। পরে তিনি সালমার সঙ্গে দেখা করে একটি ওষুধ (ইঁদুর মারার বিষ) দেন। ২০২০ সালের ২৩ জুন ঘটনার দিন ইশারতের পরামর্শে কবিরাজি ওষুধ ভেবে স্বামীকে বিষ খাওয়ান সালমা। রবিউল অচেতন হয়ে পড়লে কবিরাজবেশী ইশারত ওই বাড়িতে যান। তিনি বিষ মেশানো কোমল পানীয় বাড়িতে উপস্থিত সবাইকে খেতে দেন। কিছুক্ষণ পর তারাও অচেতন হয়ে পড়লে গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে রবিউলকে হত্যা করে পালিয়ে যান।

ইন্দ্রজিৎ সরকার

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.