ডলার–সংকট: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন সিদ্ধান্ত কতটা কাজে আসবে

0
98
ডলার

দেড় বছর ধরে চলা ডলার–সংকট এখনো কাটেনি। দাম বাড়লেও চাহিদামতো ডলার পাওয়া যাচ্ছে না ব্যাংকে। সংকট কাটাতে এবার বেশ কিছু নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে রয়েছে রপ্তানিকারকদের প্রত্যাবাসন কোটা (ইআরকিউ) অর্ধেক নামিয়ে আনা ও ডলারের ভবিষ্যৎ দাম (ফরওয়ার্ড রেট) নির্ধারণ করে দেওয়া।

এর পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক বার্তা দিয়েছে, যেকোনো নিয়ম ভঙ্গের দায়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ফলে ১০টি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তারা এখন শাস্তির মুখে। একই সঙ্গে শীর্ষ ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, আর্থিক খাতে সংকট আরও বেড়ে যেতে পারে—এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না। তাই ধীরে ধীরে ডলারের দাম বাড়ানো ছাড়া জাতীয় নির্বাচনের আগে বড় কোনো সংস্কার বা পদক্ষেপ নেওয়া হবে না।

ফলে চলমান ডলার–সংকট কবে কাটবে, কেউই তা বলতে পারছে না। ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা ডলারের মজুতও কমে আসছে। ডলারের সংকট রয়েছে খোলা বাজারেও, সেখানে দাম উঠেছে ১১৭ টাকা।

নির্ধারণ হলো ডলারের ভবিষ্যৎ দাম

ডলার
ডলার, ছবি: সংগৃহীত

যেসব পদক্ষেপ বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়েছে, তার একটি ডলারের ভবিষ্যৎ দাম (ফরওয়ার্ড রেট) নির্ধারণে নতুন নিয়ম চালু। এ জন্য বেঁধে দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ হারও। নতুন নিয়মে এক বছর পর ব্যাংক ডলারের দাম হিসেবে বর্তমান স্মার্ট হারের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত নিতে পারবে। গত রোববার এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই নিয়ম চালু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

যে পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে এখন ঋণের সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে, সেটি পরিচিত স্মার্ট বা সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল হিসেবে। প্রতি মাসের শুরুতে এই হার জানিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। জুলাইয়ে স্মার্ট রেট ছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। আগস্টে তা বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ, যা চলতি সেপ্টেম্বরেও অপরিবর্তিত রয়েছে।

ফলে কেউ এখন ভবিষ্যতের জন্য ডলারের বুকিং দিয়ে রাখলে তাঁকে এক বছর পর প্রতি ডলারে ১২৩ টাকা ৯১ পয়সা পরিশোধ করতে হবে। আর এক বছরের কম সময়ের জন্য ডলারের দাম মাসের আনুপাতিক হারে নির্ধারণ হবে। বর্তমানে আমদানিতে ডলারের দাম ১১০ টাকা ৫০ পয়সা।

আমদানিকারকদের কাছে বেশি দামে ডলার বিক্রির অভিযোগে বেসরকারি খাতের ১০ ব্যাংককে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক এই নতুন নিয়ম চালু করল। এসব ব্যাংকের কয়েকটি জানিয়েছে, ডলারের ভবিষ্যৎ দাম হিসেবে তারা আমদানিকারকদের কাছ থেকে বেশি দাম রেখেছিল।

সাধারণত বহুজাতিক কোম্পানি (এমএনসি) ও বাণিজ্যনির্ভর উদ্যোক্তারা ভবিষ্যৎ আমদানির জন্য ডলার বুকিং দিয়ে থাকেন। নতুন নিয়মের ফলে এই ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন। অন্যদিকে ব্যাংকগুলো মনে করে, ঝুঁকি প্রিমিয়াম ছাড়াই হার নির্দিষ্ট হওয়ায় তাদের ঝুঁকি বাড়বে। আগে ব্যাংক–গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ডলারের দাম নির্ধারিত হতো।

ডলারের বাজার পরিস্থিতি

অর্ধেক কমল ইআরকিউ

বাংলাদেশ ব্যাংক আরেকটি পদক্ষেপে রপ্তানিকারকের রিটেনশন কোটা (ইআরকিউ) হিসাবে জমাকৃত বৈদেশিক মুদ্রার সীমা অর্ধেক করে দিয়েছে। এর ফলে রপ্তানি আয়ের বড় অংশই এখন থেকে নগদায়ন করে ফেলতে হবে। এ কারণে ব্যবসায়ীরা নিজেদের হিসাবে ডলার কম রাখতে পারবেন। ফলে বাজারে ডলারের প্রবাহ বাড়বে।

প্রচলিত ব্যবস্থায় প্রত্যাবসিত রপ্তানি আয়ের নির্দিষ্ট অংশ ইআরকিউ হিসেবে জমা রাখা যায়। স্থানীয় মূল্য সংযোজনের মাত্রা অনুযায়ী, রিটেনশন কোটার হার ১৫ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। শুধু তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এই হার ৭০ শতাংশ। নতুন প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী খাত ভেদে রপ্তানিকারকেরা তাঁদের আয় করা ডলারের ৭ দশমিক ৫, ৩০ ও ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত নিজেদের কাছে রাখতে পারবেন।

দাম বাড়ল

এদিকে আবারও ডলারের দর বাড়িয়েছে দেশের ব্যাংকগুলো। এবার সব ক্ষেত্রেই ৫০ পয়সা করে বাড়ানো হয়েছে ডলারের দর। ফলে এখন থেকে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে ডলারের দর ৫০ পয়সা বেড়ে হয়েছে ১১০ টাকা আর আমদানিতে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। গত রোববার বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) বৈঠকে ডলারের এই নতুন দর নির্ধারিত হয়। এই দাম কার্যকর হয়েছে গতকাল সোমবার থেকে।

গত রোববার বেসরকারি খাতের শীর্ষ পর্যায়ের পাঁচটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) সঙ্গে এক সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার জানিয়ে দিয়েছেন, এখন যেভাবে ডলার পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা চলছে, সেভাবেই চলতে থাকবে। তবে সময়ে সময়ে ডলারের দামে যেভাবে পরিবর্তন আনা হচ্ছে, সেই ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে।

সমাধান কিসে

বাংলাদেশ ব্যাংক অসন্তষ্ট হবে এই ভয়ে ব্যাংকের কর্মকর্তারা ডলারের বাজার নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করতে চান না। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জানিয়েছেন, দেশ থেকে অর্থ পাচার বন্ধ হয়নি। অন্যদিকে, বৈদেশিক মুদ্রার বাজার স্বাভাবিক করতে যেসব সংস্কার করা প্রয়োজন ছিল, সেগুলো করা হয়নি। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগগুলো কাজে আসছে না।

তবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও আমদানি করা পণ্যের দাম যাচাইয়ের কাজটি নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি ভালোভাবে করছে বলে মনে করেন এই দুই এমডি।

অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেওয়া উদ্যোগ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, অগ্রিম ডলার কেনা ও বিক্রির সুবিধা আগে এক বছর মেয়াদি ছিল না, এখন চালু করা হলো। এটা ভালো উদ্যোগ। তবে দাম নির্ধারণ না করে দিয়ে এটা বাজারভিত্তিক হওয়া উচিত।

ইআরকিউয়ের সীমা কমিয়ে দেওয়ার বিষয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এতে করে বাজারে তাৎক্ষণিকভাবে ডলারের সরবরাহ বাড়বে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এই পদক্ষেপ ভালো হবে না। নিজের কাছে ডলার কম রাখতে পারলে অনেকেই রপ্তানি আয় দেশে আনা কমিয়ে দিতে পারে। এতে অর্থ পাচারও বাড়তে পারে।

ডলারের দাম ও সংকট থেকে বের হওয়া প্রসঙ্গে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডলারের দাম এখনো বাজারভিত্তিক হচ্ছে না। ধীরে ধীরে বাড়িয়ে তা বাজারভিত্তিক করতে হবে। যে ধরনের সংস্কার কার্যক্রম নেওয়া প্রয়োজন, তা–ও নেওয়া হচ্ছে না। ফলে উদ্যোগগুলোর সুফল মিলছে না। এখন সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়ে, বাজেট ভর্তুকি ও সরকারি খরচ কমিয়ে সংকটের সমাধান করতে হবে। অর্থ পাচার কমাতে শাস্তি দিতে হবে। এসব না করলে সংকট থেকে বের হতে আরও দীর্ঘ সময় লাগবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.