উপবৃত্তির আওতায় আসছেন অনার্সের শিক্ষার্থীরাও

0
137
স্নাতক পর্যায়ের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দেবে সরকার

দেশের স্নাতক (সম্মান) বা অনার্সে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরাও সরকারের উপবৃত্তির আওতায় আসছেন। চার বছর মেয়াদি অনার্স কোর্সের পাশাপাশি এমবিবিএসের মতো পাঁচ বছর মেয়াদি কোর্সে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও পাবেন উপবৃত্তি। উপবৃত্তির জন্য বিবেচিত একেকজন শিক্ষার্থী কোর্স সম্পন্ন করা পর্যন্ত বছরে মোট পাঁচ হাজার টাকা করে পাবেন। নির্ধারিত কিছু শর্তের ভিত্তিতে উপবৃত্তির জন্য শিক্ষার্থী নির্বাচন করা হবে।

প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের অধীন দেওয়া হবে এ উপবৃত্তি। বর্তমানে এই ট্রাস্টের আওতায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন ষষ্ঠ থেকে স্নাতক (পাস) শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা উপবৃত্তি পান। আর প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের আলাদাভাবে উপবৃত্তি দেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনও নির্ধারিতসংখ্যক শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দেওয়া হয়।

প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) কাজী দেলোয়ার হোসেন ১৭ মে মুঠোফোনে বলেন, অনার্সের শিক্ষার্থীদেরও উপবৃত্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যেহেতু এখন উপবৃত্তি দেওয়ার কাজটি পুরোপুরি অনলাইনে হয়, তাই এই কাজে ডেটাবেজের প্রয়োজন আছে। কিন্তু দু-একটি ছাড়া কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষার্থীদের ডেটাবেজ নেই। এখন এই স্তরের শিক্ষার্থীদের আলাদা একটি সফটওয়্যার তৈরি করে তাঁদের উপবৃত্তি দেওয়া হবে।

তাঁরা আশা করছেন চলতি বছরই অনার্সের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দেওয়া শুরু করতে পারবেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ট্রাস্টের অপর এক কর্মকর্তা বলেন, আসন্ন নতুন অর্থবছর থেকে অনার্সের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দেওয়ার পরিকল্পনা আছে।

কারা উপবৃত্তি পাবেন

প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের সূত্রমতে, ইতিমধ্যে স্নাতক ও সমমানের (অনার্সসহ) স্তরের শিক্ষার্থীদের কীভাবে উপবৃত্তি দেওয়া হবে, তার একটি নির্দেশিকাও ঠিক করা হয়েছে। তাতে উপবৃত্তি পাওয়ার জন্য কিছু শর্ত মানতে হয়। শর্তগুলো হলো নিয়মিত শিক্ষার্থী হতে হবে, শ্রেণিকক্ষে কমপক্ষে ৭০ শতাংশ উপস্থিতি থাকতে হবে, আগের পরীক্ষায় ন্যূনতম ৬০ শতাংশ নম্বর বা জিপিএ–৩.৭৫ অথবা সিজিপিএ–৪–এর স্কেলে ৩ পেতে হবে। শিক্ষার্থীর পিতা–মাতা বা অভিভাবকের বছরে আয় ২ লাখ টাকার কম হতে হবে। এ ছাড়া সরকারি-আধা সরকারি-স্বায়ত্তশাসিত দপ্তর ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ১৩ থেকে ২০তম গ্রেডের (জাতীয় বেতন স্কেল-২০১৫ অনুযায়ী) কর্মচারীদের সন্তান উপবৃত্তি পাওয়ার জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।

এ ছাড়া বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন, এতিম, হিজড়া বা ট্রান্সজেন্ডার শিক্ষার্থী, ভূমিহীন পরিবারের সন্তান, বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা সন্তানের সন্তান, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ও দুস্থ পরিবারের সন্তান উপবৃত্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন।

স্নাতক পর্যায়ের বিবাহিত শিক্ষার্থীরা উপবৃত্তি পাবেন কি না, তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত এসেছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।

বর্তমানে দেশে ৫৪টি সরকারি এবং ১১২টি অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক (২০২১ সালের তথ্যের ভিত্তিতে) প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অধিভুক্ত কলেজসহ সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মোট শিক্ষার্থী ছিলেন ৪৪ লাখ ৪১ হাজার ৭১৭ জন।

অনার্সের শিক্ষার্থীদেরও উপবৃত্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যেহেতু এখন উপবৃত্তি দেওয়ার কাজটি পুরোপুরি অনলাইনে হয়, তাই এই কাজে ডেটাবেজের প্রয়োজন আছে কাজী দেলোয়ার হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব)

বছরে মোট কত শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পেতে পারেন, সেটি নির্ভর করছে কয়েকটি বিষয়ের ওপর। প্রথমত, শর্তগুলো পূরণ করতে হবে; দ্বিতীয়ত, প্রতি অর্থবছরে এ খাতে কত টাকা বরাদ্দ থাকে তার ওপর।

প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের স্থায়ী তহবিল হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সিড মানি (থোক বরাদ্দ) হিসেবে এক হাজার কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে। ব্যাংকে রাখা এই টাকার এফডিআর থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের উপবৃত্তি ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের এক কর্মকর্তা বলেন, এখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সরাসরি শিক্ষার্থীর হিসাব নম্বরে উপবৃত্তির টাকা দেওয়া হয়। এ জন্য শিক্ষার্থীকে সরাসরি অনলাইনে নির্ধারিত সফটওয়্যারের মাধ্যমে উপবৃত্তির জন্য আবেদন করতে হয়।

উপবৃত্তির টাকা বাড়ানোর পরামর্শ

প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের সূত্রমতে, প্রায় চার দশক ধরে জাতীয়ভাবে ছাত্রী উপবৃত্তি কর্মসূচি চলে আসছিল। নারী শিক্ষার সম্প্রসারণ ও গুণগত মান উন্নয়নের জন্য ১৯৮২ সালে চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলায় একটি পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে ছাত্রীদের নগদ সহায়তা দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর বিভিন্ন প্রকল্পের অধীন উপবৃত্তি দেওয়ার কার্যক্রম চলে। প্রথমে শুধু ছাত্রীদের উপবৃত্তি দেওয়া হলেও পরে ছাত্রদেরও উপবৃত্তির আওতায় আনা হয়।

প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত প্রাথমিক ও কারিগরি বাদে ষষ্ঠ থেকে স্নাতক (পাস) পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দেওয়া হয় এই ট্রাস্টের অধীন। তবে কারিগরি বিভাগের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তিও এই ট্রাস্টের অধীন আনার প্রক্রিয়া চলছে।

অনার্সের শিক্ষার্থীদেরও উপবৃত্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যেহেতু এখন উপবৃত্তি দেওয়ার কাজটি পুরোপুরি অনলাইনে হয়, তাই এই কাজে ডেটাবেজের প্রয়োজন আছে। কিন্তু দু-একটি ছাড়া কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষার্থীদের ডেটাবেজ নেই। এখন এই স্তরের শিক্ষার্থীদের আলাদা একটি সফটওয়্যার তৈরি করে তাঁদের উপবৃত্তি দেওয়া হবে।

কাজী দেলোয়ার হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব)

আলাদাভাবে না দিয়ে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তিও এই ট্রাস্টের অধীন নিয়ে এলে ভালো হয় বলে মনে করেন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কেউ কেউ।

২০১৩ সালে স্নাতক (পাস) পর্যায়ের ছাত্রীদের উপবৃত্তি দেওয়ার মাধ্যমে মূলত প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতে স্নাতকের শিক্ষার্থীদেরও একটি প্রকল্পের অধীন উপবৃত্তি দেওয়া হলেও সেটিও এখন এই ট্রাস্টের অধীন আনা হয়েছে। প্রথমে শুধু স্নাতক (পাস) শ্রেণির ছাত্রীদের উপবৃত্তি দেওয়া হলেও পরে ছাত্রদেরও এর আওতায় আনা হয়, যা এখন অনার্সের শিক্ষার্থীরাও পেতে যাচ্ছেন।

প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের এক কর্মকর্তা বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী উপবৃত্তির জন্য নির্বাচিত অনার্সে পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থী বছরে এককালীন ৫ হাজার টাকা পাবেন। এর মধ্যে উপবৃত্তির টাকা মাসে ২০০ টাকা করে বছরে ২ হাজার ৪০০, বই কেনার জন্য ১ হাজার ৬০০ টাকা এবং পরীক্ষার ফি বাবদ বছরে ১ হাজার টাকা পাবেন উপবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীরা।

এখন তিন বছর মেয়াদি স্নাতকের (পাস) শিক্ষার্থীরা প্রায় একই পরিমাণ টাকা পান।
অন্যদিকে, ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা প্রতি ছয় মাসে (বছরে দুবার দেওয়া হয়) উপবৃত্তি ও টিউশন ফি মিলিয়ে পায় ২ হাজার ৮২০ টাকা, অষ্টম শ্রেণিতে ৩ হাজার ৪২০ টাকা, নবম শ্রেণিতে ৪ হাজার ২০০ টাকা, দশম শ্রেণিতে ৫ হাজার ২০০ টাকা এবং উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞানে ৭ হাজার ২৬০ টাকা ও অন্যান্য বিভাগে ৬ হাজার ৫৮০ টাকা।
অর্থাৎ উপবৃত্তি ও টিউশন ফি মিলিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীর জন্য মাসে খরচ হয় ৪৭০ টাকা।

এদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, প্রাক্‌-প্রাথমিকের প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে মাসে ৭৫ টাকা করে, প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থী ১৫০ টাকা করে এবং এক পরিবারে দুজন শিক্ষার্থী থাকলে দুজন মিলে পাবে ৩০০ টাকা করে।

উপবৃত্তি দেওয়ার ফলে শিক্ষার্থীদের ভর্তির হার যেমন বেড়েছে, তেমনি ঝরে পড়াও কমেছে। এ ছাড়া ছাত্রীদের বাল্যবিবাহ বন্ধেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে এই উপবৃত্তি।
১৪ মে ঢাকায় শিক্ষাবিষয়ক একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেয় গাইবান্ধার ফুলছড়ির চরাঞ্চলের একটি বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী শিউলি আক্তার। সেদিন সে জানায়, বাল্যবিবাহের কারণে তার এলাকার অনেক ছাত্রী স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। তার সঙ্গে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির সময় যত ছাত্রী ছিল, তাদের অনেকে এখন দশম শ্রেণিতে নেই। শতভাগ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তির ব্যবস্থা করলে ছাত্রীরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে না।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীপ্রতি উপবৃত্তির টাকা আরও বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে আসছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

গণসাক্ষরতা অভিযানের উপপরিচালক কে এম এনামুল হক বলেন, প্রাথমিকে শিক্ষার্থীপ্রতি মাসে উপবৃত্তি ৫০০ টাকা এবং মাধ্যমিকে তা ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা করা উচিত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.