এক টেবিলে বসেই চলত কপি-পেস্ট

সাখাওয়াত হোসেন জয়

0
114
ফিফার ৫১ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগের দুর্নীতির চিত্র। ক্রীড়াসামগ্রী ক্রয়, ফুটবলারদের পোশাক, ঘাস কাটার মেশিন, বিমানের টিকিট কেনা থেকে শুরু করে নারী দলের পেছনে খরচ এবং ক্লাবগুলোকে দেওয়া অনুদানে দুর্নীতির তথ্য-উপাত্তের বিষয়টি তুলে ধরে বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
ফিফা ফান্ডের অপব্যবহার, ভুয়া কাগজপত্র জমা দেওয়া এবং একই প্রতিষ্ঠানের তিনটি ভিন্ন নাম ব্যবহার করে দরপত্র আহ্বানে জালিয়াতি করার দায়ে সব ধরনের ফুটবল থেকে দুই বছরের জন্য সোহাগকে নিষিদ্ধ করে ফিফা। মূলত কোনো দরপত্র আহ্বান করলে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়। এর পরই চূড়ান্ত করা হয় কোন প্রতিষ্ঠান দরপত্র জিতেছে। কিন্তু ফিফার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এর কোনোটিই অনুসরণ করেনি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। বরং একই প্রতিষ্ঠানকে তিনটি ভিন্ন কোম্পানি হিসেবে দেখিয়ে দরপত্রে জালিয়াতি করেছেন সোহাগ।
এসব তিনি করতেন বাফুফেতে নিজের অফিস রুমে দরজা বন্ধ করে। সেখানে গোপনে দরপত্র আহ্বানকারী ব্যক্তিকে নিয়ে বৈঠক করতেন। একই আবেদনপত্র কপি-পেস্ট করা হতো তাঁরই সামনে। আর সে কারণে কোনো একটি আবেদনপত্রে কোনো বানান ভুল থাকলে সবকটিতেই সেটা থাকত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাফুফের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন সবকিছুই হতো এক টেবিলে বসে, ‘জালিয়াতি করে সে শাস্তি পেয়েছে। নিয়মমতো দরপত্র আহ্বান করতে হবে। কিন্তু সে (সোহাগ) এক জায়গায় বসে তিনজন মিলে এসব দরপত্রের কাজ করেছে। যে কারণে ফিফার কাছে সে দোষী প্রমাণিত হয়েছে।’
সেই তিনজনের বাকি দু’জন কে– সে নাম দুটি বলতে পারেননি কিংবা বলতে চাননি ওই কর্মকর্তা। সবকিছুই নাকি তিনি বলবেন তদন্ত কমিটির কাছে। ফিফার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে জালিয়াতির শুরুটা ২০১৬-১৭ সাল থেকে। সবই তদন্ত করেছে ফিফার অধিভুক্ত কন্ট্রোল রিস্ক গ্রুপ। ক্রীড়া পরিধেয় সামগ্রী কেনার জন্য ২০২০ সালের জুনে একটি দরপত্র আহ্বান করে বাফুফে। এই কেনাকাটার দরপত্রে স্পোর্টস লিঙ্ক, স্পোর্টস কর্নারে রবিন এন্টারপ্রাইজ নামের তিনটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়।
বিডিংয়ে মালামাল সরবরাহের কাজ পায় স্পোর্টস লিঙ্ক। ২০২০ সালের ৫ আগস্ট বাফুফে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সোহাগ ৩০ হাজার ২৭ ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩২ লাখ টাকা) মূল্যের পণ্য সরবরাহের কার্যাদেশ দেন। কিন্তু ২০২০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর কন্ট্রোল রিস্কের তদন্তে উঠে আসে, যে তিনটি প্রতিষ্ঠান বিড করেছিল সবকটিই একে অপরের সম্পূরক। কোনোটিতেই প্রতিষ্ঠানের সিল নেই এবং তিনটি প্রতিষ্ঠানই একই রকম কাগজ জমা দিয়েছে অর্থাৎ কপি- পেস্ট বলা চলে। আর সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, তিনটি বিডেই ‘কোটেশন’ শব্দের বানান ভুল ছিল।
এর পর ২০২১ সালের মার্চে ফিফার বিডিও এলএলপির নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও উঠে আসে সোহাগের জালিয়াতি। তিনটি দরপত্রের ডিজাইন একই রকম এবং রবিন এন্টারপ্রাইজের দরপত্রে যে ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে, সেটা ছিল ভুয়া। আর স্পোর্টস কর্নার ও স্পোর্টস লিঙ্ক পাশাপাশি ঠিকানায় অবস্থিত। আবার স্পোর্টস লিঙ্কের মালিক রবিন স্পোর্টস কর্নারের সাবেক কর্মচারী।
এসব দেখে ফিফার কমিটি নিশ্চিত হয়, দরপত্রের উৎস একই, তিনটি কোম্পানি আলাদা নয়। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে প্রায় ১৫ লাখ টাকা দামে ৪০০টি ফুটবল কেনে বাফুফে। এখানে মারিয়া ইন্টারন্যাশনাল, এইচ ইউ জামান ট্রেডিং ও ওফেলিয়াস ক্লোজেট দরপত্র জমা দিয়েছিল। টেন্ডার পায় ওফেলিয়াস। কিন্তু কন্ট্রোল রিস্কের প্রতিবেদনে উঠে আসা দরপত্র জেতা ওফেলিয়াসের ঠিকানার অস্তিত্ব নেই।
ফিফার তদন্ত কর্মকর্তারা দরপত্রের ফরমে দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে দেখেন, সেটা নারীদের পোশাক তৈরির প্রতিষ্ঠান। ফ্যাশন সাপ্লায়ার বাফুফেকে বল সরবরাহ করেছে। তাদের কোনো লাইসেন্স নেই। কোনো চালানপত্র ছাড়াই বাফুফে তাদের বিল পরিশোধ করেছে। আর বাকি দুই প্রতিষ্ঠান মারিয়া ও এইচ ইউ জামান ট্রেডিংয়ের খুঁজে পাওয়ার মতো কোনো তথ্য নেই। তারা দরপত্রে নিয়ম অনুযায়ী মূল কাগজপত্র জমা দেয়নি, ফটোকপির ওপর স্বাক্ষর করে জমা দিয়েছে দুই প্রতিষ্ঠান। এসব দেখে ফিফার বিশেষজ্ঞরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন, এক টেবিলে বসেই এই কোটেশন তথা দরপত্র তৈরি করা হয়েছে, যেখানে ঘষামাজারও প্রমাণ রয়েছে।
একই রকম কারসাজি হয়েছে বিমান টিকিটের ক্ষেত্রেও। জাতীয় দলের ওমান সফরের জন্য ২০১৯ সালে বিমানের টিকিটের জন্য দরপত্র আহ্বান করে বাফুফে। দরপত্রে প্রস্তাব দেয় আল মারওয়া, পূরবী ইন্টারন্যাশনাল ও মাল্টিপ্লেক্স ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস। নভেম্বরে ফ্লাইট টিকিট বাবদ আল মারওয়া ইন্টারন্যাশনালকে প্রায় সোয়া ২১ লাখ টাকা দেয় বাফুফে। কিন্তু ফিফার তদন্তে উঠে আসে গাফিলতি। তিনটি দর প্রস্তাবই শুরু হয়েছে একই কথা দিয়ে। সবকটিতেই ‘রুট’ বানানটি ছিল ভুল।
২০২০ সালে ঘাস কাটার জন্য দুটি দরপত্রের প্রস্তাব আহ্বান করে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। একটি বাংলাদেশ হার্ডওয়্যার এবং অন্যটি শোভা এন্টারপ্রাইজ। কাজটা পায় বাংলাদেশ হার্ডওয়্যার। কিন্তু কন্ট্রোল রিস্ক তদন্ত করে দেখতে পেয়েছে, দুটি প্রতিষ্ঠানের দরপত্র একই জায়গা থেকে করা হয়েছে। ফিফার তদন্ত সংস্থার রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর আসল তথ্য বের হতে শুরু করেছে। এতদিন সভাপতির কারণে সোহাগের বিষয়ে সবাই চুপ থাকলেও ফিফা থেকে নিষিদ্ধ হওয়ার পর আস্তে আস্তে তাঁর অপকর্মের বিষয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন অনেকে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.