কাশ্মীর ঘিরে ভারত সরকারের চিন্তা বাড়াল লাদাখও

0
123
লাদাখের লেহ এলাকা, ছবি: রয়টার্স

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র আজ সোমবার বলেছেন, সম্মেলনের আয়োজকেরা বোঝার চেষ্টা করছেন, সেখানকার পরিস্থিতি কতটা জটিল, সংকট কতটা তীব্র। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ নিয়ে সরকারের এত দিনের সব দাবি অসাড় প্রতিপন্ন হতে পারে। আর সম্মেলন চলাকালে অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটলে দেশের ও সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। তাতে বরং হিতে বিপরীত হবে।

কেন্দ্রকে ‘না’ লাদাখ নেতাদের

সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজের পর গত সাড়ে তিন বছর ধরে জম্মু-কাশ্মীর পরিস্থিতি ভালো-মন্দ মিশিয়ে চললেও সম্প্রতি জম্মুর পরিস্থিতি সরকারের দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে। সেই সঙ্গে জট পাকিয়েছে লাদাখ। বৌদ্ধ ও শিয়া মুসলিম অধ্যুষিত এই বিস্তীর্ণ এলাকা ভূকৌশলগত কারণে বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছে। বিশেষ করে চীনের আগ্রাসনের কারণে।

জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য দ্বিখণ্ডিত করার সময় কেন্দ্রীয় সরকার লাদাখ অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হচ্ছে না বলে স্থানীয়রা মনে করছেন। তাঁদের মতে, সাড়ে তিন বছর ধরে তাঁদের সব বিষয়ে শুধু আশ্বাসই দেওয়া হচ্ছে।

এ অবস্থায় লাদাখের বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় ৭ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে। কিন্তু লাদাখের জনগণের প্রতিনিধিরা এতে যোগ দিতে অস্বীকার করেন। লাদাখ ও কারগিল ডেমোক্রেটিক জোটের নেতারা সর্বসম্মতভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, এই সরকার জনতাকে ধোঁকা দিয়েছে। তাঁরা আগের আমলে বরং অনেক ভালো ছিলেন।

উচ্চ পর্যায়ের ওই কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই। ১৭ সদস্যের ওই কমিটির অন্যরা হলেন লাদাখের বিজেপি আইনপ্রণেতা, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের উপরাজ্যপাল, লাদাখ ও কারগিল স্বশাসিত পরিষদের ৯ নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং ৫ জন প্রশাসনিক আমলা।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কাশ্মীরের নেতাদের বৈঠক

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কাশ্মীরের নেতাদের বৈঠক
ফাইল ছবি

রাজ্যের মর্যাদা দাবি

কমিটি গঠনের পরদিনই বৌদ্ধ সংগঠন ও স্বশাসিত পরিষদের নেতা চেরিং দোর্জে বলেন, ‘আমরা বারবার বলে আসছি, আমাদের স্বতন্ত্র রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হোক এবং লাদাখের জনগণকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্ভুক্ত করা হোক।’

চেরিং দোর্জে আরও বলেন, ‘সরকার এ দুটি বিষয়ে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে আসছে। ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় না এনে আমাদের জমি, সংস্কৃতি, ভাষা ও চাকরি রক্ষা সম্ভব নয়। সরকার আমাদের বোকা বানাচ্ছে।’ উল্লেখ্য, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় চার রাজ্য—আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামের উপজাতি এলাকাগুলো সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতায়। ওই এলাকাগুলো স্বশাসিত।

লাদাখ দুটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত—কারগিল ও লাদাখ। লাদাখে বৌদ্ধরা সংখ্যাগরিষ্ঠ আর কারগিলে মুসলিমরা। কারগিলের মুসলিমদের ৯৮ শতাংশ শিয়া। ডেমোক্রেটিক জোটের শিয়া নেতা সাজ্জাদ হুসেন বলেছেন, বৌদ্ধদের সঙ্গে তাঁরাও একমত। লাদাখকে পৃথক রাজ্য ও ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত না করা পর্যন্ত তাঁদের আন্দোলন জারি থাকবে।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র লাদাখের জনগণের এই দাবিকে ‘বোঝার ওপর শাকের আঁটি’ বলে মনে করছেন। সোমবার প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘জম্মুর সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নতুন ধাক্কা। এর সঙ্গে যুক্ত হলো এত দিন শান্ত লাদাখের অশান্তি। এই জোড়া অশান্তি নতুন বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য নতুন মাথাব্যথা।’

কংগ্রেসের পুরোনো নীতিতে বিজেপি

জম্মু-কাশ্মীরে নতুনভাবে অশান্তির শুরু গত বছরের মাঝামাঝি। তখন কাশ্মীর উপত্যকায় বেছে বেছে হিন্দু পণ্ডিত ও হিন্দু অভিবাসী শ্রমিকেরা খুন হতে থাকেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিশেষ উদ্যোগে যে পণ্ডিতদের উপত্যকায় চাকরি দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা জম্মুতে বদলির আন্দোলন শুরু করেন।

ইতিমধ্যে বহু পণ্ডিত কাশ্মীর উপত্যকা ছেড়ে জম্মু চলে যান। বেতন কাটার হুমকি দেওয়া সত্ত্বেও কেউ উপত্যকায় ফেরেননি। শ্রীনগরে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরাও গ্রামে বা জেলা সদরে কাজে যোগ দেননি। এ নিয়ে বিজেপির জম্মু নেতারাও সরকারি নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

এমন পরিস্থিতিতে জম্মুতে আকস্মিক ঘটে যায় সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা। বেছে বেছে সাতজন হিন্দুকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে। এই ঘটনা জম্মুর হিন্দু জনমতকেও সরকারের বিরুদ্ধে নিয়ে গেছে। তাঁরাও প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন সরকারের কাশ্মীর-নীতির সার্থকতা নিয়ে।

ভূকৌশলগত কারণে বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছে লাদাখ। বিশেষ করে চীনের আগ্রাসনের কারণে

ভূকৌশলগত কারণে বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছে লাদাখ। বিশেষ করে চীনের আগ্রাসনের কারণে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কংগ্রেস সরকারের প্রাচীন নীতি পুনরায় চালু করেছে। সীমান্তবর্তী অঞ্চল ও অন্যত্র সন্ত্রাসীদের রুখতে গ্রামরক্ষী বাহিনী গড়ে তাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দিয়েছে সরকার।

এই বাহিনীর জন্ম হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় গ্রামীণ জনতাকে এভাবে সংঘবদ্ধ করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময়েও জম্মু-কাশ্মীরের সীমান্তবর্তী এলাকায় তেমনই বাহিনী গড়া হয়েছিল। এরপর গ্রামরক্ষী বাহিনীর হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয় ১৯৯৩ সালে। উদ্দেশ্য ছিল, মুসলিমপ্রধান এলাকা থেকে হিন্দু হত্যা ও বিতাড়ন রুখতে। এই বাহিনীর সদস্যদের মাসিক বেতনও দেওয়া হতো। এই বাহিনীতে নেওয়া হতো প্রধানত অবসরপ্রাপ্ত সেনা ও পুলিশ সদস্যদের।

কিন্তু পরবর্তী সময়ে গ্রামরক্ষী কমিটির সদস্যদের অনেকের বিরুদ্ধে জোর করে টাকা আদায়, ডাকাতি ও ধর্ষণের মতো অভিযোগ উঠেছিল। বিচারে অনেকে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। ফলে একসময় এই বাহিনীর কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়।

কিছুটা চাপে পড়ে কেন্দ্রীয় সরকার জম্মুর হিন্দুদের রক্ষা ও সন্ত্রাসীদের মোকাবিলায় সেই পুরোনো প্রথা নতুন করে ফিরিয়ে এনেছে। সেই সঙ্গে উসকে দিয়েছে মোদি সরকারের কাশ্মীর-নীতির সার্থকতা ঘিরে নানা প্রশ্ন।

রাজনৈতিক দিক থেকেও জম্মু-কাশ্মীরে সরকার ও শাসক দল বিজেপি এখন ব্যাকফুটে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রা জম্মু-কাশ্মীরে ঢুকলে কী সাড়া ফেলবে, জনমনে কী প্রভাব ফেলবে আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এর প্রতিক্রিয়াই বা কেমন হবে, সেসব নিয়ে সরকার চিন্তিত।

ইতিমধ্যেই কংগ্রেস ছেড়ে যাওয়া গুলাম নবী আজাদের দল ভেঙে দলে দলে সাবেক কংগ্রেসিরা ঘরে ফেরা শুরু করেছেন। উপত্যকার সব দলও রাহুলের এই যাত্রাকে সমর্থন জানিয়েছে। দলীয় নেতারা যাত্রাসঙ্গী হবেন বলে জানিয়েছেন। সব মিলিয়ে কাশ্মীর নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা বেড়েই চলেছে।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

নয়াদিল্লি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.