ডলারের আধিপত্য চ্যালেঞ্জের মুখে

0
93
ডলার

যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের মোট অর্থনীতির প্রায় ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তবে বিশ্বের মোট বৈশ্বিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং বাণিজ্যের অর্ধেকেরও বেশি পরিচালিত হয় মার্কিন ডলারে। বোঝাই যাচ্ছে, বিশ্ব অর্থনীতিতে ডলার কতটা শক্তিশালী।

বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলার বিনিয়োগকারীদের জন্য কয়েক দশক ধরে পছন্দের শীর্ষে। কিন্তু এটি এখন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে।

বিমান কিংবা তেল কেনা থেকে ঋণ নেওয়াসহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং বৈশ্বিক অর্থায়নের ক্ষেত্রে প্রায় সবকিছুর জন্য মার্কিন মুদ্রা গ্রিনব্যাককে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল অর্থনীতি, বিশেষ করে চীন মার্কিন মুদ্রার ওপর অত্যধিক নির্ভরতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল পলিসি ইনস্টিটিউটের ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক্সের অধ্যাপক পাওলা সুবাচ্চি এএফপিকে বলেছেন, ‘অনেক উন্নয়নশীল দেশের ডলারের ওপর কম নির্ভরশীল হওয়ার ইচ্ছা আছে, বিশেষ করে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে।’

চলতি মাসে চীন সফরকালে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইস ইনাসিও লুলা দা সিলভা বলেছেন, প্রতি রাতে তিনি নিজেকে প্রশ্ন করেন– ‘কেন সব দেশ ডলারের ওপর ভিত্তি করে বাণিজ্য করতে বাধ্য হয়?’ এর আগে তিনি বেইজিংয়ের সঙ্গে ইউয়ান এবং রিয়ালে লেনদেন করার চুক্তি করেন।

বাংলাদেশ সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৩০ কোটি ডলার সমান অর্থ রাশিয়াকে পরিশোধ করবে চীনের ইউয়ানে। ফ্রান্সের টোটাল এনার্জি থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনার জন্য নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহার করবে বাংলাদেশ।

চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের দাম ডলারের পরিবর্তে ইউয়ানে পরিশোধ করবে আর্জেন্টিনা। লাতিন আমেরিকার দেশটিতে ডলারের রিজার্ভ প্রকটভাবে কমে যাওয়ায় এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আর্জেন্টিনা সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়, এপ্রিল মাসে তারা ১০০ কোটি মার্কিন ডলার সমমূল্যের চীনা পণ্যের আমদানি মূল্য ডলারের পরিবর্তে ইউয়ানে পরিশোধের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। তারপর থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৭৯ কোটি মার্কিন ডলার সমমূল্যের পণ্য আমদানি মূল্য ইউয়ানে পরিশোধ করা হবে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত ডলার যুক্তরাষ্ট্রকে বড় প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা দেয়। উদীয়মান এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো মার্কিন মুদ্রার গতিবিধির ওপর নির্ভরশীল। এটা তাদের আমদানি এবং রপ্তানি মূল্যকে প্রভাবিত করে। ডলার নির্ধারিত ঋণের সুদকেও প্রভাবিত করে মার্কিন মুদ্রা। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ডলারের আধিপত্য আলোচনায় এসেছে। বিশ্ব দেখেছে ওয়াশিংটন এবং পশ্চিমা দেশগুলো মস্কোর ওপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার ক্ষেত্রে ডলারের আধিপত্যের সুযোগ নিচ্ছে।

শেনজেনভিত্তিক ফার্স্ট সিফ্রন্ট ফান্ড ম্যানেজমেন্টের প্রধান অর্থনীতিবিদ ল্যারি ইয়াং এএফপিকে বলেছেন, ‘রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ডলারের আধিপত্যকে ব্যবহার করেছে। অন্যান্য দেশও উদ্বিগ্ন যে তারাও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার শিকার হতে পারে। তাই তারা অর্থ প্রদান এবং নিষ্পত্তির জন্য অন্য মুদ্রা বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ তিনি বলেন, এই পরিবর্তন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের স্থিতিশীলতার জন্য ভালো এবং এটি অবশ্যই একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতা।

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীন কয়েক বছর ধরে তার মুদ্রার আন্তর্জাতিকীকরণ করছে। তবে সেই মুদ্রা এখনও চীনা কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে।

অর্থনীতিবিদ ল্যারি ইয়াং বলেন, চীনা ইউয়ানের (আরএমবি নামেও পরিচিত) আন্তর্জাতিকীকরণের অর্থ ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক চুক্তির জন্য আরও বেশি দেশের মুদ্রা বেছে নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হওয়া। চীনের ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক বাণিজ্যের ফলে আরএমবির আন্তর্জাতিকীকরণের মাত্রা বাড়বে এবং আরও ব্যবসায়িক অংশীদার আরএমবিকে অর্থ প্রদান এবং নিষ্পত্তির জন্য বেছে নেবে।

তবে সাও পাওলোর টেনডেনসিয়াস কনসাল্টোরিয়া কনসালট্যান্সির অর্থনীতিবিদ আলেসান্দ্রা রিবেইরো বলেছেন, ডলারের বিপরীতে প্রস্তাবগুলো প্রায়ই অর্থনীতির চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। যেমন চীনের পূর্ণ বাজার অর্থনীতি নেই। আরএমবি সরকারের স্বার্থের ওপর নির্ভর করে, এটি কৃত্রিমভাবে ইউয়ানের অবমূল্যায়ন করতে পারে। ফলে ইউয়ানে অর্থ প্রদান করলে সমস্যা তৈরি হতে পারে। এসব সত্ত্বেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলারে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের মাত্রা ক্রমেই কমছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৯৯ সালে বিশ্বে মার্কিন মুদ্রা গ্রিনব্যাকে রিজার্ভ ছিল মোট ৭১ শতাংশ। ২০২১ সালে তা ৫৯ শতাংশে নেমে এসেছে। আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সিস্টেম সুইফটের হিসাবে, চলতি মাসে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৪২ শতাংশ ডলারে হয়েছে। ৩৩ শতাংশ ক্ষেত্রে ইউরো ব্যবহার হয়েছে। মাত্র দুই শতাংশ লেনদেনে চীনা ইউয়ান ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে ডলারের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য আরএমবিকে এখনও দীর্ঘ পথ যেতে হবে।

সংকট বাড়াচ্ছে ডলার

গত বছরের শেষ দিকে ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বজায় রাখতে ডলারকে বড় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র। ডলারকে ব্যবহার করে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বহু দেশকে কাবু করছে ওয়াশিংটন। এতে অনেক দেশ অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। তবে ডলারের আধিপত্য রুখে দেওয়ার জন্য চীন, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, ইরান, ভারতসহ অনেক দেশ চেষ্টা চালাচ্ছে।

ডলারের মুখ্য ভূমিকা যুক্তরাষ্ট্রের একটি অতিরিক্ত বিশেষাধিকার। এটি যুক্তরাষ্ট্রকে সহজেই তার বাণিজ্য এবং বাজেট ঘাটতির অর্থায়ন করার সুযোগ করে দেয়। দেশটি তাই কখনও লেনদেনের ভারসাম্য সংকটে পড়ে না। কারণ তারা নিজস্ব মুদ্রায় আমদানি এবং পরিষেবা বিল পরিশোধ করে থাকে। তারা আর্থিক প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা পেতে ডলারের দামকে প্রভাবিত করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক অর্থমন্ত্রী জন কনালি ১৯৭১ সালে বলেছিলেন– ডলার হলো ‘আমাদের মুদ্রা, কিন্তু আপনার সমস্যা।’

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ব্যক্তি, সংস্থা, সরকার বা সমগ্র দেশকে দেওয়া হয়। যেমন ইরান, কিউবা ও সুদানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের জন্য বিএনপি পারিবাস নামের একটি ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রকে ৯ বিলিয়ন ডলার জরিমানা দিয়েছে এবং এক বছরের জন্য ব্যাংকটির ডলার ক্লিয়ারিং স্থগিত করা হয়েছে। এইচএসবিসি, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডসহ আরও কয়েকটি ব্যাংক অনুরূপ বড় জরিমানা প্রদান করেছে যুক্তরাষ্ট্রকে। এ কারণে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক এবং এক্সচেঞ্জগুলো রাশিয়ার কোম্পানির সঙ্গে লেনদেন বন্ধ করতে বাধ্য হয়।

চীন, রাশিয়া এবং ইউরোপ একটি বিকল্প রিজার্ভ মুদ্রা ব্যবস্থা চায়। সমস্যা হলো ডলারের বিকল্প রাতারাতি তৈরি কঠিন। প্রথমত, ইউরো, ইয়েন, ইউয়ান এবং রুবল বাস্তবসম্মত বিকল্প নয়। ইউরোর দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যৎ এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত নয়। আবার জাপানের অর্থনীতিও দুই দশক মন্দায় আটকে আছে। চীন এবং রাশিয়ার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে এবং ইউয়ান সম্পূর্ণ রূপান্তরযোগ্য নয়। দ্বিতীয়ত, এ সংক্রান্ত অবকাঠামোর প্রয়োজনীয় পরিবর্তন দুরূহ।

চীন এবং রাশিয়া দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ইউয়ান এবং রুবল ব্যবহার শুরু করেছে। সৌদি আরব চীনের সঙ্গে তেল বাণিজ্যে ইউয়ান ব্যবহার করবে। মিসরও ইউয়ান নিয়ন্ত্রিত বন্ড ইস্যু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া ভারত এবং ইরানের মতো দেশগুলো আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে তাদের জাতীয় মুদ্রা ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করছে। এর মানে হলো বিশ্ব বাণিজ্যে ডলার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

ডলার সংকটের কারণে চীন ও ভারতের সঙ্গে স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেনের সুপারিশ করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। দুই দেশ থেকে বছরে আমদানি করা হয় ২৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য ও সেবা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত ও চীন দুই দেশই নিজেদের মধ্যে স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেন করছে। রাশিয়া থেকে রুপি দিয়ে গ্যাস কিনছে ভারত। বাংলাদেশ সরকারও এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে পারে।

বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিআই) সাধারণ সম্পাদক আল মামুন মৃধা বলেন, চীন আমাদের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। ডলার সংকটের এই সময়ে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় আমদানি-রপ্তানি ব্যয় মেটানো গেলে দুই দেশই উপকৃত হবে। দুই দেশের মধ্যে ডলারের বিকল্প মুদ্রায় আমদানি-রপ্তানির এখনই সর্বোত্তম সময়।

নতুন চ্যালেঞ্জ ব্রিকস মুদ্রা

হোয়াইট হাউসের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা জোসেফ সুলিভান চলতি সপ্তাহে ফরেন পলিসিতে লিখেছেন, সম্ভাব্য ব্রিকস মুদ্রা ডলারের আধিপত্যকে নাড়া দিতে পারে।

গত মাসে নয়াদিল্লিতে রাশিয়ার ডুমার ডেপুটি চেয়ারম্যান আলেকজান্ডার বাবাকভ বলেছেন, মস্কো এখন একটি নতুন মুদ্রা বিকাশের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এটি ব্রিকস দেশগুলোতে আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যের জন্য ব্যবহার করা হবে। ব্রিকসের সদস্য ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা।

সুলিভান লিখেছেন, ব্রিকস দেশগুলোর অভিন্ন মুদ্রা সত্যিই মার্কিন রিজার্ভ হিসেবে ডলারকে অপসারণ করতে পারে। এই কাল্পনিক মুদ্রার প্রকৃতপক্ষে ডলারের সিংহাসনকে দখল করার বা অন্তত ঝাঁকুনি দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.