‘টুয়েলভথ ফেল’–এর শ্রদ্ধা চরিত্রটি মুগ্ধতা ছড়ানোর নেপথ্যে যে কারণ

0
80
‘টুয়েলভথ ফেল’ অভিনেত্রী মেধা। ছবি: অভিনেত্রীর ইনস্টাগ্রাম থেকে

‘টুয়েলভথ ফেল’ সিনেমায় দেখানো হয়, মনোজের সফল (আইপিএস অফিসার) হওয়ার পেছনে কয়েকজন মানুষের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। তবে বেশির ভাগ দর্শককে মুগ্ধ করেছে মনোজের প্রেমিকা শ্রদ্ধা চরিত্রটি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শ্রদ্ধার প্রশংসায় পঞ্চমুখ অনেকেই। প্রশ্ন জাগে, চরিত্রটি আমাদের কেন মুগ্ধ করল? সচরাচর বিপর্যস্ত, অভাবে জরজর প্রেমিকের পাশে প্রেমিকার দাঁড়ানোর দৃশ্য চোখে পড়ে না বলে। নাকি প্রিতম পান্ডে শ্রদ্ধার সামনে মনোজকে ‘আগে কিছু হওয়ার চেষ্টা করো, নাহলে শ্রদ্ধা ছেড়ে চলে যাবে…লুজারদের সঙ্গে কেউ থাকে না।’ কথাটা বলার পরপরই শ্রদ্ধা মনোজকে ভালোবাসার কথা বলেছিল বলে। কাহিনির নিরিখে প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি।

মনোজের জীবনে শ্রদ্ধাই প্রথম কোনো তরুণী, যে তার কাছে নাম জিজ্ঞাসা করে। আর কেউ স্বীকার করুক বা না করুক, সবাই কমবেশি গুরুত্ব, মনোযোগ পেতে পছন্দ করে। সেহেতু প্রথম দেখাতেই মনোজের মনে যে একটি আশার পাখি ডানা মেলেছিল, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না।

অপর দিকে মনোজের সততা, বিনয়, সারল্য আর কোচিং না করে ইউপিএসসির প্রিলিমিনারি পাস করার কথা জেনে প্রথম সাক্ষাতে শ্রদ্ধাও মুগ্ধ হয় এবং সে মনোজের সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যেই যে তার বাবাকে মনোজ যে লাইব্রেরির ঠিকানা দিয়েছিল, ওই লাইব্রেরিতে আসে, তা উপলব্ধি করতেও যুক্তিতর্কের প্রয়োজন পড়ে না।
যেদিন প্রথম লাইব্রেরিতে যায় শ্রদ্ধা, ঘটনা পরম্পরায় সে দুটি তথ্য পায়—মনোজ লাইব্রেরিতে কাজ করে নিজের খরচ চালায়। পাশাপাশি পড়ালেখা করে। আর মনোজ প্রকৌশলী।

‘টুয়েলভথ ফেল’ সিনেমার দৃশ্য
‘টুয়েলভথ ফেল’ সিনেমার দৃশ্যআইএমডিবি

একটি ছেলে সৎ, সরল, বিনয়ী, কোচিং ছাড়ায় ইউপিএসসির প্রিলিমিনারি পাস করেছে, পেশায় প্রকৌশলী, দরিদ্র হলেও পরিশ্রমী, সম্ভাবনাময় ইত্যাদি কারণে যেকোনো তরুণীরই তাকে ভালো লাগতে পারে। আর এ স্বাভাবিকতা থেকে মনোজ ও শ্রদ্ধার গল্পটি পরিণতি পেলে আমরা যাঁরা শ্রদ্ধায় মুগ্ধ হয়েছি, তারা কী সত্যিই মুগ্ধ হতাম? হয়তো হতাম অথবা হতাম না। সেসব কথা বরং থাক। আবারও সিনেমার দৃশ্যে ফিরি। এ ঘটনার কিছুদিন পরপরই কোচিং ক্লাসে একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষকের মুখে শ্রদ্ধা একটি সত্য জানতে পারে। যে মনোজ প্রকৌশলী নয়, ১২ ক্লাসে ফেল করে পরবর্তী সময়ে থার্ড ডিভিশনে কোনো রকমে পাস করে একটি বিষয়ে বিএ করেছে। এই সত্য জানার পর মনোজকে শ্রদ্ধা এড়িয়ে যেতে পারত। মনোজ মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বললেও শ্রদ্ধা হয়তো ফিরিয়ে দিত। শ্রদ্ধা সত্যি এটাই করেছিল।

কিন্তু সিনেমার দৃশ্য পরম্পরায় প্রত্যাশার চেয়ে দূরের একটি ঘটনা ঘটে। দেখা যায় কিছুদিন সময় নিয়ে মনোজের কাছে এসে আগের সবকিছুর জন্য শ্রদ্ধা ক্ষমা চায়।
আচ্ছা, মনোজ ফোনে যেদিন শ্রদ্ধাকে ভালোবাসার কথাটা জানিয়েছিল, শ্রদ্ধা তো সেদিনই ‘হ্যাঁ বা না’ বলে দিতে পারত। তবে কী শ্রদ্ধার মনে সন্দেহ ছিল! সন্দেহ থাকাটা কী অস্বাভাবিক? প্রচলিত দৃষ্টিতে শ্রদ্ধা ডাক্তার, সামাজিক-অর্থনৈতিক ও পারিবারিক অবস্থান থেকে মনোজের চেয়ে অনেক ওপরে। তা ছাড়া কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হলে অবশ্যই সময় নিয়ে ভাবার প্রয়োজন। শ্রদ্ধা কি সেই কাজটিই করেনি? এ কারণেই কি আমরা শ্রদ্ধায় মুগ্ধ হয়েছি।

নাকি মনোজের তৃতীয় প্রচেষ্টার প্রিলিমিনারির রেজাল্টের পরের দৃশ্যে আটা তৈরির মিলে গিয়ে শ্রদ্ধা যখন বলে, ‘মেনসের (ইউপিএসসির লিখিত পরীক্ষা) জন্য তো অনেক পড়ালেখা করা দরকার। তুমি এখানকার কাজ ছেড়ে দাও। আমার কাছে কিছু টাকা আছে…সেগুলো নাও।’ যদিও টাকা নিতে মনোজ অসম্মতি জানায়। এরপরও খুব গোপনে মনে মনে আমরা কী জীবনসঙ্গী তথা ভালোবাসার মানুষ হিসেবে এমন একজনকে আশা করি যে সব বিপর্যয়ে পাশে থাকবে। তাই কী শ্রদ্ধার প্রতি আমরা মুগ্ধ হয়েছি।

এতটুকুই কি যথেষ্ট? মনোজের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারটা বাবা-মা জেনে যাওয়ার পর, শ্রদ্ধাকে যখন বাড়িতে থাকতে বাধ্য করল। মনোজের ভাইভার দিনে মনোজের কাছে যাওয়ার জন্য, পাশে থাকার জন্য শ্রদ্ধা মা–বাবার সঙ্গে রীতিমতো যুক্তি-তর্ক করল। এই মুহূর্তে আমরা কী মনোজের প্রতি শ্রদ্ধার নিটোল ভালোবাসা অনুভব করিনি। ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, ইউপিএসসিতে মনোজের শেষ প্রচেষ্টা। মনোজ যে ভাইভাতে উতরে যাবে তখনো নিশ্চিত না। তা ছাড়া শ্রদ্ধা নিজে তখন ডেপুটি কালেক্টর। কতটা ভালোবাসা থাকলে কেউ কাজটা করতে পারে?

তারপর পরীক্ষার কেন্দ্রে যাওয়ার সময় শ্রদ্ধা মনোজকে যখন একটা চিঠি দিল। ভাইভা রুমে দ্বিতীয়বার প্রবেশের আগে মনোজ যখন চিঠিটা পড়ল।
শ্রদ্ধা লিখেছে, ‘তুমি আইপিএস অফিসার হও কিংবা মিলে কাজ করো, আমি সারা জীবন তোমার সঙ্গে কাটাতে চাই। উইল ইউ ম্যারি মি মনোজ?’ শ্রদ্ধার এই বক্তব্য কী আমাদের মনে দাগ কাটেনি?

‘টুয়েলভথ ফেল’ অভিনেত্রী মেধা। ছবি: অভিনেত্রীর ইনস্টাগ্রাম থেকে
‘টুয়েলভথ ফেল’ অভিনেত্রী মেধা। ছবি: অভিনেত্রীর ইনস্টাগ্রাম থেকে

তা ছাড়া সব শেষে মনোজ আর শ্রদ্ধা যখন রেজাল্ট দেখতে গেল। মনোজ আইপিএস অফিসার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে জানার পর শ্রদ্ধার চোখমুখের যে উচ্ছ্বাস। আমরা কি ওই উচ্ছ্বাসে প্রাণ খুঁজে পায়নি?

মনোজের প্রতি শ্রদ্ধার ভালোবাসার যে দৃঢ়তা, তারই বা কারণ কী? করুণা, মায়া, সহানুভূতি। এর কোনোটিই বোধ হয় মনোজের প্রতি শ্রদ্ধার আগ্রহের কারণ নয়। একেবারে নিঃস্বার্থভাবেই মনোজকে সে ভালোবাসতে পেরেছিল। তার ভালোবাসার মূলে ছিল আত্মবিশ্বাস।
শ্রদ্ধার এই আত্মবিশ্বাস, ভরসার জোরই কী ‘টুয়েলভথ ফেল’ সিনেমায় তাকে অনন্য করে তুলেছে? আর সে কারণেই কী আমরা শ্রদ্ধার প্রতি মুগ্ধ হইনি?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.