একাত্তরের ইতিহাসের খোঁজে ফারজানা হক

0
124
তরুণ মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও কলেজশিক্ষক ফারজানা হক

প্রতিবছর বাংলা নববর্ষে দেশের তরুণ প্রতিভাবানদের নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে ‘ছুটির দিনে’। এবারও মুক্তিযুদ্ধ, গবেষণা, ক্রীড়া, সংগীত, চলচ্চিত্র, ভ্রমণ, ব্যবসা ক্ষেত্রে উজ্জ্বল আট তরুণের গল্প নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে—গাই তারুণ্যের জয়গান। মুক্তিযুদ্ধ বিভাগে পড়ুন গবেষক ফারজানা হকের গল্প।

ঠাকুরগাঁও সদরের বানিয়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রামটির নাম ময়নাপাড়া। ১৯৭১ সালের এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে এই গ্রামে বাঁশের ফলা দিয়ে বর্বর নির্যাতনের পর একই পরিবারের ১২ জনসহ মোট ২৫ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। সেই বর্বরতার কথা মানুষ ভুলেই গিয়েছিল। এই গণহত্যায় নিহতদের স্বজনদেরই স্বাধীনতার ৫০ বছর পর খুঁজে বের করেছেন ফারজানা হক। শুধু ময়নাপাড়াই নয়, ঠাকুরগাঁওয়ের বিভিন্ন উপজেলায় সংঘটিত ৪২টি গণহত্যা ও বধ্যভূমির বিস্মৃত ইতিহাস নতুন করে তুলে এনেছেন স্থানীয় ইতিহাসের এই গবেষক।

একাত্তরের প্রায় বিস্মৃত গণহত্যা, গণকবর, বধ্যভূমি খোঁজার পাশাপাশি ফারজানা সংগ্রহ করেন গণহত্যাসম্পর্কিত স্মৃতিস্মারক। এমন ২৯টি স্মারক তিনি দান করেছেন খুলনার গণহত্যা জাদুঘরে। কাজ করছেন গণহত্যা-বধ্যভূমি ও গণকবরের স্মৃতি সংরক্ষণে।

ফারজানা হকের জন্ম ঠাকুরগাঁওয়ে। তাঁর বাবা ফজলুল হক আয়কর আইনজীবী। মা সাহানা জেসমিন গড়েয়া ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ। ফারজানা হকও প্রভাষক হিসেবে কর্মরত বালিয়াডাঙ্গীর রত্নাই বোগুলাবাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজে। তাঁর স্বামী শফিকুল ইসলাম হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

নিজের জন্য কিনে রাখা কাফনের কাপড়টাও শেষযাত্রায় পাননি

মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ নজরুল ইসলামের কিনে দেওয়া শাড়িটি ফারজানা হকের হাতে তুলে দিচ্ছেন তাঁর স্ত্রী জরিফা খাতুন
মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ নজরুল ইসলামের কিনে দেওয়া শাড়িটি ফারজানা হকের হাতে তুলে দিচ্ছেন তাঁর স্ত্রী জরিফা খাতুনছবি: ফারজানা হকের সৌজন্যে

ঠাকুরগাঁওয়ে স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে পড়াশোনা করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। আমার ক্লাসের একনিষ্ঠ ছাত্রী। পড়াশোনা শেষ করেও গবেষণায় আগ্রহী, আমাদের দেশে এমনটা বিরল। আমি তাঁকে স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে কাজ করতে বললাম। এমফিল গবেষণায় ভর্তি হলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিষয় নির্ধারণ করে দিলাম, ‘বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার গণহত্যা ও গণকবর’। মূলত স্থানীয় ইতিহাসের গবেষক হিসেবে এখানেই ফারজানার পথচলার শুরু। কিন্তু অন্যরা যেভাবে মাঠ গবেষণা করে, ফারজানা সেখানে ব্যতিক্রম। নিজের এমফিলের পাশাপাশি গণকবর খুঁজে বের করা, স্মারক সংগ্রহ অনেকটা নেশার মতো পেয়ে বসে তাঁকে।

গণহত্যা জাদুঘরের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার পর আরও গতি পায় এই নেশা। জেলা পর্যায়ে গণহত্যা-গণকবর খুঁজে নেওয়ার একটি কর্মসূচি হাতে নেয় গণহত্যা জাদুঘর। পাশাপাশি চলছিল স্থানীয়ভাবে গণহত্যার নানা স্মারকসংগ্রহ। আমাদের এই কার্যক্রমেও যুক্ত হয় ফারজানা।

২০২০ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নের জন্য গঠিত জাতীয় কমিটির সদস্য হিসেবে যখন কাজ করছিলাম, ঠাকুরগাঁওয়ে আমাদের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয় ফারজানা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংজ্ঞার আলোকে তিনি প্রায় ২৫ জন নতুন শহীদ বুদ্ধিজীবী খুঁজে বের করেন। যাঁরা বুদ্ধিজীবী হিসেবে প্রায় অজানা ছিলেন।

নববধূর জন্য কেনা প্রথম শাড়িটা আর নিজ হাতে দেওয়া হলো না

ফারজানার সংগৃহীত স্মারকে খুঁজে পাওয়া যায় একাত্তরের জনযুদ্ধের স্মৃতি। নববধূর জন্য শহীদ যোদ্ধার কেনা শাড়ি, মুক্তিযুদ্ধের সময় নিশ্চিত মৃত্যু জেনে কিনে রাখা কাফনের কাপড়, মায়ের কাছে লেখা শহীদের চিঠি, বাবার শেষ স্মৃতি গামছা কিংবা কোনো শহীদের খাবার থালা সংগ্রহ করে হস্তান্তর করেছেন খুলনার গণহত্যা জাদুঘরে। নিত্যনতুন স্মারকে সমৃদ্ধ হয়েছে গণহত্যা জাদুঘরের সংগ্রহ। জাদুঘরে প্রদর্শিত সেসব স্মারকের কল্যাণে একাত্তরের গণহত্যার নানা আখ্যান জানতে পারছে, পারবে তরুণ প্রজন্ম।

মুক্তিযুদ্ধের অজানা ইতিহাস জানতে ঠাকুরগাঁওয়ের পথে-প্রান্তরে ছুটে বেড়াচ্ছেন ফারজানা। একাত্তরের স্মারক আর প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে লিখছেন আমাদের অভ্যুদয়ের রক্তাক্ত ইতিহাস। যেসব বয়ানে সমৃদ্ধ হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় ইতিহাস। পাশাপাশি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছেন অরক্ষিত গণহত্যা-বধ্যভূমি। ফারজানার স্মৃতি সংরক্ষণের এই উদ্যোগে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে গণহত্যা জাদুঘর ও স্থানীয় এনজিও ইএসডিও। তাদের সঙ্গে নিয়ে অরক্ষিত ১০টি বধ্যভূমিতে স্মৃতিফলক লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছেন ফারজানা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সন্ধানে তাঁর এই চেষ্টা দিনে দিনে আরও বিস্তৃত হবে।

লেখক: শিক্ষক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; ট্রাস্টি, ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.