খাদিজার ছাত্রত্ব কি বহাল থাকবে, মুশতাকের মৃত্যুর দায় কার

0
140
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় প্রায় এক বছর কারাবন্দী আছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে এক অনুষ্ঠানে তোলা ছবি, ছবি: সংগৃহীত

আর মাত্র ২০ দিনের মাথায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরার কারাগারে যাওয়ার এক বছর পূর্ণ হবে। খাদিজা বর্তমানে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে বন্দী। এক বছর ধরে মেয়ের অপেক্ষায় থাকা খাদিজার মা ফাতেমা খাতুন বলেছেন, মেয়েকে নিয়ে পুলিশ, আদালত ও কারাগারে ঘুরতে ঘুরতে তিনি ক্লান্ত। এই মানসিক চাপ আর নিতে পারছেন না।

গত বছর ২৮ আগস্ট রাতে খাদিজা ঢাকার মিরপুরে নিজেদের বাসায় ছিলেন। পুলিশ আসার পর খাদিজার মা ফাতেমা খাতুন জানতে পারেন, তাঁর মেয়ের নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে এবং সেই মামলায় আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। এরপর পুলিশ খাদিজাকে নিয়ে যায়। তখন থেকে মা ফাতেমার অপেক্ষা, তাঁর মেয়ে জামিন পেয়ে ঘরে ফিরবেন। আবার শুরু করবে লেখাপড়া। কিন্তু এক বছর ধরে মেয়েটির লেখাপড়া বন্ধ।

ফাতেমা বেগম বলেছেন, যতবার তিনি খাদিজার সঙ্গে দেখা করেছেন, ততবার মেয়ে প্রশ্ন করেছে, ‘মাগো, আমি কি আর লেখাপড়ার সুযোগ পাব না? আমি কি আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ক্লাস করার সুযোগ পাব না?’

এক বছর হতে চলল, আমার মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। ওর বন্ধুরা রোজ ভার্সিটিতে যায়, ক্লাস করে, পরীক্ষা দেয়। মেয়ে আমার লেখাপড়া করতে না পেরে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। দিনের পর দিন যদি সে ক্লাস করতে না পারে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে যায় কি না, সে ব্যাপারেও ভীষণ দুশ্চিন্তা করছে খাদিজা।

ফাতেমা খাতুন, খাদিজার মা

খাদিজার সঙ্গে মায়ের সর্বশেষ দেখা হয়েছিল গত ১১ জুলাই। সেদিন কারাগার থেকে খাদিজাকে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছিল। ওই সাক্ষাতে খাদিজার সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেন মা ফাতেমা খাতুন। এ ব্যাপারে ফাতেমাবলেন, ‘এক বছর হতে চলল, আমার মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। ওর বন্ধুরা রোজ ভার্সিটিতে যায়, ক্লাস করে, পরীক্ষা দেয়। মেয়ে আমার লেখাপড়া করতে না পেরে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। দিনের পর দিন যদি সে ক্লাস করতে না পারে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে যায় কি না, সে ব্যাপারেও ভীষণ দুশ্চিন্তা করছে খাদিজা।’

এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নঈম আকতার সিদ্দিক গতকাল মঙ্গলবার বলেন, ‘আমার জানামতে, কোনো শিক্ষার্থী যদি একটানা দুই বছর ক্লাস না করে, পরীক্ষা না দেয়, তাহলে ছাত্রত্ব বাতিল হওয়ার বিষয় সামনে চলে আসে। তবে আমাদের বিভাগের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরাও অনেক দিন থেকে জেলে আছেন, ক্লাস করতে পারেন না।’

অনলাইনে সরকারবিরোধী বক্তব্য প্রচারসহ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অভিযোগে ২০২০ সালের অক্টোবরে খাদিজা ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর দেলোয়ারের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পৃথক দুটি মামলা হয়। একটি রাজধানীর কলাবাগান থানায়, অপরটি নিউমার্কেট থানায়। দুটি মামলার বাদীই পুলিশ। ওই দুই মামলায় গত বছর ২৮ আগস্ট খাদিজাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

অনলাইনে সরকারবিরোধী বক্তব্য প্রচারসহ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অভিযোগে ২০২০ সালের অক্টোবরে খাদিজা ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর দেলোয়ারের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পৃথক দুটি মামলা হয়। একটি রাজধানীর কলাবাগান থানায়, অপরটি নিউমার্কেট থানায়। দুটি মামলার বাদীই পুলিশ। ওই দুই মামলায় গত বছর ২৮ আগস্ট খাদিজাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর থেকে তিনি কারাগারে আছেন।

শিক্ষার্থীদের ছাত্রত্ব বাতিল হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মো. ওহিদুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, কেউ যদি ভর্তি হওয়ার পর প্রথম দুই সপ্তাহ অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে ছাত্রত্ব বাতিল হবে। আর কেউ যদি দীর্ঘদিন ক্লাস না করে, পরীক্ষা না দেয়, সে ক্ষেত্রে তার ছাত্রত্ব থাকবে কি থাকবে না, সেটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়। তবে নিয়ম অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ছয় বছর পর শিক্ষার্থীর ছাত্রত্ব থাকে না।’

খাদিজার বোন সিরাজুম মুনিরা বলেন, ‘আমার বড় বোনের সঙ্গে দেখা হলে জানতে চাইছে, সে কি আর লেখাপড়ায় ফিরতে পারবে না? যদি সে ক্লাস করতে না পারে, পরীক্ষা দিতে না পারে, তাহলে তাঁর ছাত্রত্ব থাকবে কি না? কারাগারে থেকেই সে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারবে কি না? এমন অনেক বিষয় খাদিজা জানতে চায়। কিন্তু আমরা তো খাদিজার কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে পারছি না।’

খাদিজার শিক্ষক নঈম আকতার সিদ্দিক জানান, কারাগারে থাকা অবস্থায় কোনো শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। খাদিজার পক্ষ থেকে কোনো আবেদন হয়েছে কি না, সেটি তাঁর জানা নেই। এ ব্যাপারে খাদিজার বোন সিরাজুম মুনিরা বলেন, খুব শিগগির তিনি বোনের হয়ে জগন্নাথের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া অর্থাৎ পরীক্ষার নেওয়ার ব্যবস্থা করার অনুমতি চেয়ে আবেদন করবেন।

খাদিজার মা ফাতেমা বললেন, ‘আমার মেয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চায়। আমার মেয়ের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হোক।’

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি খাদিজার জামিন মঞ্জুর করেছিলেন হাইকোর্ট। তবে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে হাইকোর্টের জামিন আদেশ স্থগিত হয়। আপিল বিভাগে খাদিজার জামিন বিষয়ে সর্বশেষ শুনানি হয় গত ১০ জুলাই। আপিল বিভাগ খাদিজার জামিন প্রশ্নে শুনানি আরও চার মাস মুলতবি রেখেছেন।

‘মুশতাকের মৃত্যুর জন্য দায় কার’

লেখক মুশতাক আহমেদের আপন চাচাতো ভাই চিকিৎসক নাফিসুর রহমান। দুজনের বয়সের ব্যবধান মাত্র চার বছর। রাজধানীর লালমাটিয়ার বাসায় মুশতাক ও নাফিসুরের একসঙ্গে বেড়ে ওঠা। মুশতাকের বাবা আবদুর রাজ্জাক পেশায় ছিলেন একজন প্রকৌশলী। মা জেবুন্নেসা রাজ্জাক গৃহিণী।

মুশতাক আহমেদ ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে লেখাপড়া করেন। পরে তিনি চট্টগ্রামের একটি কলেজ থেকে স্নাতক পাস করে চাকরি নেন চা–বাগানে। পরে তিনি লেখাপড়ার জন্য যান ইংল্যান্ডে। বিদেশ থেকে ফিরে এসে তিনি চাকরি নেন জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরে। পরে তিনি ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। এরপর কুমির চাষ নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। মুশতাক আহমেদ দেশের প্রথম বাণিজ্যিক কুমির চাষের উদ্যোক্তা। ‘কুমির চাষির ডায়েরি’ নামে একটি বইও লেখেন।

সমাজ সচেতন মুশতাক আহমেদ চা–বাগান নিয়ে আরও একটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন। সেই বইয়ের চিত্রাঙ্কনের কাজটি কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর করছিলেন বলে জানান নাফিসুর রহমান। তিনি বলেন, প্রকাশিতব্য বইয়ের চিত্রাঙ্কনের জন্য কিশোর প্রায়ই মুশতাকের বাসায় আসতেন। দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। করোনার ওই সময়ে মুশতাকের একজন চিকিৎসক বন্ধু মারা যান। এসব নিয়ে মুশতাক তখন চিন্তিত ছিলেন। নিয়মিত ফেসবুকে লিখতেনও। হঠাৎ করে ২০২০ সালের ৪ মে লালমাটিয়ার বাসা থেকে মুশতাককে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে রমনা থানায় করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় লেখক মুশতাক আহমেদ, কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, ‘রাষ্ট্রচিন্তার’ সদস্য দিদারুল ইসলাম ভূঁইয়া ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নানকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ে গুজব, রাষ্ট্র ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে অপপ্রচার এবং বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়। গ্রেপ্তার হয়ে ৯ মাস কারাভোগের মধ্যে ছয়বার মুশতাক আহমেদের জামিন আবেদন নাকচ হয়। তাঁর মৃত্যুর মাত্র দুই দিন আগে (২০২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি) মুশতাকের সঙ্গে আদালতে দেখা হয় চাচাতো ভাই নাফিসুরের।

লেখক মুশতাক আহমেদ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারা হেফাজতে মারা যান ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। এর দুদিন আগে ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণে তোলা ছবি, পাশে তাঁর চাচাতো ভাই চিকিৎসক নাফিসুর রহমান
লেখক মুশতাক আহমেদ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারা হেফাজতে মারা যান ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। এর দুদিন আগে ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণে তোলা ছবি, পাশে তাঁর চাচাতো ভাই চিকিৎসক নাফিসুর রহমানছবি: সংগৃহীত

এ বিষয়ে নাফিসুর গতকাল বলেন, ‘তখন তো করোনার সময়। বিনা অপরাধে মুশতাককে বাসা থেকে ধরে নেওয়ার ৯ মাসের মধ্যে আমার দেখা হয়নি। তবে মৃত্যুর দুই দিন আগে আদালতে মুশতাকের সঙ্গে আমার দেখা হয়। মুশতাক আমাকে বলেছিল, তাঁর একটু ঠান্ডা। আর কোনো সমস্যা নেই। অথচ এর দুই দিন পর কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে মুশতাকের মৃত্যু হলো।’

নাফিসুর বললেন, ‘মুশতাক ও আমি একসঙ্গে বেড়ে উঠি। আমি ভালো করে মুশতাককে চিনতাম। জীবনে কোনো দিন কোনো ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সে জড়িত ছিল না। অথচ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করে মুশতাককে জামিন দিল না। সুস্থ মুশতাককে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর মুশতাক মৃত হয়ে আমাদের কাছে ফিরে এল। এই মৃত্যুর জন্য দায়ী কে?’

নাফিসুর বললেন, মুশতাকের মরদেহ যখন আজিমপুর কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন সেখানে দাঁড়িয়ে বাবা রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘কী কপাল আমার, বাবা হয়ে ছেলেকে কবর দিতে হচ্ছে। এই মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিচারের ভার আল্লাহর কাছে দিলাম।’

মুশতাকের বিশ্বাস ছিল, তিনি জামিন পেয়ে যাবেন। ষষ্ঠবার যখন তাঁর জামিন আবেদন নাকচ হয়, তখন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি।

মিনহাজ মান্নান, মুশতাকের সঙ্গে কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকা বন্দী

মুশতাকের মৃত্যুর শোক বুকে নিয়ে ৩৯ দিনের মাথায় তাঁর প্রকৌশলী বাবা আবদুর রাজ্জাক মারা যান। মুশতাক গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগের সময় স্ত্রী লোপা আক্তার মানসিক রোগে আক্রান্ত হন। স্ত্রীর এই খবর মুশতাককে অস্থির করে তুলেছিল। মুশতাকের মা জেবুন্নেসা রাজ্জাক বেঁচে আছেন। তবে স্বামী-সন্তান হারিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত তিনি।

মুশতাকের সঙ্গে কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারে চার মাস বন্দী ছিলেন মিনহাজ মান্নান। পরে মুশতাক, আহমেদ কিশোর ও দিদারুলকে গাজীপুরের হাইসিকিউরিটি কারাগারে নেওয়া হয়। মিনহাজ মান্নান গতকাল বলেন, ‘মুশতাকের বিশ্বাস ছিল, তিনি জামিন পেয়ে যাবেন। ষষ্ঠবার যখন তাঁর জামিন আবেদন নাকচ হয়, তখন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি।’

‘এমন পরিস্থিতি কখনোই চাইনি’

দেশি-বিদেশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে কল্পনাপ্রসূত অপপ্রচার চালানোর অভিযোগে পাঁচ বছর আগে (২০১৮ সালের ৫ আগস্ট) প্রখ্যাত আলোকচিত্রী শহিদুল আলম গ্রেপ্তার হন। তাঁর বিরুদ্ধে রমনা থানায় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা হয়। সেই মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। পাঁচ বছর ধরে তিনি ঢাকার আদালতে হাজিরা দিয়ে চলেছেন।

শহিদুল আলম গতকাল বলেন, বিতর্কিত তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার যে মামলার তদন্ত পাঁচ বছর ধরে চলমান, সেই মামলায় এখনো তাঁকে প্রতি মাসে হাজিরা দিতে হয়। অথচ বিতর্কের মুখে ৫৭ ধারাসহ আইসিটি আইনের কয়েকটি ধারা বাতিল করে সরকার।

ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন মন্তব্য করে আলোকচিত্রী শহিদুল আলম বলেন, ‘বাংলাদেশ সংবিধান আমাকে বাক্‌স্বাধীনতা দিয়েছে। সেই বাক্‌স্বাধীনতা কি আমরা পেয়েছি? মতপ্রকাশের জন্য মামলার মুখোমুখি হতে হয়, আইন বহির্ভূতভাবে গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করা হয়, বিনা বিচারে দিনের পর দিন কারাভোগ করতে হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো নিবর্তনমূলক আইন হয়, এমন পরিস্থিতি আমরা কখনোই চাইনি।’

আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার মামলায় ১০৭ দিন কারাভোগের পর শহিদুল আলম ২০১৮ সালের ২০ নভেম্বর জামিনে মুক্তি পান। ওই বছরের (২০১৮ সাল) অক্টোবরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়। এ অবস্থায় ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে থাকা ওই মামলার তদন্ত কার্যক্রমের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে শহিদুল আলম ২০১৯ সালের মার্চে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। একই বছরের ১৪ মার্চ হাইকোর্ট রুল দিয়ে তদন্ত কার্যক্রমের ওপর অন্তর্বর্তীকালীন স্থগিতাদেশ দেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে রিট খারিজ করে রায় দেন হাইকোর্ট। আর গত বছরের ২৭ নভেম্বর মামলার তদন্ত কার্যক্রমের বৈধতা নিয়ে রিট খারিজের বিরুদ্ধে আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের করা লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। মামলাটি এখনো তদন্তের পর্যায়ে রয়েছে।

‘মতপ্রকাশের প্রতিবন্ধক আইন আর নয়’

সমালোচনার মুখে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের (আইসিটি) ৫৭ ধারাসহ চারটি ধারা বাতিল করে ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করে সরকার। আইনবিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৫৭ ধারার অপরাধের যেসব উপাদান, সেটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের চারটি ধারায় (২৫, ২৮, ২৯ ও ৩১) সুকৌশলে অনুপ্রবেশ করানো হয়। ৫৭ ধারা কিংবা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের উল্লিখিত ধারা সংবিধানের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম বলেন, ‘একটা হাস্যকর ব্যাপার এই যে বিতর্কের মুখে ৫৭ ধারা বাতিল করল। অথচ সেই ৫৭ ধারার উপাদান ঢুকিয়ে দিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। আবার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সমালোচনা হলো, তখন সেটি বাতিলের কথা বলা হচ্ছে। অথচ নতুন সাইবার আইনে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা রেখে দেওয়া হচ্ছে। এটি তামাশা ছাড়া আর কিছু নয়।’

লেখক মুশতাক আহমেদসহ অনেক সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীর আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া গতকাল বলেন, জামিন ব্যক্তির আইনি অধিকার। অথচ মুশতাক আহমেদকে জামিন দেওয়া হয়নি। বিচার না পেয়ে কারাগারে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। মতপ্রকাশের জন্য মানুষকে বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। গ্রেপ্তার হয়ে মরে যেতে হচ্ছে। এর থেকে বেদনাদায়ক ঘটনা আর কী হতে পারে!

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘বহু বছর থেকে বলে আসছি, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা কিংবা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেক ধারাই সংবিধানের চেতনার সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। এমন আইন বিদ্যমান থাকলে মানুষ হয়রানির শিকার হতেই থাকবেন। এখন যেহেতু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের প্রসঙ্গ এসেছে সে কারণে এ আইনে হওয়া মামলাগুলো রাষ্ট্র নিজ উদ্যোগে প্রত্যাহার করতে পারে। একই সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়ে যাঁরা জেল খাটছেন, তাঁদের অবিলম্বে মুক্তির ব্যাপারে রাষ্ট্রের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।’

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা বহাল রেখে নতুন সাইবার আইন করা হলে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হবে না বলে উল্লেখ করেন আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তাঁর মতে, সংবিধানবিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে, অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ করে সংবিধানের চেতনার সঙ্গে যায়, এমন সাইবার আইন করা হলে তা মানুষ গ্রহণ করবে। এর বিপরীতে কিছু করা হলে মানুষ নতুন আইন গ্রহণ করবে না।

আসাদুজ্জামান

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.