ইউক্রেনকে যে কারণে ‘বিতর্কিত’ ক্লাস্টার বোমা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

0
96
বিশ্বের ১২০টির বেশি দেশে ক্লাস্টার বোমার ব্যবহার, উৎপাদন ও মজুত নিষিদ্ধ, ফাইল ছবি: এএফপি

ইউক্রেনে ক্লাস্টার বোমা বা গুচ্ছ বোমা পাঠানোর ‘কঠিন সিদ্ধান্তের’ পক্ষে সাফাই গাইলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এই বোমায় প্রচুর বেসামরিক নাগরিক হত্যার রেকর্ড রয়েছে। আগামী সপ্তাহে লিথুয়ানিয়ায় ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলন শুরুর আগে এমন একটি সিদ্ধান্তের কথা জানাল যুক্তরাষ্ট্র।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘পরিস্থিতির বিবেচনা’ করে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কারণ ‘ইউক্রেনের গোলাবারুদ ফুরিয়ে’ আসছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ছবি: রয়টার্স

মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই ‘সময়োচিত’ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন ইউক্রেনের নেতারা। তবে রাশিয়া ওয়াশিংটনের এমন সিদ্ধান্তে ‘হতাশা’ ব্যক্ত করেছে।

ক্লাস্টার বোমা বিশ্বের ১২০টি দেশে নিষিদ্ধ।

বাইডেন গত মঙ্গলবার সিএনএনকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে তিনি মিত্রদেশগুলোর সঙ্গে কথা বলেছেন।

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকে হোয়াইট হাউসকে রাশিয়ার ক্লাস্টার ও ভ্যাকুয়াম বোমা ব্যবহারের অভিযোগ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তখন হোয়াইট হাউসের তৎকালীন প্রেস সেক্রেটারি বলেছিলেন, অভিযোগ সত্য হয়ে থাকলে এটি সম্ভাব্য ‘যুদ্ধাপরাধ’।

বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান গতকাল শুক্রবার হোয়াইট হাউসে ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘কর্মকর্তারা জানেন, ক্লাস্টার বোমার মধ্যে অবিস্ফোরিত বোমা বেসামরিক নাগরিকের জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এ কারণে আমরা যত দিন পেরেছি, এই বোমার ব্যবহার মুলতবি রেখেছি।’

সুলিভান বলেন, ইউক্রেনের গোলাবারুদ ফুরিয়ে আসছে। তাদের অস্ত্র সরবরাহ–ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন রাখা জরুরি। যুক্তরাষ্ট্র তার অভ্যন্তরীণ উৎপাদন জোরদার করেছে।

বাইডেনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, ‘এই সংঘাত চলাকালে আমরা ইউক্রেনকে কোনোভাবেই অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারি না।’

ক্লাস্টার বোমার ব্যর্থতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বির্তক চলছে। এই বোমা অনেক সময় বিস্ফোরিত হয় না। অবিস্ফোরিত অবস্থায় বছরের পর বছর মাটিতে পড়ে থাকে। পরে যেকোনো সময় নির্বিচার বিস্ফোরিত হয়ে থাকে।

বিশ্বের ১২০টির বেশি দেশে ক্লাস্টার বোমার ব্যবহার, উৎপাদন ও মজুত নিষিদ্ধফাইল ছবি: এএফপি
বিশ্বের ১২০টির বেশি দেশে ক্লাস্টার বোমার ব্যবহার, উৎপাদন ও মজুত নিষিদ্ধ, ফাইল ছবি: এএফপি

সুলিভান সাংবাদিকদের বলেন, রাশিয়া ইতিমধ্যে যুদ্ধে যেসব ক্লাস্টার বোমার ব্যবহার করেছে, ইউক্রেনে পাঠানো যুক্তরাষ্ট্রের বোমা তার চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ। সময়মতো বিস্ফোরিত হয় না, যুক্তরাষ্ট্রের এমন বোমার পরিমাণ ২ দশমিক ৫ শতাংশের নিচে। অন্যদিকে রাশিয়ার এমন বোমার পরিমাণ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ।

বাইডেনের এই উদ্যোগের ফলে মার্কিন আইনকে পাশ কাটিয়ে নিষিদ্ধ বোমা উৎপাদন, ব্যবহার বা স্থানান্তর করা হবে। এই বোমার অবিস্ফোরিত থেকে যাওয়ার হার ১ শতাংশের বেশি।

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকে হোয়াইট হাউসকে রাশিয়ার ক্লাস্টার ও ভ্যাকুয়াম বোমা ব্যবহারের অভিযোগ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তখন হোয়াইট হাউসের তৎকালীন প্রেস সেক্রেটারি বলেছিলেন, অভিযোগ সত্য হয়ে থাকলে এটি সম্ভাব্য ‘যুদ্ধাপরাধ’।

জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ে গতকাল বক্তব্য দেওয়ার সময় মার্তা হুর্তাদো বলেন, ‘এ ধরনের গোলাবারুদের ব্যবহার অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে এবং কোথাও এমন অস্ত্রের ব্যবহার করা উচিত নয়।

রাশিয়ার সমালোচনা

যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এই সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেছেন।

রাষ্ট্রদূত আনাতলি অ্যান্টোনভ বার্তা সংস্থাকে তাসকে বলেন, ওয়াশিংটন কিয়েভে যে মারণাস্ত্র পাঠাচ্ছে, সেটা তাদের ‘নিষ্ঠুরতা ও হতাশাকে’ তুলে ধরছে।

রুশ রাষ্ট্রদূত বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের দোষে দীর্ঘদিন বেসামরিক মানুষ জীবনের ঝুঁকির মধ্যে থাকবেন।

একসময় অবিস্ফোরিত বোমার বিস্ফোরণে বহু মানুষ হতাহত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইতিপূর্বে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনে প্রক্সি যুদ্ধ চালানোর অভিযোগ করেছিলেন।

ইউক্রেনের প্রশংসা

তবে রাশিয়া নাখোশ হলেও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ‘সময়মতো’ ৮০ কোটি ডলারের অতিপ্রয়োজনীয় সামরিক সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্তের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

এক টুইট বার্তায় জেলেনস্কি বলেন, ‘এই সহায়তা ইউক্রেনকে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসবে। একই সঙ্গে একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জয় হবে।’

গত মাসে রাশিয়ার সেনাদের বিরুদ্ধে ইউক্রেন পাল্টা হামলা শুরু করেছে। দোনেৎস্কের পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলীয় ঝাপোরিঝজিয়া অঞ্চলে তারা হামলা জোরদার করেছে।

ইউক্রেনের সেনাপ্রধান ভ্যালেরি জালুঝনি গত সপ্তাহে বলেন, পর্যাপ্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদের অভাবে অভিযান ব্যহত হচ্ছে। এ সময় পশ্চিমা বিশ্ব থেকে অস্ত্র সরবরাহে ধীরগতির জন্য হতাশা ব্যক্ত করেন তিনি।

গতকাল পেন্টাগনের মুখপাত্র কলিন কাহল প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ইউক্রেনের জন্য পাল্টা আক্রমণ এতটা সহজ হবে না। কারণ, রুশরা সেখানে ছয় মাসের বেশি সময় ধরে অবস্থান করছে।

কলিন বলেন, অস্ত্র সরবরাহ কিছুটা ধীর হওয়ার কারণ হলো গোলাবারুদের জন্য অনেক বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে।

ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্র্যাট সদস্য বারবারা লি প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে উল্লেখ করেছেন। মিনেসোটার ডেমোক্র্যাট সদস্য বেটি ম্যাককোলাম বলেন, এটি ‘ভয়ংকর ভুল’ হবে।

ম্যাসাচুসেটসের আরেক ডেমোক্র্যাট সদস্য ম্যাক গোভার্ন বলেন, ‘সংঘাত শেষ হয়ে গেলেও’ এ ধরনের দীর্ঘদিন অবিস্ফোরিত বোমা বেসামরিক নাগরিকদের জন্য বিরাট ঝুঁকির।

তবে ওয়াশিংটনে হাউস আর্মড ফোর্সেস কমিটির সদস্য অ্যাডাম স্মিথ বিবিসিকে বলেন, হোয়াইট হাউস ‘সঠিক সিদ্ধান্তই’ নিয়েছে।

স্মিথ বলেন, ‘ইউক্রেনের হারানো ভূখণ্ড ফিরে পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা বেসামরিক নাগরিক হতাহতের পরিমাণ যতটা সম্ভব কমাতে সহায়তা করতে পারি।’
ন্যাটোর মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ বলেন, ক্লাস্টার বোমার ক্ষেত্রে সামরিক জোট কোনো অবস্থান নেয়নি।

১২০টির বেশি দেশ ক্লাস্টার বোমাসংক্রান্ত সনদে স্বাক্ষরের মাধ্যমে অঙ্গীকারাবদ্ধ, তারা এ ধরনের বোমা ব্যবহার, উৎপাদন, স্থানান্তর বা মজুত করবে না। তবে যুক্তরাষ্ট্র, ইউক্রেন ও রাশিয়া এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি।

এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ জার্মানি বলেছে, তারা ইউক্রেনকে এ ধরনের বোমা সরবরাহ করবে না। তবে তারা যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.