‘গুম’ হওয়ার ভয় যে নির্বাচনে

0
109

সাধারণত বিরোধী দলের নেতারা সরকারি দলের বিরুদ্ধে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস ও উন্নয়ন স্থবির করার অভিযোগ এনে থাকেন। এবার সরকারি দলের দুই নেতা, যাঁরা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদপ্রার্থী হয়েছেন, তাঁরাও একই অভিযোগ এনেছেন।

বরিশাল সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ তাঁকে দেওয়া সংবর্ধনা সভায় বলেন, ‘আমার লক্ষ্য একটাই, সেটা হলো গত পাঁচ বছর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে মুখ থুবড়ে পড়া বরিশাল নগরকে একটি তিলোত্তমা নগরে পরিণত করা। এই নগরের সব শ্রেণি-পেশার নাগরিকদের সম্মান-মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া। নতুন এক বরিশালের অভিযাত্রা শুরু করা।’

এর মধ্য দিয়ে তিনি দুটি বার্তা দিয়েছেন, গত পাঁচ বছর বরিশালে কোনো উন্নতি হয়নি এবং নাগরিক হিসেবে বরিশালের বাসিন্দাদের যে সম্মান-মর্যাদা পাওয়ার কথা, তা–ও পায়নি তারা। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী শহরের উন্নয়ন ও নাগরিকদের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করবেন, খুবই ভালো কথা। কিন্তু নাগরিকদের মর্যাদার সঙ্গে ভোটাধিকারের যে প্রশ্ন আছে, সে সম্পর্কে কিছু বলেননি। ভোটের অধিকার ছাড়া নাগরিকদের মর্যাদা কোনোভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায় না।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন ‘আমি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছি ব্যক্তির বিরুদ্ধে, যে ব্যক্তি এই শহরকে (গাজীপুর) ধ্বংস করে দিয়েছে। আমি তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি।’

নাম উল্লেখ না করলেও তিনি কথাটি বলেছেন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আজমত উল্লাকে ইঙ্গিত করে। কেননা, বিএনপি এই নির্বাচনে কোনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি। ২০১৩ সালের নির্বাচনে আজমত উল্লাকে হারিয়ে জিতেছিলেন বিএনপির আবদুল মান্নান। তাঁর মেয়াদের পুরো সময়ই গেছে জেলখানা ও মামলা মোকাবিলা করতে। ফলে শহর গড়ে তোলা কিংবা ধ্বংস করার সময় তিনি পাননি।

২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে জাহাঙ্গীর আলম জয়ী হয়ে মেয়র পদে বসেছিলেন। কিন্তু বেফাঁস মন্তব্যের কারণে সেই পদ থেকে তাঁকে সরে যেতে হয়েছে। দল থেকেও সাময়িক বহিষ্কার হয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে ক্ষমা পেয়েছেন।

এবার দল জাহাঙ্গীর আলমকে মনোনয়ন না দিয়ে বেছে নিয়েছে আজমত উল্লাকেই। তাই জাহাঙ্গীর আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়ে ধ্বংস হওয়া শহর পুনর্গঠন করার ঘোষণা দিলেন। শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকবেন কি না, প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হয়তো কালকের পর আমার পায়ে শিকল পরাতে পারে। অ্যারেস্ট করতে পারে। গুমও করতে পারে। ষড়যন্ত্র করে না সরালে আমি নির্বাচন থেকে সরব না।’

নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে ভোট হবে। এরপর ১২ জুন খুলনা ও বরিশালে এবং ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশনে ভোট হবে।

বাংলাদেশে একসময় ভোট মানেই ছিল উৎসব। সরগরম আলোচনা। সম্ভাব্য প্রার্থীদের বাড়িতে কর্মী-সমর্থকদের ভিড়। এবার সে রকমটি দেখা যাচ্ছে না। বিএনপি বলেছে, তারা এই সরকারের অধীন কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। দলীয় নেতা-কর্মীদেরও হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলা হয়েছে, মেয়র কিংবা কাউন্সিলর কোনো পদেই বিএনপির কেউ নির্বাচন করতে পারবেন না। আগের কয়েকটি সিটি নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলেও কাউন্সিলর পদে কাউকে বারণ করেনি। উল্লেখ্য, মেয়র পদের মতো কাউন্সিলর পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হয় না।

৫ সিটি নির্বাচন: ফাঁকা মাঠে গোল না শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা!

প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপি নির্বাচন না করে কী করবে? তারা কি আওয়ামী লীগকে মাঠ ছেড়ে দেবে? তারা কি নির্বাচন প্রতিরোধ করবে? সিটি বা স্থানীয় নির্বাচন প্রতিরোধ করা কঠিন। এরশাদের শাসনামলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মিলেও প্রতিরোধ করতে পারেনি। তিনি সব বিরোধী দলের অবরোধ-হরতাল উপেক্ষা করে উপজেলা নির্বাচন করেছিলেন।

বিএনপির নেতারা মনে করেন, নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনরত সব দল নির্বাচনে অংশ না নিলে সেটি আওয়ামী লীগের ‘নিজস্ব নির্বাচন’ হবে। জনগণের নির্বাচন হবে না। আওয়ামী লীগের জোট শরিক ও জাতীয় পার্টিও সিটি নির্বাচনে তেমন উৎসাহী নয়। বাম গণতান্ত্রিক জোটও দোটানায় আছে। ইসলামী আন্দোলন ছাড়া অন্য কোনো ইসলামি দলও তেমন মাঠে নামেনি। সাম্প্রতিক কালে স্থানীয় সরকার সংস্থার যত নির্বাচন হয়েছে, ব্যতিক্রম দু–একটি বাদে প্রায় সবটাতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। ফলে বিএনপি জোটের বাইরেও অনেক দল মনে করে, এ অবস্থায় ভোট করা হবে ‘ন্যাড়া দ্বিতীয়বার বেলতলায়’ যাওয়ার মতো ঘটনা।

নির্বাচনী রাজনীতিতে সবকিছু নিজের দখলে নেওয়ার মানসিকতা এখন আওয়ামী লীগের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভালো নির্বাচন করলে দলীয় প্রার্থীর হেরে যাওয়ার আশঙ্কা আর খারাপ করে দলীয় প্রার্থীকে জয়ী করে আনলে দেশে–বিদেশে তার কঠোর সমালোচনা।

 খবর অনুযায়ী, এ কারণেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ভোটে অংশগ্রহণ বাড়াতে নানা কৌশল হাতে নিয়েছে। তবে সেই কৌশল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উকিল আবদুস সাত্তারের মডেল হবে না সিলেট মডেল হবে, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। সাত্তার মডেল হলো আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই উকিলকে জয়ী করে এনেছেন। আর সিলেট মডেল হলো আওয়ামী লীগ নানা ফন্দিফিকির করেও আরিফুল হক চৌধুরীর জয় ঠেকাতে পারেনি।

নির্বাচনের নিয়ামক শক্তি জনগণ। জনগণের শক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে ভোট নিয়ে এত কৌশল– অপকৌশলের প্রয়োজন হয় না।

সিটি নির্বাচনে বিএনপি যাবে কি যাবে না

যে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহী প্রার্থী গ্রেপ্তার ও গুম হওয়ার আশঙ্কা করেন, সেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে, আশা করা যায় না। আবার যে দলের নির্বাচিত মেয়রের কার্যক্রম সম্পর্কে তাঁর সম্ভাব্য উত্তরসূরি উন্নয়ন স্থবিরতা ও নাগরিকদের মর্যাদা হরণের অভিযোগ আনেন, সেই দলের নেতা বা প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়াও প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।

গতকাল শুক্রবার পত্রিকায় চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচনের ফল প্রকাশিত হয়েছে। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নোমান আল মাহমুদ জিতেছেন, সেটি বড় খবর নয়। বড় খবর হলো এ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল ১৪ শতাংশ। এর অর্থ ৮৬ শতাংশ ভোটার অনুপস্থিত থেকেছেন। নোমান নৌকা প্রতীক নিয়ে ভোট পেয়েছেন ৬৭ হাজার ২০৫। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামী ফ্রন্টের সেহাব উদ্দিন মুহাম্মদ আবদুস সামাদ পেয়েছেন ৫ হাজার ৮৭ ভোট। মোট ভোটার ৫ লাখ ১৭ হাজার ৬৫২ জন।

পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এ হার বাড়বে না কমবে, সেটাই এখন আওয়ামী লীগের দুশ্চিন্তার কারণ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.