সাড়ে ১৪ বছরে ১ লাখ কোটি টাকা কেন্দ্রভাড়া পেয়েছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র

0
104
পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।

বর্তমান সরকারের তিন মেয়াদে গত ৩০ জুন পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ/রেন্টাল পেমেন্ট) পেয়েছে দেশের বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। ৮২টি আইপিপি (স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী) ও ৩২টি রেন্টাল (ভাড়ায় চালিত) বিদ্যুৎকেন্দ্রকে এই টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।

জাতীয় সংসদে আজ মঙ্গলবার এক প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এসব তথ্য জানান। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বৈঠকের শুরুতে প্রশ্নোত্তর টেবিলে উত্থাপিত হয়।

গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান জানতে চান, বর্তমান সরকারের তিন মেয়াদে কোন কোন বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপরীতে কী পরিমাণ কেন্দ্রভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ) পরিশোধ করা হয়েছে? ওই সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক কোন কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান? তাদের সঙ্গে সরকারের চুক্তির শর্ত কী কী?

জবাবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ কেন্দ্রভাড়ার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। প্রতিমন্ত্রী কেন্দ্রভাড়ার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন।

প্রতিমন্ত্রীর তালিকা ধরে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র (আইপিপি) টাকা বেশি পেয়েছে। তারা হলো—
১. বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড ৭ হাজার ৪৫৫ কোটি ৩১ লাখ টাকা।
২. মেঘনা পাওয়ার লিমিটেড ৫ হাজার ৪৭৫ কোটি ১২ লাখ টাকা।
৩. রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড ৪ হাজার ৪ কোটি ৮ লাখ টাকা।
৪. সামিট মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটেড ৩ হাজার ৬৪৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।
৫. সেমক্রপ এনডব্লিউপিসি লিমিটেড ২ হাজার ৮২৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।
৬. এপিআর এনার্জি ২ হাজার ৭৮৮ কোটি ৪ লাখ টাকা।
৭. সামিট বিবিয়ানা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড ২ হাজার ৬৮৩ কোটি ৩ লাখ টাকা।
৮. হরিপুর পাওয়ার লিমিটেড ২ হাজার ৫৫৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।
৯. ইউনাইটেড আশুগঞ্জ এনার্জি লিমিটেড ২ হাজার ৩৭৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
১০. বাংলা ট্র্যাক পাওয়ার ইউনিট-১ লিমিটেড ১ হাজার ৮৫৩ কোটি ২২ লাখ টাকা।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, ফাইল ছবি

প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, বিগত তিন মেয়াদে ৩২টি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে (রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট) ভাড়া বাবদ দেওয়া হয়েছে ২৮ হাজার ৬৮৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে বেশি টাকা পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—
১. অ্যাগ্রেকো ইন্টারন্যাশনাল প্রজেক্টস (৫টি ইউনিট) ৬ হাজার ৪১১ কোটি ২২ লাখ টাকা।
২. অ্যাগ্রেকো ইন্টারন্যাশনাল প্রজেক্টস ২ হাজার ৩৪১ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
৩. কেপিসিএল (ইউনিট-২) ১ হাজার ৯২৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।
৪. সামিট নারায়ণগঞ্জ পাওয়ার লিমিটেড ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
৫. অ্যাগ্রেকো ইন্টারন্যাশনাল প্রজেক্টস (৮৫ মেগাওয়াট) ১ হাজার ৫৫৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা।
৬. ডাচ বাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড ১ হাজার ৫৩০ কোটি ৯ লাখ টাকা।
৭. অ্যাক্রন ইনফ্রাস্ট্রাকচার সার্ভিসেস লিমিটেড ১ হাজার ৪৮৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
৮. অ্যাগ্রেকো ইন্টারন্যাশনাল প্রজেক্টস (৯৫ মেগাওয়াট) ১ হাজার ৪৩৯ কোটি ১৯ লাখ টাকা।
৯. দেশ এনার্জি সিদ্ধিরগঞ্জ ১ হাজার ৩৯১ কোটি ২১ লাখ টাকা।
১০. ম্যাক্স পাওয়ার ১ হাজার ৩০৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।

শর্ত কী কী
প্রশ্নের জবাবে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপরীতে কেন্দ্রভাড়া পরিশোধ করা হয়েছে, সেসব কেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তির কিছু শর্তের কথা তুলে ধরেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

শর্তের মধ্যে রয়েছে বার্ষিক অ্যাভেইলেবিলিটি (প্রাপ্যতা) ৯০ শতাংশ থাকতে হবে। এর কম হলে কেন্দ্রভাড়া কাটা হয়। বার্ষিক ‘ডিপেন্ডেবল ক্যাপাসিটি টেস্ট’ (নির্ভরযোগ্যতার সক্ষমতা পরীক্ষা) সম্পাদন করতে হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার সময় ঝুঁকির নিরাপত্তায় বিমা করতে হবে।

উৎপাদনে থাকুক বা না থাকুক, চুক্তি অনুসারে কেন্দ্রভাড়া পায় সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্র, যাকে ক্যাপাসিটি চার্জ বলা হয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাপক উৎসাহ দেওয়া হয়। তখন থেকে এ খাতে দেশি বিনিয়োগ বাড়ে। সব মিলিয়ে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের মতো, যদিও বিদ্যুতের চাহিদা থাকে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের নিচে।

এখন যে মানুষকে বিদ্যুতের চড়া দাম দিতে হচ্ছে, তার একটি বড় কারণ বিদ্যুৎকেন্দ্রের অযৌক্তিক ভাড়া।এম শামসুল আলম, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)

ফলে সব সময়ই বিদ্যুৎকেন্দ্রের একাংশকে বসিয়ে বসিয়ে ভাড়া দিতে হয়। বছরে এর পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রভাড়া নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম বলেন, কেন্দ্রভাড়ার হার নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতিযোগিতাহীনভাবে, দায়মুক্তি আইনের অধীনে (বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ আইন)। ফলে বিনিয়োগকারীরা বেশি লাভবান হয়েছেন। তিনি বলেন, যে কেন্দ্র ভাড়া নেওয়া হয়েছে, ততটা বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়নি। ফলে উৎপাদনহীন অবস্থায়ও কেন্দ্রকে ভাড়া দিতে হয়েছে। এটা আরেকটা অন্যায়।

শামসুল আলম আরও বলেন, এখন যে মানুষকে বিদ্যুতের চড়া দাম দিতে হচ্ছে, তার একটি বড় কারণ বিদ্যুৎকেন্দ্রের অযৌক্তিক ভাড়া।

লোকসানে আরইবি, ডেসকো ও ডিপিডিসি
সরকারি দলের সংসদ সদস্য হাবিবর রহমানের প্রশ্নের জবাবে নসরুল হামিদ জানান, ২০২২-২৩ অর্থবছরে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) লোকসান হয়েছে ২ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। এ সময়ে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) লোকসান হয়েছে ২২৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। একই অর্থবছরের ৯ মাসে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) লোকসান হয়েছে ৪৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।

কাজিম উদ্দিন আহম্মেদের প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, প্রতিবেশী ভারত থেকে ৬টি চুক্তির মাধ্যমে ২ হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.