আরববলয়ে বাশার, যুক্তরাষ্ট্রের কপালে ‘ভাঁজ’

0
91
সৌদি আরবের জেদ্দা বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে স্বাগত জানানো হয়। ১৮ মে

এক যুগের বেশি সময় সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে একঘরে রেখেছিল আরব বিশ্ব। কিন্তু সে অবস্থান থেকে সরে এসেছেন আরব নেতারা। চলতি সপ্তাহেই সৌদি আরবের জেদ্দায় আরব লিগের শীর্ষ সম্মেলনে বাশারকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হলো।

আনুষ্ঠানিকভাবে বাশারের আরববলয়ে ফেরার বিষয়টিকে একটা সময় অসম্ভবই মনে করা হতো, তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘হিসাব’ মেলাতে পারছে না যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্লেষকেরা বলছেন, দামেস্কের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক যাতে আবার স্বাভাবিক না হয়, ওয়াশিংটন বরাবরই সে চেষ্টা করে গেছে। কিন্তু তাদের আরব মিত্রদের সিরিয়ার সঙ্গে পুনরায় গাঁটছড়া বাঁধার বিষয়টিকে ঠেকাতে পারেনি তারা।

মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, বাশারের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের আগে তারা আবর দেশগুলোর সঙ্গে মিলে বেশ কিছু লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কাজ করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে সংঘাতপূর্ণ এলাকাগুলোয় মানবিক সহায়তার পরিধি বাড়ানো, জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখা, ইরানের প্রভাব কমানো এবং মাদক পাচারে লাগাম টানা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এর কতটা কী পরিবর্তন ঘটবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইউএস ইনস্টিটিউট অব পিসের (ইউএসআইপি) মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাকেন্দ্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোনা ইয়াকোবিয়ানের মতে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্র ‘একটা কৌশলী ও জটিল চ্যালেঞ্জের’ মুখে পড়েছে। তাঁর ভাষায়, ‘সম্ভবত বাইডেন প্রশাসনের হিসাবটা এমন যে ‘ঠিক আছে, অঞ্চলটি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক দিকে যাচ্ছে। হয়তো এখান থেকে পরে কোনো কিছু পাওয়া যেতে পারে, অতএব আপাতত ছাড় দাও।”’

তবে বাশার সরকারের অন্যায়ের প্রতিকার করা ছাড়া ওয়াশিংটনের পক্ষে দামেস্কের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করাও সম্ভব নয়। অথবা সিরিয়ার ওপর আরোপ করার কঠোর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়াও অসম্ভব।

এ ক্ষেত্রে মোনা ইয়াকোবিয়ান কিউবা, উত্তর কোরিয়াসহ অন্যান্য দেশের উদাহরণ টেনে বলেন, এসব দেশের সঙ্গেও সম্পর্কের প্রশ্নে ওয়াশিংটন কয়েক দশক ধরে একই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েছে।

বাশারের প্রত্যাবর্তন

২০১১ সালের আরব বসন্তের হাওয়া লেগেছিল সিরিয়াতেও। দেশটিতে ছড়িয়ে পরে সরকারবিরোধী আন্দোলন। ওই আন্দোলন কঠোর হাতে দমন শুরু করে বাশার সরকার। এর জেরে ছড়িয়ে পড়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এ অবস্থায় আরব লিগ থেকে সিরিয়াকে বহিষ্কার করা হয় এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলো সিরিয়াকে বর্জন করে।
এক যুগে গড়ানো সিরিয়া যুদ্ধে কয়েক লাখ মানুষের প্রাণ গেছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়া ও ইরানের সহায়তায় সিরিয়ার সরকারি বাহিনী বহু বেহাত হওয়া এলাকা পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়েছে। তবে এখনো দেশটির বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন বিদ্রোহী ও সশস্ত্র গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

এরই মধ্যে সিরিয়ার ওপর আরোপ করা নিধেষাজ্ঞা ও অবরোধগুলো আরও কঠোর করার উদ্যোগ নিয়েছে মার্কিন কংগ্রেস। পাশাপাশি আঞ্চলিকভাবে বাশারের সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন মার্কিন আইনপ্রণেতারা। গত সপ্তাহে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান—উভয় দলের একটি প্রতিনিধিদল কংগ্রেসে একটি বিল উত্থাপন করেছে। ‘আসাদ অ্যান্টি-নর্মালাইজেশন অ্যাক্ট’ নামের ওই বিলের লক্ষ্য—‘সিরীয় নাগরিকদের বিরুদ্ধে করা অপরাধের জন্য বাশার সরকার ও তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে সমুচিত পদক্ষেপ নেওয়া এবং বাশার সরকারের সঙ্গে অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধা দেওয়া।’

এ পটভূমিতে চলতি মাসে আরব লিগে আবার জায়গা ফিরে পায় সিরিয়া। ১৮ মে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ আরব লিগের শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে সৌদি আরবে পা রাখেন। এর আগে কয়েক সপ্তাহ ধরে রিয়াদ ও দামেস্কের মধ্যে দফায় দফায় কূটনৈতিক আলোচনা হয়েছে।

যদিও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন গত সপ্তাহে বেশ জোরের সঙ্গেই বলেন, সিরিয়ার পুনরায় আরব লিগে যোগদানের কোনো তাৎপর্য আছে বলে তাঁরা বিশ্বাস করেন না। তাঁর কথায়, ‘আমরা আমাদের আঞ্চলিক সহযোগীদের বিষয়টি পরিষ্কার করে বলেছিলাম, কিন্তু তাঁরা তাঁদের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে আমাদের অবস্থানও পরিষ্কার—আমরা বাশারের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে যাচ্ছি না।’
তবে ব্লিঙ্কেন এখনো মনে করেন, সিরিয়া বিষয়ে ওয়াশিংটন ও আরব মিত্রদের মধ্যে বৃহত্তর অভিন্ন লক্ষ্য রয়েছে।

মার্কিন কংগ্রেস বনাম বাশার

ভিন্ন মতাবলম্বীদের গুম করা, বেসামরিক এলাকায় রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারসহ মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের প্রেক্ষাপটে বাশার খলনায়ক হয়ে ওঠেন, বিশেষ করে পশ্চিমাদের কাছে।

এরই মধ্যে সিরিয়ার ওপর আরোপ করা নিধেষাজ্ঞা ও অবরোধগুলো আরও কঠোর করার উদ্যোগ নিয়েছে মার্কিন কংগ্রেস। পাশাপাশি আঞ্চলিকভাবে বাশারের সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন মার্কিন আইনপ্রণেতারা। গত সপ্তাহে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান—উভয় দলের একটি প্রতিনিধিদল কংগ্রেসে একটি বিল উত্থাপন করেছে। ‘আসাদ অ্যান্টি-নর্মালাইজেশন অ্যাক্ট’ নামের ওই বিলের লক্ষ্য—‘সিরীয় নাগরিকদের বিরুদ্ধে করা অপরাধের জন্য বাশার সরকার ও তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে সমুচিত পদক্ষেপ নেওয়া এবং বাশার সরকারের সঙ্গে অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধা দেওয়া।’

সর্বশক্তি নিয়ে সিরিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপে কংগ্রেস যে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ওপর চাপ প্রয়োগ করবে—এই বিল তার ইঙ্গিত বলেই মনে করেন ম্যাসাচুসেটসের স্মিথ কলেজের মিডল ইস্ট স্টাডিস প্রোগ্রামের পরিচালক স্টিভেন হেইডেম্যান।
তবে ওকলাহামা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডল ইস্ট স্টাডিস সেন্টারের পরিচালক জশুয়া ল্যানডিস সিরিয়ার ওপর আরোপ করা যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধসহ দেশটির বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনের নেওয়া অবস্থান নিয়েই প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, ওয়াশিংটন এরই মধ্যে স্বীকার করেছে যে তারা বাশারকে টলাতে পারছে না এবং তাদের আরোপ করা অবরোধ সিরীয় নাগরিকদেরই কষ্ট দিচ্ছে। তার আঁচ বাশার সরকারের গায়ে লাগছে না।

জশুয়া ল্যানডিসের কথায়, ‘আরব দেশগুলো বুঝে গেছে, বাশার ক্ষমতা ছাড়ছেন না। সিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে তাদের সেই উপলব্ধিই প্রকাশ পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রেরও বিষয়টি বোঝা উচিত।’

আরব লিগের শীর্ষ সম্মেলনের আগে সম্মিলিতভাবে ছবি তোলার জন্য দাঁড়ান সদস্যদেশগুলোর নেতারা। সৌদি আরবের জেদ্দা, ১৮ মে
আরব লিগের শীর্ষ সম্মেলনের আগে সম্মিলিতভাবে ছবি তোলার জন্য দাঁড়ান সদস্যদেশগুলোর নেতারা। সৌদি আরবের জেদ্দা, ১৮ মে

যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সিরিয়া প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে কী অবস্থান নেবে, তা সময় বলে দেবে। তবে বাস্তবতা এটাই, বাশারের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের বিষয়টি অঞ্চলটিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবের অধোগতির ইঙ্গিত দিচ্ছে।

তাঁরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে মার্কিন সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি থাকার পরও যুক্তরাষ্ট্রই যে কেবল অঞ্চলটিতে ছড়ি ঘোরাতে পারে, ব্যাপারটি তা নয়। চলতি বছরের গোড়াতেই ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে চুক্তি হলো এবং এর ফলে চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হলো।

মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি এখনো শক্তিশালী উল্লেখ করে স্মিথ কলেজের মিডল ইস্ট স্টাডিস প্রোগ্রামের পরিচালক স্টিভেন হেইডেম্যান বলেন, ওয়াশিটংন এশিয়াকে অগ্রাধিকার দিয়ে তাদের পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করছে এবং তাদের বেইজিংয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে।

আর ইউএসআইপির মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা কেন্দ্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোনা ইয়াকোবিয়ান বলছেন, ‘বহুমেরুর (মাল্টিপোলার) যুগে’ প্রবেশ করছে মধ্যপ্রাচ্য। অঞ্চলটির নেতারা তাঁদের সমস্যাগুলোর সমাধানে নিজেরাই সচেষ্ট হয়েছেন। ইয়াকোবিয়ানের ভাষায়, ‘বাশারের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন তার একটি উদাহরণ।’

নিজেদের কর্মফলেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমছে বলে ওকলাহামা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডল ইস্ট স্টাডিস সেন্টারের পরিচালক জশুয়া ল্যানডিসের পর্যবেক্ষণ। তিনি বলেন, ‘তারা (যুক্তরাষ্ট্র) একের পর এক ভুল করেছে।’

ল্যানডিস আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ হস্তি ইরাকের মতো একটি দেশকে ধ্বংস করে দিতে পারে, অথবা লিবিয়ায় গোলযোগ বাধিয়ে দিতে পারে, আফগানিস্তানকে নাস্তানাবুদ করতে পারে। কিন্তু কোনো অগ্রগতি ঘটাতে না পেরে তারা নিজেরা পিছুও হটে। গণতন্ত্র্র প্রতিষ্ঠা বা মানবাধিকার রক্ষার যত প্রতিশ্রুতি তারা দিয়েছিল, বাস্তবে তার উল্টোটিই ঘটেছে। ফলে লোকজন এসব কথা শুনতে শুনতে এখন ক্লান্ত।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.