এবার টাঙ্গাইল শাড়ি ধরে টান ভারতের

0
61
ছবি: ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

বাঙালি নারীদের মাঝে টাঙ্গাইল শাড়ির আলাদা কদর রয়েছে। টাঙ্গাইলের তাঁতীদের বোনা শাড়ি নিয়ে হঠাৎ শুরু হয়েছে আলোচনা। কারণ, ভারত সরকার এ মাসের শুরুতে টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের স্থানীয় পণ্য হিসেবে জিওগ্র্যাফিক্যাল ইন্ডিকেশন বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ১ ফেব্রুয়ারি এক পোস্টে বলেছে, ‘টাঙ্গাইল শাড়ি পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্ভূত একটি ঐতিহ্যগত হাতে বোনা মাস্টারপিস। এর সূক্ষ্ম গঠন, স্পন্দনশীল রং এবং জটিল জামদানি মোটিফের জন্য বিখ্যাত– এটি এ অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও মাইক্রোব্লগিং সাইট এক্সে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। বাংলাদেশের বহু মানুষ এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সবশেষ গতকাল শনিবার টাঙ্গাইলে মানববন্ধনও হয়েছে। ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ওই পোস্টের মন্তব্যের ঘরে শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন মাহমুদ বলেন, ‌‘আপনাদের ধনেখালী আর আমাদের টাঙ্গাইল তাঁত মিলিয়ে ফেলছেন হয়তো। আশা করি, এই পোস্টটি সরিয়ে দু:খপ্রকাশ ও সঠিক তথ্য দিয়ে পোস্ট করবেন।’

পোস্টটি ঠিকই সরিয়ে ফেলা হয়েছে, কিন্তু দু:খপ্রকাশের কোনো বিষয় এখানে নেই। ভুলক্রমে এ ঘটনা ঘটানো হয়নি বলেই মনে হয়। ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জেনেবুঝেই টাঙ্গাইল শাড়ি’র জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর আগেও অসচেতনতার কারণে বাংলাদেশ অনেক পণ্যের জিআই হাতছাড়া করেছে। ভারত এর আগে বাসমতি চাল, নকশি কাঁথা, ফজলি আম, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সুন্দরবনের মধুসহ অনেক পণ্য জিআই করে নিয়েছে। এবার টান মেরেছে টাঙ্গাইল শাড়ি ধরে।

যেহেতু জিআই স্বীকৃতির পূর্বাপর প্রক্রিয়া সরকারের পক্ষ থেকে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকার কী করছে তা জানতে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) মো. মাহমুদ হোসেনের সঙ্গে কথা বলতে রোববার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ফোন করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি। তবে আজ রোববার সকালে এ বিষয়টি নিয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুর রউফের সঙ্গে তিনি আলোচনায় বসেছিলেন বলে জানা গেছে।

টাঙ্গাইল শাড়ির পুরনো ব্যবসায়ী মনে মন্টু বসাক টাঙ্গাইল থেকে বলেন, ‌‘টাঙ্গাইল শাড়ির মূল উৎপত্তিস্থল তো বাংলাদেশ। যখন দেশ এক ছিল এখান থেকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে টাঙ্গাইল শাড়ি বিক্রি করত। আমার জানা মতে, এর মূল দাবিদার বাংলাদেশ। এখানকার লোকজনই একাত্তরের ওই দেশের সরকার যদি এটা নিজেদের দাবি করে থাকে তাহলে বাংলাদেশ সরকার ব্যবস্থা নেবে।’

মনে মন্টু বসাক আরও বলেন, ‘টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশেই প্রথম প্রস্তুত হয়। আমাদের বাপ-দাদারা টাঙ্গাইল শাড়ি কলকাতায় নিয়ে গিয়ে বেচত, এটা বহু আগের কথা। টাঙ্গাইল শাড়ি টাঙ্গাইল থেকেই নামকরণ করা হয়েছে। এটা বললেই আমি বিশ্বাস করব না, এটা ইন্ডিয়ান। আপনি আরও দশজন মহাজনের সঙ্গে আলাপ করেন, সবাই একই কথা বলবে। যদি এটা বলে থাকে তাহলে ভারত এটা ভুল বলেছে।’

মনে মন্টু বসাক বলেন, ‌‘বাংলাদেশে তো এখন শাড়ির বাজার ভয়াবহ খারাপ। বাংলাদেশের শাড়ি ভারতে প্রচুর যায়, ওখানে যদি না যেত আমাদের ব্যবসা পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যেত। ভারতীয় শাড়ি দেশে অবাধে বিক্রি করতে দেওয়ায় এ অবস্থা হয়েছে। বিদেশে যত শাড়ি যায়, তার মধ্যে ভারতেই বেশি যায়। ওখানে অনেকে এটা বানানো বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের শাড়ির মানটা ভাল বিধায় ওখানে এটা বেশি চলে। তবে দামি দামি কিছু আইটেম যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশেই যায়।’

আরও পড়ুন: গর্বের ধন ‌‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ বেহাত হলো কার দোষে

ফ্যাশন ডিজাইনার, উদ্যোক্তা ও মডেল বিবি রাসেল বলেন, ‘টাঙ্গাইল শাড়ি নামই তো বলে দিচ্ছে এটা আমাদের, টাঙ্গাইল তো আমাদের এখানে। শাড়িটা মূলত বসাকরা করেন। বসাকদের কিছু দেশভাগের সময় ওদিকে চলে গেছেন, কিছু একাত্তরের পরেও চলে গেছেন। কিন্তু টাঙ্গাইল শাড়িটা একদমই আমাদের। আমি তো ভারত সরকারের আমন্ত্রণে ওদিকেও কাজ করেছি, ফুলিয়া শাড়ি নিয়ে। ওরা তো টাঙ্গাইল শাড়ি বলে না, অনেক নামেই ডাকে। কিন্তু টাঙ্গাইল বলতে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ নয়। যেমন জামদানি একদমই আমাদের। ভারত কীভাবে এটা বলতে পারে, আমি জানি না। এসব নিয়ে লড়তে হবে আমাদের সরকারের, আমি বললেই হয়ে যাবে না।’

‘ভারতেও কিন্তু সাধারণ যারা ক্রেতা টাঙ্গাইল শাড়ি বলতে আমাদের টাঙ্গাইলেরটাই বোঝেন, আমাদের এখান থেকে অনেক শাড়ি যায় এখন’, যোগ করেন বিবি রাসেল। তিনি আরও বলেন, ‘যখন আমি শাড়িটা বিক্রি করি, বলতে পারি টাঙ্গাইল শাড়ি বিবি রাসেলের ডিজাইন। কিন্তু টাঙ্গাইল শাড়ি তো টাঙ্গাইলেরই। বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত এটা, কোনোভাবেই তারা এটা নিতে পারে না। টাঙ্গাইল শাড়ি টাঙ্গাইল শাড়িই। একেকটা জিনিস একেক রকম। যেমন সিরাজগঞ্জের বেলকুচির শাড়ি, এটার আলাদা একটা ধরন আছে, আলাদা বুনন আছে। যেমন আমার নাম বিবি, হঠাৎ আপনি বললেন বানু। এটা তো হতে পারে না। যতক্ষণ না আমি বা আমার মা-বাবা আমার নামটা পরিবর্তন করি।’

সংস্কৃতিকর্মী ও অভিনেত্রী বন্যা মির্জার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘টাঙ্গাইল তো পশ্চিমবঙ্গে না, বাংলাদেশে। এখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ যদি হঠাৎ করে বলে ঢাকা শহরটা আমাদের, তাহলেই তো হয়ে গেল না। শাড়িটার শুরুই হয়েছে টাঙ্গাইলে। অতএব টাঙ্গাইল শাড়িটা বাংলাদেশেরই।’

ইয়াসির আরাফাত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.