গরু চোরাচালানের জাল উত্তরের সীমান্তে

0
111
বাংলাদেশের শেষ সীমান্ত তিন বিঘা করিডোর। গরু চোরাচালান রোধে রয়েছে বিজিবির সতর্কবার্তা। আর সড়কের পাশেই বাঁধা পাচার হয়ে আসা গরু।

ভারত থেকে বৈধ পথে গরু আসছে না; কিন্তু বাংলাদেশে ভারতীয় গরুর চাহিদা রয়েছে প্রচুর। আর এ সুযোগটিই নিচ্ছে চোরাকারবারিরা। প্রতি রাতে সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ঢুকছে শত শত চোরাই গরু। পেছনে কাজ করে দুই দেশের একটি সংঘবদ্ধ চক্র। দেশের উত্তরাঞ্চলে সীমান্তজুড়ে রয়েছে তাদের ‘গরু চোরাচালানের জাল’।

ভারতে ২০ হাজার টাকায় কেনা ৪ মণ ওজনের একটি গরু চোরাই পথে দেশে এনে বিক্রি করলে পাওয়া যায় অন্তত এক লাখ টাকা। কিন্তু এমন একটি গরু আনতে খরচ পড়ে ৫০ হাজার টাকার মতো। এর পর ‘চেয়ারম্যান-স্লিপ’-এর মাধ্যমে সেই গরু চলে যায় দেশের বিভিন্ন হাটে। ভারতীয় চক্রের সঙ্গে মিলে বাংলাদেশি একটি চক্র চালিয়ে যাচ্ছে অবৈধ এই ব্যবসা। বছরে তাদের আয় কোটি কেটি টাকা। লালমনিরহাটের দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ঘুরে মিলেছে এই তথ্য।

যেভাবে গরু আসে

অনুসন্ধানে জানা যায়, সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়ে বাংলাদেশে যেসব গরু আসে, সেগুলো মূলত ভারতের রাজস্থান, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তর প্রদেশের। সীমান্তের ওপাড়ের পাচারকারীরা বিভিন্ন হাট থেকে গরুগুলো কেনে। এর পর ট্রাকে করে পৌঁছায় মালদহ ও মুর্শিদাবাদের সীমান্তবর্তী রানীনগর, ভগবানগোলা, লালগোলা, জঙ্গপুর ও সুতিরজের গ্রামের খাটালে (গরু রাখার স্থান)। এর পর সেই গরু চোরাই পথে সীমান্ত পার করে বাংলাদেশে আনার ব্যবস্থা করে ‘এনামুল-বিশু সিন্ডিকেট’।

ভারতেই ওইসব গরুর গায়ে এক দফা সিল মারা হয়। বাংলাদেশে আসার পরও সিল পড়ে। এগুলো চোরাকারবারিদের সাংকেতিক সিল। সীমান্তের ওপারে কিছু যুবক রাখাল হিসেবে কিছু সময় গরুগুলো দেখে রাখে। ‘সবুজ সংকেত’ পেলেই শুরু হয় বাংলাদেশে পাচার। ‘লাইন খোলা’ অর্থাৎ কোন সময়ে কত ঘণ্টা পাচার চলবে, সেই বার্তা আসে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের কাছ থেকে। শুধু স্থলপথে নয়, একইভাবে গরু আসে নদীপথেও। ভারতীয় রাখালরা সীমান্ত পার করে গরু বুঝিয়ে দেয় বাংলাদেশি রাখালদের হাতে। এ জন্য গরুপ্রতি তারা পায় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা।

লালমনিরহাট জেলায় ভারতের সঙ্গে সীমান্ত প্রায় ২৮৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৫৪ কিলোমিটারে কাঁটাতারের বেড়া নেই। সীমান্তে অপরাধ ঠেকাতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ৩টি ইউনিট (১৫, ৫১ ও ৬১) এ অঞ্চলে কাজ করে। তারপরও সীমান্ত দিয়ে গরু চোরাচালান বন্ধ হচ্ছে না।

স্থানীয় গরু ব্যবসায়ীরা জানান, পাটগ্রাম, দহগ্রাম, আঙ্গরপোতা ও হাতিবান্ধার দইখাওয়া সীমান্তে গড়ে উঠেছে গরু চোরাকারবারির  শক্তিশালী চক্র। বিজিবির কিছু অসাধু সদস্যের সহযোগিতায় তারা এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতি রাতে চোরাই গরু পারাপারে সীমান্ত এলাকায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। তবে চোরাকারবারিরা এতটাই প্রভাবশালী যে, ভয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা মুখ খুলতে চান না। উত্তরাঞ্চলে সীমান্তের অন্তত ১১টি পয়েন্ট দিয়ে প্রতিরাতে পাঁচ শতাধিক গরু ভারত থেকে অবৈধভাবে ঢুকছে বাংলাদেশে।

দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ঘুরে দেখা যায়, দিনের বেলা কৃষিকাজের কথা বলে ভারতীয়রা যেমন বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রবেশ করে, তেমনি বাংলাদেশিরাও ভারতে ঢুকে পড়ে অনায়াসে। এমন অবস্থা দহগ্রাম, দইখাওয়া, কালীগঞ্জ, চাপারহাট, গোড়ল, কুটিয়ামঙ্গল, দুর্গাপুর ও মোগলহাটে বেশি। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের এই এলাকায় অনেক স্থানেই কাঁটাতারের বেড়া নেই।

চোরাচালানে জড়িত যারা

একসময়ের বাংলাদেশি ছিটমহল দহগ্রামে ৭০ থেকে ৮০ জনের অন্তত ৮টি ছোট ছোট চক্র রয়েছে, যারা গরু চোরাকারবারে জড়িত। ভারত থেকে গরু এনে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের স্লিপ নিয়ে পাটগ্রামসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন হাটে তারা বিক্রি করে। স্থানীয়রা জানান, দহগ্রামের কাতিপাড়ার আব্দুল মোমিন ওই চোরাকারবারি চক্রের মূল হোতা। তার নেতৃত্বে করিডোরপাড়ার আব্দুল হক, কাতিপাড়ার রফিকুল, শাহজামাল, দহগ্রামের মালেক ও কাতিপাড়ার তালেব আলাদাভাবে সিন্ডিকেট পরিচালনা করে। তাদের কাজ, রাতের অন্ধকারে সীমান্তের ওপার থেকে গরু এনে সীমান্তবর্তী গ্রামে রাখা। এর পর ‘বাঘা মইনুল’ নামে এক ব্যক্তি ওই গরু তিনবিঘা করিডোর পার করার ব্যবস্থা করে। তাকে বিজিবির ‘লাইনম্যান’ বলা হয়। মইনুলের সহকারী হিসেবে রয়েছে হাসান, এরশাদ, সোহেল ও ফিরোজ।

অন্যদিকে ভারতীয় অংশে মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ী এনামুল হক ও বিশু বিএসএফের সহযোগিতায় চোরাই গরু বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। বিএসএফের সঙ্গে লেনদেন ফয়সালা করে এনামুলের ঘনিষ্ঠ মনোজ সানা। ভারতের ধাপরা কোচবিহার অংশে এই কাজে যুক্ত রাসেল, মিলন ও পাঁচমাইনের কাঙ্গুরু আহম্মেদ।

স্লিপ বাণিজ্য করে কোটিপতি

দহগ্রামে গরুর একটি স্লিপের মূল্য ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। এটি দেন দহগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান। অভিযোগ রয়েছে, চেয়ারম্যান হাবিবুর ছাড়াও দহগ্রাম ইউপির সদস্য, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের লোকজন মিলে তৈরি একটি সিন্ডিকেট সীমান্ত দিয়ে গরু পাচারে জড়িত। দীর্ঘদিন ধরে এই অবৈধ কাজ করে তারা কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

পাটগ্রামে সপ্তাহে হাট বসে দু’দিন, রোববার ও বৃহস্পতিবার। প্রতি হাটের দিন দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা থেকে ৩০টি গরু করিডোর পার করার অনুমতি (স্লিপ) দেওয়া হয়। এর মধ্যে চারটি স্লিপের টাকা নেন চেয়ারম্যান একা; একটি করে স্লিপের টাকা নেন ইউপি সদস্য ও সংরক্ষিত মহিলা সদস্যরা। স্লিপের টাকার সঙ্গে বিজিবির লাইন খরচ ও পুলিশ ফাঁড়ির জন্য দিতে হয় ১২ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে তিনবিঘা করিডোর পার করে পাটগ্রামে হাটে তুলতে একটি বড় গরুর পেছনে খরচ হয় ৫২ হাজার টাকার ওপরে। তারপরও প্রতি গরুতে চোরাকারবারিদের অন্তত ২০ হাজার টাকা লাভ থাকে বলে জানান স্থানীয়রা।

১৯৯২ সালের ২৬ জুন বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায় যাতায়াতের জন্য তিনবিঘা করিডোর খুলে দেওয়া হয়। এর পর থেকে সেখানকার কৃষকরা পাটগ্রাম হাটে নিয়ে তাঁদের গরু বিক্রি করতেন। কিন্তু এক সময় করিডোর দিয়ে গরু আনা বন্ধ করে দেয় বিএসএফ। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর আলোচনার মাধ্যমে ২০১১ সালে হাটের দিন ৩০টি করে মোট ৬০টি গরু কৃষকরা বিক্রির জন্য তিনবিঘা করিডোর পার করার অনুমতি পান। তবে সাধারণ কৃষকরা কখনোই এ সুযোগ নিতে পারেননি। চোরাকারবারিদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আগেই সব স্লিপ তাদের দিয়ে দেয় ইউনিয়ন পরিষদ। অনেকের অভিযোগ, উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের এতে সহযোগিতা রয়েছে।

তবে দহগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান দাবি করেন, ‘সরকার নির্ধারিত ফি ১২০ টাকার বেশি নেওয়া হয় না এবং এই এলাকা দিয়ে চোরাই গরু ঢোকে না।’ ইউনিয়ন পরিষদের কেউ ‘স্লিপ বাণিজ্য’ কর্মে জড়িত নন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সাধারণ কৃষকের কান্না

দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার কৃষকরা তাদের নিজেদের গরু হাটে তুলতে পারছেন না চোরাকারবারিদের কারণে। ওই ইউনিয়নে গরুর হাট নেই। করিডোর পার করে পাটগ্রাম হাটে গরু নিতে হয় তাদের। এ জন্য ইউপি চেয়ারম্যানের স্লিপ লাগে। কৃষক আনোয়ার হোসেন বলেন, তিনি ৮টি গরু পালন করেছেন। সম্প্রতি মেয়ের বিয়ের জন্য গরুগুলো বেচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চেয়ারম্যানের স্লিপ না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত বেচতে পারেননি। পরে ৪ মণ ওজনের একটি গরু জবাই করে বিক্রি করে পেয়েছেন মাত্র ৬০ হাজার টাকা। অথচ হাটে তুলতে পারলে গরুটি কমপক্ষে ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হতো। এলাকার আনছার মিয়া, আব্দুস সামাদ, হাফিজুর রহমান, রোকেয়া বেগম, হাসান আলীসহ অনেকেই বলেন, ‘স্লিপ বাণিজ্য’ তাদের ধ্বংস করে দিচ্ছে। বাড়িতে পালা গরু পানির দামে বেচতে হচ্ছে।

কাটা মাংসের ব্যবসা

দহগ্রামে কাটা মাংসের ব্যবসা বেশ রমরমা। প্রতি রাতে ভারত থেকে রোগাক্রান্ত গরু এনে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছাড়াই সেখানে জবাই করা হয়। সেই মাংস পরে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে চলে আসে। বিএসএফকে ফাঁকি দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি ভ্যান ও গাড়ির ব্যাটারির বক্সে আসে কাটা মাংস।

পাঁচ থেকে সাত মণ গরুর মাংস করিডোর পার করতে বিজিবির লাইনম্যানকে দিতে হয় দুই থেকে তিন হাজার টাকা। ওই টাকার ভাগ পায় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ ও পুলিশ ক্যাম্প। টাকা না দিলে তল্লাশি চৌকিতে মাংস আটকে দেওয়া হয়। স্থানীয়রা জানান, দুই বছর ধরে এভাবে গরুর মাংস পারাপার হচ্ছে।

ঘটনা স্বীকার করে চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, ‘কিছু গরু জবাই হয়– এটা ঠিক। রাতের আঁধারে গরু যেন জবাই না হয় তার জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

স্থানীয় মাংস বিক্রেতা মো. আমিনুল বলেন, করিডোর দিয়ে দহগ্রাম থেকে যে মাংস আসে সেগুলো প্রথমে পানবাড়ি বিজিবি বাজারে রাখা হয়। পরে পাটগ্রামের কসাইরা কম দামে কিনে সেগুলো হাট-বাজারে নিয়ে যায়। এই মাংস ঢাকার বিভিন্ন হোটেলের জন্যও পাঠানো হয় বলে জানান তিনি।

দায়িত্বপ্রাপ্তরা যা বলছেন

বিজিবি পানবাড়ি ক্যাম্প কমান্ডার নজরুল ইসলাম বলেন, দহগ্রামে গরু পালনকারী কৃষকের নাম, গরুর সংখ্যা, রং ও শনাক্তকরণ চিহ্ন আলাদাভাবে তাদের কাছে থাকে। তিনবিঘা করিডোর দিয়ে গরু পারাপারের সময় কৃষকের খাতা ও বিজিবির বই মিলিয়ে দেখে অনুমতি দেওয়া হয়। এখানে ইউনিয়ন পরিষদ চতুরতার আশ্রয় নিলে তাদের করার কিছু থাকে না। তবে নাম ও বর্ণনা না মিললে কোনো গরু করিডোর পার করার অনুমতি দেওয়া হয় না বলে জানান তিনি।

পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম জানান, তিনি এসব অভিযোগ শুনেছেন। এলাকায় নতুন হওয়ার পরও দুই দফা অভিযানে গিয়ে বিজিবি ও জনপ্রতিনিধিদের সঠিক নজরদারির অনুরোধ করেছেন। তার পরও এসব রোধ করা যাচ্ছে না।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.