চলনবিল বৈচিত্র্যে অফুরান, বর্ষায় মাছ, শুকনায় ধান

0
64
প্রাকৃতিকভাবেই চলনবিল শস্য ও মৎস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত। সম্প্রতি পাবনার চাটমোহরে

নবাব আলী (৫৫) পেশায় কৃষক। শুষ্ক মৌসুমে কৃষিকাজ করেন। বর্ষায় তেমন কাজ থাকে না। এ সময়টা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। আমজাদ হোসেন (৫০) বর্ষায় নৌকা চালান। পর্যটকদের নিয়ে ঘুরে বেড়ান বিলের পানিতে। শুকনা মৌসুম এলে হয়ে যান পুরোদস্তুর শ্রমিক। সম্প্রতি এক দুপুরে তাঁদের সঙ্গে কথা হয় চলনবিলে। তাঁরা পাবনার চাটমোহর উপজেলার চলনবিলের বোয়ালমারী মাঠে ধান কাটা, মাড়াই ও শুকানোর কাজ করছিলেন।

চলনবিলের এই দৃশ্য শুকনা মৌসুমের। তবে বর্ষায় রূপ ভিন্ন। থইথই পানি আর উথালপাতাল ঢেউ। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যেমন রূপ বদলায় চলনবিলের, তেমনি কাজের ধরনেও পরিবর্তন হয় বিলপারের বাসিন্দাদের। একেক সময়ে একেক কাজকে পেশা হিসেবে নিয়ে পুরো বছর কর্মব্যস্ত সময় কাটান তাঁরা। এর ফলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি এভাবেই চলনবিল এখন কর্মসংস্থানের বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।

পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলার ১০টি উপজেলার ৬২টি ইউনিয়নের ১ হাজার ৬০০ গ্রাম নিয়ে বৃহত্তর চলনবিল। এর মধ্যে রয়েছে ২১টি নদ-নদী, ৭১টি নালা-খাল ও ৯৩টি ছোট বিল। ঐতিহাসিক দলিল ‘ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া’র তথ্যমতে, ১৮২৭ সালে জনবসতি এলাকা বাদ দিয়ে চলনবিলের জলমগ্ন অংশের আয়তন ছিল ৫৫০ বর্গমাইল।

বর্ষা মৌসুমে চলনবিল মাছে ভরে ওঠে। বর্ষার পানিতে প্রচুর দেশি মাছ প্রবেশ করে বিলে। বিলের নিচু অংশে প্রায় পুরো বছরই চলে মাছ শিকার। অনেকেই বিলের বিভিন্ন স্থানে পুকুর খনন করেছেন। এসব পুকুরে দেশি মাছের চাষ হচ্ছে। এ থেকে বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে বহু মানুষের।

বিস্তীর্ণ এই বিলের পাবনা অংশে রয়েছে চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর উপজেলা। চলনবিলকে কেন্দ্র করে তিনটি উপজেলাই অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। কৃষিকাজের পাশাপাশি মৎস্য চাষ ও গবাদিপশুর খামার করে স্বাবলম্বী হয়েছেন অনেকে। অনেকে আবার বিলের উন্মুক্ত জলাশয়ে হাঁস পালন করছেন। বিলের ঝিনুক থেকে চুন ও শাঁখা তৈরি, বাঁশ-বেতশিল্প ও জাল বোনার মতো পুরোনো পেশা আঁকড়ে রেখেছেন অনেকে।

তিন উপজেলার ১৫ জন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই বিলের মাটি খুব উর্বর। ফলে বিলের উঁচু জমিতে প্রায় সব ধরনের ফসল উৎপাদিত হয়। শুকনা মৌসুমে কৃষিপ্রধান হয়ে ওঠে চলনবিল। কৃষিকাজের পাশাপাশি চলে গবাদিপশু পালন। বিলের টাটকা ঘাস ও ধানের খড়ে খাবারের জোগান হয় এসব গবাদিপশুর। এর ফলে জেলার ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর উপজেলা এখন গবাদিপশুর খামারে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। গরু ও ছাগল পালন করে বহু মানুষ স্বাবলম্বী হয়েছেন। বিকল্প পেশা হিসেবে অনেকে হাঁস-মুরগি পালন করছেন। বিলের উন্মুক্ত জলাশয়েই মিলছে হাঁসের খাবার। বাড়তি খরচ কম হচ্ছে। অন্যদিকে বর্ষায় বিলে মাছ ধরে বাড়তি আয় করেন এখানকার বাসিন্দারা। বর্ষার শেষ দিকে চলে শুঁটকি উৎপাদনের কাজ। চাটমোহরের বোয়ালমারী, হান্ডিয়ালসহ বিভিন্ন এলাকায় কয়েক শ মানুষ শুঁটকি তৈরি করেন।

হান্ডিয়াল গ্রামে রয়েছে ঐতিহ্যবাসী শাঁখাশিল্প। দীর্ঘদিন ধরে বিলের ঝিনুক কুড়িয়ে শাঁখা তৈরি করছেন স্থানীয় কারিগরেরা। এ ছাড়া হরিপুর ও গুনাইগাছা এলাকায় তৈরি হয় ঝিনুকের চুন, যা সরবরাহ করা হয় দেশের বিভিন্ন এলাকায়। মুলগ্রাম ইউনিয়নের কুবিরদিয়ার গ্রাম সমৃদ্ধ বাঁশ ও বেতশিল্পের জন্য। বাঁশ ও বেতের বুননে নান্দনিক সব পণ্য তৈরি করছেন এখানকার বাসিন্দারা। এসব পণ্যের কাঁচামালের উৎসও চলনবিল।

চলনবিল শুধু খামারের পশুর খাদ্যের চাহিদাই মেটায় না। চলনবিল পশুর চারণভূমিও।
ভাঙ্গুড়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা রুমানা আক্তার

অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে চলনবিল মাছে ভরে ওঠে। বর্ষার পানিতে প্রচুর দেশি মাছ প্রবেশ করে বিলে। বিলের নিচু অংশে প্রায় পুরো বছরই চলে মাছ শিকার। অনেকেই বিলের বিভিন্ন স্থানে পুকুর খনন করেছেন। এসব পুকুরে দেশি মাছের চাষ হচ্ছে। এ থেকে বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে বহু মানুষের।

২০০৯ সালে বিকল্প পেশা হিসেবে গরুর খামার করার উদ্যোগ নেন ভাঙ্গুড়া উপজেলা সদরের খামারি শাহিবুল ইসলাম। মাত্র ৫টি গরু দিয়ে শুরু করা শাহিবুলের খামারে বর্তমানে ৮৫টি গরু রয়েছে। সেখানে ১০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। তিনি বলেন, মূলত বিলে উৎপাদিত ধানের খড় ও কাঁচা ঘাসই তাঁর খামারকে সমৃদ্ধ করেছে। ফলে তাঁর মতো অনেকেই গরু ও ছাগলের খামার করছেন।

ফরিদপুর ও ভাঙ্গুড়া প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলনবিলকে কেন্দ্র করে উপজেলা দুটিতে একের পর এক গড়ে উঠছে গবাদিপশুর খামার। শুধু ফরিদপুরেই ২ হাজার ৩০০ গরু ও ৭৫০টি ছাগলের খামার রয়েছে। ভাঙ্গুড়ায় রয়েছে ৫৮৫টি গরু ও ৪৫টি ছাগলের খামার। এসব খামারকে কেন্দ্র করে দুগ্ধসমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে উপজেলা দুটি। কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে মানুষের।

ভাঙ্গুড়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা রুমানা আক্তার বলেন, চলনবিল শুধু খামারের পশুর খাদ্যের চাহিদাই মেটায় না। চলনবিল পশুর চারণভূমিও। বিলে প্রচুর পরিত্যক্ত জমি রয়েছে। এসব জমি গবাদিপশুর চারণভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফলে চলনবিল-অধ্যুষিত পাবনার ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া ও সিরাজগঞ্জ দুগ্ধসমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে পরিণত হয়েছে। লক্ষাধিক মানুষ এই পেশার সঙ্গে জড়িত।

চলনবিলে ভ্রাম্যমাণ হাঁসের খামার করে স্বাবলম্বী হয়েছেন অনেকে। চাটমোহরের হরিপুর ইউনিয়নের ধুলাউড়ি গ্রামের হাঁসচাষি হারুনর রশিদ বলেন, বিলে হাঁস পালন লাভজনক। বিলের শামুক, ঝিনুক ও কীটপতঙ্গেই হাঁসের খাবার জোগান হয়। এতে খরচ অনেক কমে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলনবিলে প্রাকৃতিক মাছের উৎপাদন আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে। ২০০১ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত ৩ উপজেলায় ২৪ হাজার ৫১২ মেট্রিক টন প্রাকৃতিক মাছ এবং ৩৯ হাজার ১৮৫ মেট্রিক টন চাষ করা মাছের উৎপাদন হয়েছে। প্রাকৃতিক মাছের উৎপাদন কমলেও চাষের মাছ বৃদ্ধি পেয়েছে ১১৭ শতাংশ।

পরিকল্পিতভাবে চলনবিলকে ব্যবহার করা গেলে আরও অনেক মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হতো বলে মনে করেন চলনবিল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্যসচিব এস এম মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, প্রাকৃতিকভাবেই চলনবিল শস্য ও মৎস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত। শুকনা মৌসুমে যেমন ফসলের মাঠ নিয়ে বিলের বাসিন্দারা ব্যস্ত থাকেন, তেমনি বর্ষায় মাছ নিয়ে। এর মধ্যে বিকল্প আয়ের উৎস দিন দিন বাড়ছে। বিভিন্নভাবে মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। তবে চলনবিল নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগের অভাব রয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.