তালগোল

0
86
বজ্রপাত

বজ্রপাতে মৃত্যু প্রতিরোধের নামে গৃহীত পরিকল্পনাহীন সরকারি প্রকল্পসমূহ লইয়া শুক্রবার প্রতিবেদনে যাহা বলা হইয়াছে, তাহাতে সচেতন মানুষমাত্রই উদ্বিগ্ন না হইয়া পারিবেন না। প্রতিবেদন অনুসারে, মৃত্যুর সংখ্যা বিচার করিয়া সরকার ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ বলিয়া ঘোষণা দেয়। ঐ ঘোষণার পর পর বজ্রপাতে মৃত্যু প্রতিরোধে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সমগ্র দেশে ১০ লক্ষ তালগাছের চারা এবং ৩৫ লক্ষ তালের আঁটি রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত প্রকল্পটির অধীনে প্রায় শতকোটি টাকা গচ্চা যাইবার পর মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বলিয়াছেন, ‘একটি তালগাছ বড় হইতে ৩০-৪০ বৎসর সময় লাগে।’ অতএব প্রকল্পটি তাঁহাদের নিকট গ্রহণযোগ্য সমাধান বলিয়া বিবেচিত নহে।

উল্লেখ্য, মন্ত্রণালয়ের তথ্যই বলিতেছে, এক যুগে দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা তিন সহস্রে পৌঁছিয়াছে। অধিকন্তু প্রকাশিত সংবাদের তথ্যোনুযায়ী, বৃহস্পতিবার অবধি এ বৎসরের প্রথম চার মাসে এহেন অপঘাতে প্রাণ হারাইয়াছেন ৮৯ জন। শুধু বৃহস্পতিবারেই বজ্রপাতে ছয় জেলায় আটজনের জীবনপ্রদীপ নিভিয়াছে এবং গত ২৩ এপ্রিল এক দিনেই একই কারণে ১০ জনের মৃত্যু হয়। বজ্রপাতে মৃত্যুবরণকারীর মধ্যে অনেকেই আছেন যাঁহারা তাঁহাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন। ফলে জরুরি ভিত্তিতে এই মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করিতে না পরিলে শুধু সংশ্লিষ্ট পরিবারসমূহই অসহায় হইবে না; বহু প্রকার সামাজিক সংকটও উদ্ভূত হইতে পারে, যাহা চূড়ান্ত বিচারে রাষ্ট্রেরই শিরঃপীড়ার উদ্রেক করিবে।

মৃত্যু ঠেকানোর উদ্যোগ প্রকল্পেই ঘুরপাক

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক, সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাসমূহ তালগাছ প্রকল্পের ব্যর্থতা হইতে শিক্ষা গ্রহণ করিয়াছে বলিয়া অনুমিত নহে। কারণ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে হাওরাঞ্চলের বজ্রপাতপ্রবণ ২৩ জেলায় বজ্রনিরোধক দণ্ডসহ বজ্রপাত-নিরোধক কংক্রিটের ছাউনি নির্মাণ করিতেছে কোনো প্রকার সমীক্ষা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ব্যতিরেকেই। শুধু উহাই নহে, একই বজ্রনিরোধক দণ্ড কৃষি মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার বিভাগও পৃথক প্রকল্পের অধীনে একই হাওরাঞ্চলে স্থাপনের প্রকল্প গ্রহণ করিয়াছে। যাহার ফলে কোষাগার হইতে অতিরিক্ত কয়েক শত কোটি টাকা ব্যয় হইবে।

বলা বাহুল্য হইবে না, ২০১৭ সালে বজ্রপাতের পূর্বাভাস জানিতে ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের আট স্থানে স্থাপন করা হয় লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর- এলডিএস; যাহার মাধ্যমে ১৫ মিনিট পূর্বেই সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষকে বজ্রপাতের তথ্য জানাইবার কথা থাকিলেও বাস্তবে উহা ক্রিয়া করে নাই। সম্প্রতি বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার সহযোগিতায় বজ্রপাত সম্পর্কে ৫৪ ঘণ্টা পূর্বে তথ্য পাইতে ‘হাই ইমপ্যাক্ট ওয়েদার অ্যাসেসমেন্ট’ নামে একটি প্রযুক্তি চালু করে, যাহার কার্যকারিতা লইয়া বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠিয়াছে।

সমীক্ষাবিহীন এই সকল প্রকল্প প্রকৃতপক্ষে বজ্রপাত প্রতিরোধের নামে সরকারি অর্থ শ্রাদ্ধের আয়োজন মাত্র– এমনটা কেহ বলিলে খুব ভুল হইবে বলিয়া মনে হয় না। ‘সরকার কা মাল দরিয়া মে ঢাল’– প্রবাদ তো আর অযথাই চালু হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন হইল, একটা প্রকল্প প্রস্তাব প্রস্তুতের পর চূড়ান্ত হইবার পূর্ব পর্যন্ত একাধিক সংস্থা কর্তৃক উহা যাচাই-বাছাই হইবার কথা। এই সকল প্রকল্পে জনগণের কষ্টার্জিত এত অর্থ ব্যয়ের পূর্বে পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা কাহারও মস্তিষ্কে আসিল না?

আমাদের ধারণা, জনগণের অর্থের প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে ন্যূনতম দরদ নাই বলিয়াই এহেন ঘটনা ঘটিয়াছে। আমরা মনে করি, অবিলম্বে শুধু বজ্রপাত নিরোধের নামে গৃহীত প্রকল্পসমূহ বাতিল করিয়া উপযুক্ত সমীক্ষার ভিত্তিতে নূতন প্রকল্প গ্রহণ নহে; ব্যর্থ প্রকল্পসমূহের জন্য যাঁহারা দায়ী, তদন্তপূর্বক তাঁহাদের শাস্তির আওতায় আনা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একমাত্র এ প্রক্রিয়াতেই সরকারি সংস্থাসমূহে জনগণের অর্থের সর্বোত্তম ব্যবহারের সংস্কৃতি চালু করা যাইতে পারে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.