ডেঙ্গু রোগীর চাপ সামলাতে পারছে না মুগদা হাসপাতাল

0
110
ডেঙ্গু রোগীদের মেঝেতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা, ১৮ জুলাই

রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি ৫০০ শয্যার। অথচ সেখানে ভর্তি আছেন ১ হাজার ২০৯ জন। এর মধ্যে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাই হাসপাতালটির মোট শয্যাসংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে। আজ মঙ্গলবার পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগী আছেন ৫৪০ জন। বিপুল রোগীর চাপ সামলাতে চিকিৎসক আর নার্সরা হিমশিম খাচ্ছেন। এ কারণে ভালো চিকিৎসার পরিবেশ বজায় নেই হাসপাতালটিতে।

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মো. নিয়াতুজ্জামান আজ বললেন, প্রতি ঘণ্টায় নতুন ডেঙ্গু রোগীর চাপ বাড়ছে। ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হওয়া ৫৪০ জনের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ৪১৭ জন এবং শিশু ১২৩টি। চলতি মাসে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১৬ জন ডেঙ্গু রোগী মারা গেছেন। গত মাসে (জুন) মারা গেছেন ১৫ জন। নতুন রোগী তাঁরা আর নিতে পারছেন না। কিন্তু রোগী আসার কমতি নেই।

আজ সরেজমিনে দেখা যায়, মুগদা হাসপাতালের তৃতীয় তলায় নারী, অষ্টম তলায় শিশু এবং নবম ও দশম তলায় পুরুষ ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা চলছে। ওয়ার্ডের ভেতরে জায়গা নেই। সামনের বারান্দা ও খোলা জায়গা দিয়ে সারি করে বিছানা পাতা হয়েছে। ছাদে অনেক দূরে দূরে লাগানো ফ্যান ঘুরতে থাকলেও বহু লোকের উপস্থিতিতে পরিবেশে ভ্যাপসা গরম। সবাই হাতপাখা দিয়ে বাতাস নিচ্ছেন।

এক–দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতিটি বিছানায় রোগীর মাথার কাছে স্যালাইন ঝোলানোর স্ট্যান্ড থেকে ঝুলছে স্যালাইনের ব্যাগ। রোগীর সঙ্গে আছেন তাঁদের আত্মীয়স্বজন। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের সঙ্গে মা–বাবাসহ একাধিক লোক আছেন দেখভাল করার জন্য। ফলে ওয়ার্ডগুলোতে বলতে গেলে পা ফেলার জায়গা নেই। দুই সারি বিছানার মাঝখান দিয়ে জমির আলের মতো একচিলতে সরু জায়গা। সেখান দিয়েই চিকিৎসক-নার্সদের চলাচল করতে হচ্ছে। নির্ধারিত জায়গার পাশাপাশি ওয়ার্ডের ভেতর সুবিধামতো জায়গায় টেবিল পেতে তার ওপর স্যালাইনের ব্যাগের স্তূপ সাজিয়ে বসেছেন অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে আসা নার্সরা।

ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে নতুন রোগী আসছে। ব্যস্ততা বাড়ছে নার্সদের। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা, ১৮ জুলাই
ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে নতুন রোগী আসছে। ব্যস্ততা বাড়ছে নার্সদের। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা, ১৮ জুলাই

মুগদা হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য আলাদা কোনো ওয়ার্ড নেই। বাড়তি রোগীর চাপ সামলানোর জন্য চারটি তলায় সুবিধামতো জায়গায় ডেঙ্গু রোগীদের শয্যা পাতা হয়েছে। তৃতীয় তলায় নারীদের ওয়ার্ডে কথা হলো আসমা খাতুনের (৩২) সঙ্গে। পাঁচ দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি আছেন তিনি। বাসা রাজধানীর গোড়ানে। স্বামী প্রবাসী। তাই সঙ্গে মা আর ছোট বোন এসেছেন।

আসমা খাতুন জানালেন, তাঁর জ্বর কমে গেছে। তবে মঙ্গলবার আলট্রাসনোগ্রাম করে জানতে পেরেছেন, ফুসফুস ও পেটে পানি জমেছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, অবস্থা সুবিধার নয়, সারতে সময় লাগবে। অথচ এখানে থাকতে খুব সমস্যা, পরিবেশ ভালো নয়। কিন্তু নিরুপায় হয়ে থাকতেই হচ্ছে।

শিশুদের ওয়ার্ডে পূর্ব জুরাইনের সাফিয়া নুসরাত (১৩) ও আয়েশা ইসলাম (৩) দুই বোনের চিকিৎসা চলছে। তাদের মা তানিয়া আক্তার মেয়েদের নিয়ে গত রোববার রাতে হাসপাতালে এসেছেন। মেয়েদের অবস্থার তেমন বিশেষ উন্নতি হচ্ছে না। বললেন, খুবই দুশ্চিন্তায় আছেন।

পাশের বিছানায় সরকারি আইডিয়াল স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র এরফান ইসলামের স্যালাইন চলছিল। তার বাবা জসিমউদ্দিন বলেন, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর পাঁচ দিন গেছে। জ্বর কমলেও রক্তে অণুচক্রিকা (প্লাটিলেট) বাড়ছে না। এখানে চিকিৎসায় প্রতিদিন তিন ব্যাগ স্যালাইন দেওয়া হয়। তবে সব ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়। এরই মধ্যে ২৩ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। ছেলে অসুস্থ হওয়ায় সপ্তাহখানেক হলো ব্যবসা বন্ধ। অন্য কোথাও চিকিৎসা করানোর মতো আর্থিক সামর্থ্য নেই। তাই কষ্ট হলেও এই সরকারি হাসপাতালই শেষ ভরসা।

ডেঙ্গু নিয়ে পুরুষ ওয়ার্ডে ভর্তি হওয়া রাকিব হোসেন জানালেন, তিনি হাসপাতালে এসেছেন বৃহস্পতিবার। থাকেন গোড়ান এলাকায়। সেখানে প্রায় প্রতিটি ঘরে ডেঙ্গু রোগী।

হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের নমুনা সংগ্রহ কেন্দ্রের সামনে লম্বা লাইন দেখা গেল। রক্তের নমুনা দিতে এসেছেন মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি নিজেই রোগী। বেলা দেড়টার দিকে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তখনো তাঁর সামনে অনেকে দাঁড়িয়ে। তিনি জানালেন, গুরুতর রোগীদের ওয়ার্ডে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু কখন নেওয়া হবে, সময়ের কোনো ঠিক নেই। তাই বেশির ভাগ রোগী নিজেরাই দোতলায় এসে লাইনে দাঁড়ান। এখানেও এক থেকে দুই ঘণ্টা সময় লেগে যায় রক্তের নমুনা জমা দিতে।

হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের সামনে রক্ত পরীক্ষা করার জন্য আসা রোগীদের ভিড়। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা, ১৮ জুলাই
হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের সামনে রক্ত পরীক্ষা করার জন্য আসা রোগীদের ভিড়। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা, ১৮ জুলাই

চিকিৎসার মান ও রোগীদের ভোগান্তির বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক মো. নিয়াতুজ্জামান বললেন, হাসপাতালের ধারণক্ষমতা ও লোকবলের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি রোগী। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য নতুন করে কোনো লোকবল পাননি। চিকিৎসক ও নার্সদের নির্ধারিত কাজের পাশাপাশি ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য আলাদা অতিরিক্ত রুটিন করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। প্যাথলজিতে প্রতিদিন ৩০০ জনের পরীক্ষার সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু এখন আট শতাধিক রোগীর নমুনা পরীক্ষা করতে হচ্ছে।

এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে হাসপাতালের পরিচালক বললেন, রোগটি আগের চেয়ে জটিল ও মারাত্মক হয়ে উঠেছে। প্লাটিলেট কমে যাওয়ার পাশাপাশি রোগীদের বুকে ও পেটে পানি জমা, খিঁচুনি, বমি, মাথায় যন্ত্রণার মতো সমস্যা হচ্ছে। অনেক সময় এসব উপসর্গ থাকে কিন্তু জ্বর থাকে না। এতে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীরা যথাযথ চিকিৎসা নেন না। জটিল পরিস্থিতিতে হাসপাতালে আসেন। ফলে চিকিৎসা জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি হচ্ছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.