আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে কী হচ্ছে

0
195
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ

রাজধানীর মতিঝিলের খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রীর দুটি ভিডিও ফুটেজ গত কয়েক দিনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছে। প্রথম ফুটেজে দেখা যায়, কিশোরী ওই শিক্ষার্থী সড়কের পাশে দৌড়ে গিয়ে ষাটোর্ধ্ব এক পুরুষের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার বুকে মাথা রাখছে। পুরুষটি আলতো করে জড়িয়ে ধরে ছেড়ে দিচ্ছে। দ্বিতীয় ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, একই ছাত্রী একটি গাড়ির ভেতরে কান্না করছে, কারও সঙ্গে অভিমান করছে। একজন পুরুষ (কণ্ঠ শোনা গেলেও ভিডিওতে তাকে দেখা যাচ্ছে না) তাকে আদর করে খাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিশোরীর অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা করছে।

প্রথম ফুটেজে যাঁর বুকে কিশোরী ছাত্রী মাথা রেখেছে, তাঁকে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সবাই চেনেন। তিনি প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের দাতা সদস্য খন্দকার মুশতাক আহমেদ। দ্বিতীয় ফুটেজের পুরুষটিকে দেখা না গেলেও কণ্ঠটি খন্দকার মুশতাক আহমেদের এবং আর গাড়িটি তাঁরই বলে দাবি করেছেন প্রতিষ্ঠানটির অনেক শিক্ষক ও অভিভাবক।

অপ্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রীর সঙ্গে খোদ পরিচালনা পর্ষদের প্রবীণ একজন সদস্যের এ ধরনের সম্পর্কের বিষয়টি ফাঁস হওয়ার পর ফুঁসে উঠেছেন প্রতিষ্ঠানটির অভিভাবকরা। তাঁরা এ ঘটনার বিচার দাবি করেছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে গেল ৩১ মে পরিচালনা পর্ষদের সভায় বিস্তারিত আলোচনা শেষে ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মমতাজ বেগমকে দিয়ে এক সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে অপ্রাপ্তবয়স্ক ওই ছাত্রীকে ‘বিয়ে’ করে নিয়েছে বলে দাবি করেছে প্রতিষ্ঠানটির অভিভাবক ফোরাম। তবে বিয়ে করার বিষয়টি স্বীকার বা অস্বীকার কোনো কিছুই না করে অভিযুক্ত খন্দকার মুশতাক আহমেদ গতকাল মঙ্গলবার বলেন, ‘বিয়ে করার বিষয়টি নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। আমি স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটিই করছি না। তবে মেয়েটি নাবালিকা বা অপ্রাপ্তবয়স্ক নয়। আমি তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে তার জন্মসনদ নিয়ে দেখেছি। তার সঠিক বয়স ১৮ বছর চার মাস।’ ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হওয়ার বিষয়টি ষড়যন্ত্রমূলক বলে দাবি করেন তিনি।

এদিকে, চলতি বছর জানুয়ারিতে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিভিন্ন শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর ভর্তি নিয়ে পরিচালনা পর্ষদের কয়েকজন সদস্য ‘বাণিজ্য’ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটিতে ভর্তি বাণিজ্যের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। নামি এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির এ বছরের ডায়েরি ও ক্যালেন্ডার ছাপানোর নামেও বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ অভিযোগেরও পৃথক তদন্ত চলমান।

একসময়ের নামকরা এই বিদ্যাপীঠ দিন দিন দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে সুনাম নষ্ট হয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ অভিভাবকদের। তাঁরা বলেন, প্রাক্তন অধ্যক্ষ ফয়জুর রহমান এ প্রতিষ্ঠানটিকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন। শিক্ষার্থীদের মেধার ঝলকে একসময় ঢাকা বোর্ডের সেরা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় অনায়াসে স্থান করে নিত এই বিদ্যায়তন। এখন পড়াশোনার মানও দিন দিন নিম্নমুখী। পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের বিরুদ্ধেই উঠেছে নানা গুরুতর সব অভিযোগ।

কী ঘটেছিল আসলে
প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক ও অভিভাবকরা জানান, শিক্ষা সফরের নামে গত ১৮ মার্চ পরিচালনা পর্ষদের সদস্য খন্দকার মুশতাক আহমেদের নরসিংদীর বাগানবাড়িতে ছাত্রীদের নিয়ে যান কলেজের অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদী।  তিনি খন্দকার মুশতাক আহমেদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠী। তাঁদের বন্ধুত্বও প্রতিষ্ঠানের সবারই জানা। ওই দিনেরই একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। অভিযোগ উঠেছে, শিক্ষা সফরে এক ছাত্রীকে ‘লোভ’ দেখিয়ে সখ্য তৈরি করেন মুশতাক। বিষয়টি শিক্ষক ও অন্য ছাত্রীদেরও নজরে আসে। সফরে অংশ নেওয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্রী জানান, অধ্যক্ষ নিজেও মুশতাককে গলায় মালা পরান এবং মুখে তুলে খাওয়ান। অনুষ্ঠানের ছবিতেই এটা দেখা যাচ্ছে। অধ্যক্ষের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ার কারণে শিক্ষা সফর করা হয়েছে তাঁর বাড়িতে।

গত বুধবার ‘আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ অভিভাবক ফোরাম’র পক্ষে সাধারণ সম্পাদক রোস্তম আলী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, ‘আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালনা পর্ষদের দাতা সদস্য ষাটোর্ধ্ব খন্দকার মুশতাক আহমেদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির কলেজ শাখার একাদশ বিজ্ঞান বিভাগের ১৭ বছর বয়সী ছাত্রীর সঙ্গে গত ২ বছর ধরে মেলামেশা ও সম্পর্ক স্থাপন করায় নৈতিক ও চারিত্রিক স্খলন ঘটেছে এবং এক পর্যায়ে অভিভাবকদের চাপে সম্প্রতি তৃতীয় বিয়ে করতে খন্দকার মুশতাক বাধ্য হয়েছেন।’ এ ঘটনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে চরম উত্তেজনা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে এবং ছাত্রীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে বলেও সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অভিভাবক ফোরাম দাবি করে।

এসব বিষয়ে খন্দকার মুশতাক আহমেদ দাবি করেন, তিনি কোনো ছাত্রীকে যৌন নিপীড়ন করেননি। পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, ওই ছাত্রী কি কোথাও কোনো অভিযোগ করেছে আমার বিরুদ্ধে? কিংবা তার অভিভাবকরা কি কোনো অভিযোগ তুলেছেন? তাহলে অন্যদের এত মাথাব্যথা কীসের? পুরো বিষয়টিই গভীর ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেন তিনি।
কারা ষড়যন্ত্র করছে? এ প্রশ্ন করা হলে পরিচালনা পর্ষদের দাতা সদস্য বলেন, সামনে আইডিয়াল স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন। আমি এখানে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়; আমি যেন নির্বাচন করতে না পারি সে জন্য এসব করা হচ্ছে। ভিডিওটি বানানো দাবি করে তিনি বলেন, আমার বয়স হয়েছে ৬০ বছরের বেশি। আমি কেন এসব করতে যাব? তদন্তে তা প্রমাণিত হবে।
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের অভিভাবক সদস্য মো. শাহাদাৎ ঢালী বলেন, পুরো বিষয়টি ভীষণ লজ্জার। একটি ভিডিও স্কুলের মাঠের; অপরটি খন্দকার মুশতাকের গাড়িতে।
পরিচালনা পর্ষদের অপর সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আশরাফ তালুকদার বলেন, দুটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এগুলো পরিচালনা পর্ষদকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। এ দুটি ঘটনা খতিতে দেখতে ৩১ মে গভর্নিং বডির সভায় বিস্তারিত আলোচনা শেষে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে পরিচালনা পর্ষদের বাইরে থেকে ঢাকার এক এডিসিকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত খন্দকার মুশতাককে স্কুলে আসতে নিষেধ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

জানতে চাইলে অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদী বলেন, বেনামি একটি অভিযোগ আসার পর পরিচালনা পর্ষদ তদন্ত কমিটি করে দিয়েছে। তদন্ত চলমান। আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত করে রিপোর্ট দেবে। এত জায়গা থাকতে কেন পরিচালনা পর্ষদের একজনের বাড়িতে ছাত্রীদের নিয়ে শিক্ষা সফরে গেলেন– প্রশ্ন করা হলে অধ্যক্ষ ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল কবির দুলু বলেন, আইডিয়াল স্কুলে আগেও ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। অতীতে সঠিক বিচার হলে নতুন করে এমন ঘটনা ঘটত না।

এ ছাড়া গত ২৫ মে পরিচালনা কমিটির সদস্য শাহাদাৎ ঢালী প্রতিষ্ঠানটির সভাপতির কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে বলেন, চলতি বছরের ডায়েরি ও ক্যালেন্ডার ছাপানোর ঘটনায় প্রায় ৪০ লাখ টাকার অনিয়ম হয়েছে। জানুয়ারি মাসের ডায়েরি ও ক্যালেন্ডার মে মাসে হাতে এসেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডায়েরি ও ক্যালেন্ডার ছাপানোর পুরো প্রক্রিয়া অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদী ও প্রতিষ্ঠানটির সহকারী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান খান নিয়ন্ত্রণ করেছেন।

লিখিত এই অভিযোগের ভিত্তিতে পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক মো. শহীদুল ইসলামকে তদন্ত করার দায়িত্ব দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে মো. শাহাদাৎ ঢালী বলেন, বিষয়টি তদন্তাধীন। তাই এ নিয়ে এখন আর কিছু বলব না।
এদিকে, শাহাদাৎ ঢালী অভিযোগ করার পর তাঁর বিরুদ্ধেও পাল্টা অভিযোগ এনেছে পরিচালনা পর্ষদের আরেক পক্ষ। তারা প্রতিষ্ঠানটির সভাপতিকে দেওয়া অভিযোগে বলেছে, কমিটির সদস্য হয়েও তিনি ‘সেইফ কোচিং সেন্টার’ নামে কোচিং সেন্টার চালান। ২০২২ সালে ১০ শিক্ষার্থীকে ভর্তি করে ভর্তিপ্রতি ৬ লাখ করে টাকা নিয়েছেন। অধ্যক্ষের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে এমন আচরণ করার সাহস পাচ্ছেন তিনি। এ বিষয়ে ঢালী বলেন, তিনি দুর্নীতির অভিযোগ আনার পর দুর্নীতিবাজরা তাঁর ওপর ক্ষেপে গিয়ে তাঁর চরিত্র হননের চেষ্টা করছে।

এ বিদ্যালয়ের ভর্তি বাণিজ্য নিয়ে সম্প্রতি এক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে সম্প্রতি ৬০ জন শিক্ষার্থীকে অবৈধভাবে ভর্তি করানো হয়েছে। এর মধ্যে খন্দকার মুশতাক ১১ জন এবং শাহাদাৎ ঢালী ৯ জনকে ভর্তি করিয়েছেন। অন্যান্য সদস্যের নামেও বাকি ৪০ জন ভর্তি নেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীপ্রতি ৪ থেকে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.