কড়া বাধায় বড় জমায়েত জনভোগান্তিও বেশি

রাজশাহীতে বিএনপির গণসমাবেশ

0
167
রাজশাহী বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশে শনিবার বক্তব্য দেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

 

অন্য বিভাগের তুলনায় বিএনপির রাজশাহীর গণসমাবেশে বাধার মাত্রা ছিল সবচেয়ে বেশি। পরিবহন ধর্মঘট, মামলা-গ্রেপ্তার, পথে তল্লাশি-মহড়া, সমাবেশস্থলে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞাসহ সীমাহীন বাধা ছিল। এসব পেরিয়ে গতকাল শনিবার রাজশাহীতে বড় সমাবেশ করেছে বিএনপি। কিন্তু উত্তরবঙ্গের প্রধান শহর টানা তিন দিন সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় মারাত্মক দুর্ভোগ হয়েছে সাধারণ মানুষের।

দুপুর ২টায় সমাবেশ শুরুর শর্ত থাকলেও গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় কোরআন তিলাওয়াতে রাজশাহীর মাদ্রাসা মাঠে শুরু হয় গণসমাবেশ। আগের দিনগুলোতে প্রবেশ করতে না দিলেও গতকাল ভোর ৬টায় পুলিশ মাঠের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয়। এরপর শহরের বিভিন্ন এলাকায় তিন দিন ধরে অবস্থান নেওয়া বিএনপি কর্মীরা মিছিল করে সমাবেশস্থলে আসেন।

সকাল ১১টায় সমাবেশস্থল পূর্ণ ছিল বিএনপির নেতাকর্মীতে। আশপাশের দেড় কিলোমিটার এলাকার সড়কেও ছিল জমায়েত। প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে হত্যা, গুম, নির্যাতন, গায়েবি মামলা দিয়ে সরকার মনে করছে- বিএনপিকে শেষ করা যাবে।

কিন্তু মাটি ফুঁড়ে বিএনপি বেরিয়ে আসছে। ফিনিক্স পাখির মতো ছাইভস্ম থেকে উড়ছে। আওয়ামী লীগ প্রমোদ গুনছে, ভয় পাচ্ছে, ঘুম হারাম হয়ে গেছে।

সমাবেশে আসা নেতাকর্মীর ওপর নির্যাতনের অভিযোগ করে মির্জা ফখরুল পুলিশকে হুঁশিয়ার করে বলেন, জনগণের টাকায় বেতন পান। নিরীহ মানুষের ওপর নিপীড়ন চালান কেন? খবরদার- আর নিপীড়ন করবেন না! আপনারা জনগণের সেবক, উচিত ছিল সহযোগিতা করা। আপনারা পানির লাইন, বিদ্যুতের লাইন কেটে দিয়েছেন; রান্নার চুলায় পানি দিয়েছেন। আপনারা এত অমানুষ! এভাবে মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন! মানুষ কিন্তু অন্যায় সহ্য করবে না।

রাজশাহীতে ছিল বিএনপির নবম বিভাগীয় গণসমাবেশ। নেতাকর্মী হত্যার প্রতিবাদ, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ নানা দাবিতে গত ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামে সমাবেশের মাধ্যমে শুরু হয় বিএনপির কর্মসূচি। ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশে তা শেষ হবে।

গতকালের সমাবেশে মির্জা ফখরুল বলেছেন, ঢাকার গণসমাবেশ নিয়ে সরকার ভয় পেয়েছে। বিএনপি নয়াপল্টনে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে চায়। এতেও সরকার আতঙ্কিত। অতীতে নয়াপল্টনে বিএনপি অসংখ্য শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করেছে। এখন সরকার জঙ্গি ও আগুন সন্ত্রাসের নাটক শুরু করেছে। আওয়ামী লীগ নিজের প্রয়োজনে জঙ্গি সৃষ্টি করে। নিজেরাই বাস পুড়িয়ে অগ্নিসন্ত্রাস করে।

চট্টগ্রাম, কুমিল্লা বাদে অন্য সব সমাবেশের সময়ে একই কায়দায় পরিবহন ধর্মঘট ছিল। মহাসড়কে তিন চাকার যান চলাচল বন্ধের দাবিতে এসব ধর্মঘট ডেকেছিল সরকার সমর্থক পরিবহন মালিক শ্রমিক সংগঠনগুলো। অন্যান্য বিভাগে দুই দিন ধর্মঘট হলেও রাজশাহীর আট জেলায় হয়েছে তিন দিন। রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির বাসও এদিনগুলোতে চলেনি। অন্যান্য বিভাগের মতো এখানেও সমাবেশ শেষ হতেই সমাপ্তি হয় ধর্মঘটের। রাজশাহীতে সমাবেশের সময় বন্ধ ছিল মোবাইল ইন্টারনেট। সমাবেশস্থলের ব্রডব্যান্ড সংযোগ কেটে দেওয়া হয়।

আগের বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে সমাবেশস্থলেই রাত কাটিয়েছিলেন বিএনপির কর্মীরা। এ সুযোগ রাজশাহীতে না থাকায় হাজারো নেতাকর্মী সড়কে, মাঠে, ফুটপাতে তিন রাত কাটান। অনেকে শীতের রাত কাটান তাঁবুতে, গাছতলায়, পদ্মার পাড়ে। রান্না-খাওয়া, ঘুম, গোসল চলে ঈদগাহসহ বিভিন্ন মাঠে। সমাবেশস্থলে জমায়েত হতে না পারায় পুরো রাজশাহীই সমাবেশ, মিছিল ও স্লোগানের শহরে পরিণত হয়।

সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ: শুধু বাস নয়, ধর্মঘটে বন্ধ ছিল সিএনজি অটোরিকশা, মিশুকও। গতকাল সকাল ১০টা ও দুপুর ১২টার দিকে নগরীর নওদাপাড়া ও শিরোইল বাসস্ট্যান্ডে দেখা যায়, হাজারো মানুষ বাসের অপেক্ষায়।

শিরোইলে কথা হয় আলমগীর হোসেন নামের এক যাত্রীর সঙ্গে। তিনি জানান, তাঁর বাড়ি নওগাঁর মান্দায়। নারায়ণগঞ্জে গার্মেন্টসে সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করেন। অসুস্থ মাকে দেখতে গত বুধবার বাড়ি এসেছিলেন। রোববার কাজে যোগ করতে হবে। শনিবার ভোর ৫টায় বাড়ি থেকে বের হয়েছেন। বাস না পেয়ে তিন গুণ বেশি ভাড়ায় অটোরিকশায় নওগাঁ থেকে রাজশাহী এসেছেন। ৫ ঘণ্টা অপেক্ষা করে বাস পাননি।

দুপুর আড়াইটার দিকে রাজশাহী স্টেশনে গিয়ে যায়, ট্রেনের টিকিটের জন্য লম্বা লাইন। পুলিশ সদস্যরা ভিড় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। লাইনে দাঁড়ানো উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন জানান, বাস না পেয়ে স্টেশনে এসে ২ ঘণ্টা লাইন ধরেও ট্রেনের টিকিট পাননি।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বাস না চলায় রোগী ও স্বজনরা জিম্মি হয়েছেন রিকশা-অটোরিকশা চালকদের কাছে। দ্বিগুণ, তিন গুণ ভাড়া লাগছে। পায়ের অপারেশন শেষে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়ে বাড়ি ফেরার জন্য গাড়ি খুঁজছিলেন মহিদুল ইসলামের স্বজনরা। মহিদুল ইসলাম জানান, তাঁর বাড়ি গোদাগাড়ীর প্রেমতলীতে। অন্য সময় ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় অটোরিকশা পাওয়া যায়। কিন্তু শনিবার ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা ভাড়া চাওয়া হচ্ছে।

পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের রাজশাহী বিভাগীয় সভাপতি সাফকাত মঞ্জুর বিপ্লবের দাবি, গতকাল বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে বৈঠকে দাবি পূরণের আশ্বাস পেয়ে শনিবার ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়েছে।

বিভাগীয় কমিশনার জি এস এম জাফরুল্লাহ বলেছেন, দাবিদাওয়া নিয়ে এসেছিলেন পরিবহনের নেতারা। সরকারকে জানিয়ে সমাধানের আশ্বাস দিয়েছি।

পথে বাধা, হামলা পেরিয়ে সমাবেশে: হাজারো নেতাকর্মী মোটরসাইকেল, সাইকেল, হেঁটে আসেন। বগুড়া থেকে আসা সাইফুল ইসলাম বেলাল বলেন, পথে পুলিশ বাধা দিলেও নানা অজুহাত দিয়েছি। কিন্তু মোহনপুর এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা ওপর হামলা করে। কয়েকটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে।

বাঘা উপজেলার মনিগ্রাম ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হেলাল হোসেন রিয়েল বলেন, ১ হাজার ২০০ জন এসেছেন। মোড়ে মোড়ে পুলিশের চেকপোস্টে তল্লাশির কারণে পদ্মা নদী দিয়ে ট্রলারে এসেছেন। তার পরও পথে বাধা পেরোতে হয়েছে।

নাটোরের বাগাতিপাড়ার দয়ারামপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি সাজদার হোসেন বলেন, ৪৫০ জন এসেছি। ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের পাশে রাত কাটিয়েছি।

পাবনা জেলার আটঘরিয়ার একদণ্ড ইউনিয়ন থেকে আসা ৬৫ বছর বয়সী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ইউসুফ মিয়া (৬৫) জানান, ধর্মঘট হবে জেনেই গত মঙ্গলবার রাজশাহী আসেন। ঈদগাহ মাঠে খাওয়া-দাওয়া করেছেন। পাশের মসজিদে নামাজ আর পদ্মায় গোসল করেছেন।

জয়পুরহাট থেকে বুধবার আসা ৬৩ বছর বয়সী কৃষক আফজাল হোসেন জানান, পথে হামলা, গ্রেপ্তার, বাধার আতঙ্ক ছিল। তবে তাঁর পাল্টা প্রশ্ন ‘ডর করলে কি আইছি আমি?’

আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সীমাবদ্ধ: আগের দিনগুলোতে মহড়া দিলেও গতকাল আওয়ামী লীগের তৎপরতা দলীয় কার্যালয়ে সীমাবদ্ধ ছিল। বিএনপির গণসমাবেশকে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র আখ্যা দিয়ে সেখানে বিক্ষোভ সভা করে। এতে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনসহ মহানগরের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

পুলিশের কড়া নিরাপত্তা: নগরীতে দেড় হাজার পুলিশ মোতায়েন ছিল। ছিল র‌্যাবও। মাদ্রাসা মাঠের প্রধান ফটকে সিসি ক্যামেরাসহ দুটি আর্চওয়ে স্থাপন করে পুলিশ। মাঠে কাউকে লাঠি নিয়ে প্রবেশ করতে দেয়নি। রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক বলেন, সমাবেশের আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা ছিল। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।

মঞ্চে নেতাদের ঐক্য, মাঠে কর্মীদের মারামারি: রাজশাহী বিএনপি বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত থাকলেও প্রবীণ নেতা কবির হোসেনের সঙ্গে মিজানুর রহমান মিনু, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদের সঙ্গে সাবেক সভাপতি নাদিম মোস্তফা ছিলেন একমঞ্চে মিলেমিশে। কিন্তু নাদিম মোস্তফার বক্তব্য চলাকালে শোডাউন নিয়ে মাঠে কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। পরে নেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনবর্হাল ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবি পুনর্ব্যক্ত করে সমাবেশে মির্জা ফখরুল বলেন, অন্যথায় এ দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। ক্ষমতাসীনরা সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা টাকা পাচার করছে। ১১ বছরে ১৯ লাখ কোটি টাকা পাচার করেছে। তারা বলে, উন্নয়ন; কিন্তু চারদিকে হাহাকার। কৃষক সার পায় না, ফসলের দাম পায় না, ঘরে ঘরে চাকরি নেই।

স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, সরকার উস্কানি দিচ্ছে। বিএনপির নেতাকর্মী হত্যা করছে। মিথ্যা মামলা দিচ্ছে। এর পরও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছে বিএনপি। নেতাকর্মীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ফাঁদে পড়বেন না। দলের সিদ্ধান্ত মেনে চলবেন।

স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, ১০ ডিসেম্বর এক দফা আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা হবে।

স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু পুলিশের উদ্দেশে বলেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতে চাইলে উর্দি খুলে আসুন।

রাজশাহী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ আলী ঈশার সভাপতিত্বে সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু, শাহজাহান মিয়া, আব্দুল মান্নান তালুকদার, হাবিবুর রহমান হাবিব, কর্নেল (অব.) এম এ লতিফ খান, সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, রাজশাহীর সাবেক মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল প্রমুখ।

সৌরভ হাবিব, কামরুল হাসান ও নুরুজ্জামান, রাজশাহী থেকে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.