আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়নে সরকারকে প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে: আহসান এইচ মনসুর

0
95
আহসান এইচ মনসুর, অর্থনীতিবিদ

পার্থ শঙ্কর সাহা: আইএমএফ যে ঋণ অনুমোদন করেছে, তাতে কী ধরনের শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে বলে আপনি দেখতে পাচ্ছেন?

আহসান এইচ মনসুর: আমি প্রতিবেদনটি এখনো দেখিনি। এখন পর্যন্ত আমরা যা পেয়েছি, তা হলো আইএমএফ কর্তৃপক্ষের কিছু বক্তব্য। ওই সব বক্তব্য থেকে আমরা যতটুকু পেয়েছি, সেগুলোকে মোটামুটিভাবে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে একটি হলো স্ট্যান্ডার্ড কিছু শর্ত। আরেকটি হলো সংস্কারমূলক শর্ত বা প্রতিশ্রুতি।

স্ট্যান্ডার্ড শর্তগুলোর মধ্যে আছে বাজেটঘাটতি একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় রাখতে হবে। রিজার্ভ একটি নির্দিষ্ট মাত্রার নিচে যেতে পারবে না। এর ব্যত্যয় হলে পরবর্তী ধাপে ঋণ পাওয়া যাবে না। পারদর্শিতার মানদণ্ডের পাশাপাশি থাকে কিছু স্থায়ী মানদণ্ড (বেঞ্চমার্ক)। যেমন রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা। সাধারণত এটা পারদর্শিতার মানদণ্ড হিসেবে ধরা হয় না। টার্গেট তারা ঠিক করে দেয়। সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেই এটা করা হয়।

এর বাইরে যেটা আছে, তা হলো সংস্কার কার্যক্রম। এটা পরিকল্পনা করতে হয়, বিন্যাস করতে হয়। পরে আসে বাস্তবায়নের প্রশ্ন। এসব হয়তো এবারের ঋণ ছাড় দেওয়ার পর যে মিশনগুলো আসবে, তখন সেগুলো নিয়ে তারা আলোচনা করবে। এখানে কয়েক ধরনের সংস্কার কার্যক্রম দরকার হবে। একটা হচ্ছে আর্থিক খাতে সংস্কার। সেটার মধ্যে ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, বন্ড মার্কেট, পুঁজিবাজারের সংস্কার—এসব বিষয় থাকতে পারে। যেমন ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়া ইত্যাদি। আমি সম্ভাব্য বিষয়গুলো নিয়ে আসলে বলছি।
এরপর রাজস্ব খাতের সংস্কারের বিষয় থাকবে। এটা সরকারেরও দরকার আছে।

পার্থ শঙ্কর সাহা: ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ বলেছে যে এই ঋণ দেশটির সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা অক্ষুণ্ন রাখা, দুর্বলকে সুরক্ষিত করা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশসম্মত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করবে। কীভাবে এসব লক্ষ্য অর্জিত হবে বলে আপনি মনে করেন?

আহসান এইচ মনসুর: আমরা এর বিস্তারিত এখনো জানি না। আমরা যেটা বুঝতে পারি, সেটা হচ্ছে সার্বিকভাবে দুই ধরনের কার্যক্রম দরকার। একটি হলো সরকারের যে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম আছে, সেগুলোকে সহায়তা দেওয়া। সরকারের হাতে টাকা থাকলে তো সরকার এসব করতে পারবে। আবার সরকার এ সহায়তা নিয়ে মূল্যস্ফীতি যদি কমাতে পারে, তবে সাধারণ মানুষের সেটা কাজে লাগবে। সেই বিচারে এটা দারিদ্র্য বিমোচনেও সহায়তা হবে। কারণ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি তো দারিদ্র সৃষ্টি করে।

আর পরিবেশসম্মত প্রবৃদ্ধির বিষয়টির ক্ষেত্রে বলতে চাই, এখানে সরকারের জলবায়ু অভিযোজনমূলক নানা কার্যক্রম আছে। সেগুলোকে সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে এ ঋণ কাজ করবে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলার ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য ও পরিচ্ছন্ন জ্বালানি উৎপাদনের প্রচেষ্টাকে সহায়তা করতে পারে। আইএমএফ সরাসরি সেখানে সহায়তা দিচ্ছে না। সরকারই দেবে। কিন্তু আইএমএফ যেহেতু সরকারকে সহায়তা করছে, সে ক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এ ঋণ কাজ করবে।

পার্থ শঙ্কর সাহা: আইএমএফ যেসব সংস্কারের জন্য বলেছে, ঋণের আগামী কিস্তিগুলো পাওয়া সেগুলোর বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করছে। বাংলাদেশ সরকারের বাস্তবায়ন সক্ষমতা কতটা রয়েছে?

আহসান এইচ মনসুর: ইচ্ছা থাকলে বাস্তবায়ন কঠিন কিছু নয়। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের কাছে থেকে বিভিন্ন কারিগরি সহায়তাও পাওয়া যেতে পারে। বড় বিষয়টা হলো রাজনৈতিক সমর্থন পাওয়া। সংস্কারের সাফল্য নির্ভর করছে এই সমর্থনের ওপর। যেমন ধরুন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংস্কার। এটা এনবিআরের ভেতর থেকে হবে না। এটা একেবারে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে, কঠোর দৃষ্টি দিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশেষ করে মাঠপর্যায়ে। সরকারের যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে, তবে বাস্তবায়ন করতে পারবে। যদি সরকার দোদুল্যমান থাকে, করব কি করব না, হবে কি হবে না, ব্যবসায়ীরা কী ভাবে, অন্যরা কী ভাববে, নির্বাচনের ক্ষতি হয়ে যাবে—এমনটা থাকলে সরকার সংস্কার করতে চাইবে না। গড়িমসি করবে, সময়ক্ষেপণ হবে আর শেষ পর্যন্ত আইএমএফের ওপর দোষ দিয়ে পার হয়ে যাবে।

পার্থ শঙ্কর সাহা: সরকারকে এখন কী করতে হবে? সরকারের প্রশাসনযন্ত্রের দক্ষতা বাড়ানো কতটা প্রয়োজন বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার আনতে? একটি নির্বাচনের বছরে এটা কতটা করা যাবে?

আহসান এইচ মনসুর: সরকারি প্রশাসনের তো অনেক ধরনের দুর্বলতা আছে, দুর্নীতি আছে, নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা আছে। সরকার এগুলো ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। তাই এসব বেড়েছে। সরকারের প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে আমাদের বহু রকমের ক্ষতি হয়। আমাদের ব্যয় বেড়ে যায়, প্রকল্পের ভেতরে দুর্নীতি ঢুকে যায়। ভালো কাজ করতে গিয়ে ক্ষতি হয়ে যায়। দেখতে হবে, প্রকৌশলী কি সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ঠিকাদারের সঙ্গে বিরোধ করছে, না অন্য কোনো দুরভিসন্ধি আছে। কে যে ভালো, কে মন্দ, বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা বোঝাও মুশকিল। অনেক ক্ষেত্রে অনেক প্রকল্পে কোনো জবাবদিহি থাকে না। সরকারের পক্ষে আমলাদের কাছ থেকে জবাবদিহি চাওয়া একটা বড় সমস্যা হয়ে গেছে। কারণ, তারা বড় ধরনের ক্ষমতার অধিকারী।

পার্থ শঙ্কর সাহা: আইএমএফের এই ঋণের সঙ্গে ঝুঁকিগুলো কী কী? ঋণের শর্ত পূরণের কারণে সাধারণ মানুষকে কষ্ট পোহাতে হবে বলে মনে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের কী করা দরকার?

আহসান এইচ মনসুর: প্রাথমিকভাবে বলা যায় ঝুঁকির একটা আর্থসামাজিক দিক থাকে। সরকারের পক্ষে অনেক সময় বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ে। এটি একটি ঝুঁকি।

তখন এসব কর্মসূচি ‘অফ ট্র্যাক’ হয়ে যেতে পারে। যেমন বলা হলো যে জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। তখন যদি তেলের দাম বেড়ে যায় এবং সরকার তা না করতে চায়, তখন ঝুঁকি বেড়ে যাবে। দেশের অর্থনীতি ও বহির্বিশ্ব কিন্তু সমানতালে চলে না। বাইরের নানা ঘটনা আমাদের এখানে প্রভাব ফেলে। বিভিন্ন সংকট হয়, সরবরাহে সমস্যা দেখা দেয়। সে ধরনের সমস্যা দেখা দিলে সেটার ব্যবস্থাপনার ঝুঁকি আছে। এমন সমস্যা এলে সরকার ও আইএমএফ এসব পর্যালোচনা করে তা পুনর্বিন্যাস করবে। ঝুঁকির বিপরীতে কিছু নীতিও নিতে হয়। এসব নীতি অনেক সময় জনপ্রিয় না–ও হতে পারে। তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে গেলে আমাদেরও তো বাড়াতে হবে। তখন আমরা আইএমএফকে দোষ দিতে পারি, কিন্তু জিনিসটা তো করতে হবে।

পার্থ শঙ্কর সাহা: সাধারণ মানুষের কষ্ট কি বাড়বে না?

আহসান এইচ মনসুর: স্বল্প মেয়াদে সাধারণ মানুষের কিছু কষ্ট হতে পারে। হয়ে গেছেও হয়তো কিছুটা। তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতেই এটা হয়েছে।

সরকারকে এটা নিজের প্রয়োজনেই করতে হয়েছে। এটা যদি তারা আগে থেকে করত, বিদ্যুতের দাম আগে থেকে বাড়াত, তবে এখনকার সমস্যাটা হতো না। বিভিন্ন বিদ্যুৎ কোম্পানি সরকারের কাছে এখন টাকা পাবে। বিশাল অঙ্কের দায়ভার পড়ে গেল সরকারের কাছে। সরকার দিতে পারছে না। এটা দিতে হবে ডলারে। দামটা যদি আগে বাড়াত, এই বড় দায় থাকত না। ধারদেনা করে তো নিষ্কৃতি নেই।

যদি একটু কষ্ট করেও আমরা সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারি, তাহলে সবার জন্যই ভালো হবে। এটা দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করে তুলবে, মানুষের আয় বাড়বে, মূল্যস্ফীতি কমে আসবে, ডলার স্থিতিশীল হবে। পণ্যের দামও অনেক ক্ষেত্রে কমবে। সরবরাহ কম হওয়ার কারণে যেভাবে জিনিসের দাম বেড়েছে, সরবরাহ বাড়লে তা কমে যাবে। উদাহরণ দিই। বর্তমান বিশ্ববাজারে চিনির দাম হয়তো ৯০ টাকা। আমাদের এখানে বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়। মূল সমস্যা হলো বাজারে সরবরাহে ঘাটতি আছে। কারণ, ডলার নেই। এলসি খুলতে পারছে না। এই পরিস্থিতি যদি পরিবর্তন হয়ে যায়, যদি ডলারের সরবরাহ বাড়ে, তাহলে চিনির দাম ৯০ টাকায় নেমে আসবে। একই জিনিস গমের ক্ষেত্রেও হচ্ছে। আমরা গম আমদানি করিনি অনেক দিন।

সামগ্রিকভাবে আমি বলব, যদি সরকার ও আইএমএফ মিলে সফলভাবে এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে এবং এটার মাধ্যমে যদি আমরা ব্যাংকিং খাত, রাজস্ব খাত, বৈদেশিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে যে সমস্যা সেগুলো দূর করতে পারি, তাহলে সেটা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করবে। আমাদের পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে কেউ তুলনা করবে না। আমাদের রিজার্ভ আবার বাড়তে শুরু করবে। এগুলো আমাদের আশা।

প্রয়োজনে সরকারকে আরও কঠোর নীতি নিতে হবে। যেসব ব্যবস্থা ইতিমধ্যে নেওয়া হয়েছে, সেগুলোতে যদি সাফল্য না আসে, তবে আরও কঠিন ব্যবস্থা নিতে হবে। কাজটা করতে হবে, অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে হবে। সরকার এটা করবে, এটা আমাদের আশা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.