আইএমএফের শর্ত পূরণে সরকারের কর্মকৌশল

কর-জিডিপির অনুপাত বৃদ্ধি

0
103
আইএমএফ

৪৭০ কোটি ডলার ঋণ পেতে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কর-জিডিপির অনুপাত ৭ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত করার শর্ত দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। ফলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আগামী অর্থবছরের প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করতে হবে। করের আওতা বাড়ানোর পাশাপাশি কর ফাঁকি রোধে রাজস্ব কার্যক্রমকে অটোমেশন করাসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি। এ ছাড়া কর অব্যাহতি কমিয়ে আনার আভাসও দেওয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, রাজস্ব আদায়ে গতি আনতে সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে অনুষ্ঠিত সমন্বয় সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, কাস্টমস খাতে যথেষ্ট রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়। এ বিষয়ে নজরদারি করলে বেশি রাজস্ব আহরণ সম্ভব। এর পরিপ্রেক্ষিতে এ খাতে নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত কর ফাঁকি রোধে শতভাগ ডিজিটাল সেবা নিশ্চিতের উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি।

এদিকে বর্তমানে দেশে ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর বা টিআইএন সনদধারীর সংখ্যা প্রায় ৮৪ লাখ। কিন্তু আয়কর রিটার্ন জমা হয় মাত্র ২৮ লাখ। যেসব টিআইনধারী রিটার্ন জমা দেন না, তাঁদের বাধ্য করতে সঞ্চয়পত্র, জমি নিবন্ধন থেকে শুরু করে ইউটিলিটি সংযোগ, ক্রেডিট কার্ডসহ ৩৮টি সেবায় আয়কর রিটার্ন দাখিল করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়নে নির্বাচন কমিশন, ডিপিডিসি, বিআরটিএ, সঞ্চয় অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থার সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে তদারকি আরও বাড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে টিআইএনধারীর সংখ্যা এক কোটিতে উন্নীত করতে চায় রাজস্ব বোর্ড। এ জন্য বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় এনবিআরের শাখা কার্যালয় স্থাপন ও জনবল নিয়োগের মাধ্যমে জনগণের কাজকর্ম বিশ্লেষণ করে নতুন করদাতা শনাক্ত করা হবে। এ ছাড়া আয়কর রিটার্ন প্রস্তুতকারী স্কিম গ্রহণের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের করদাতাদের সহজে কর প্রদানসহ রিটার্ন দাখিলে উদ্বুদ্ধ করা হবে।

ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাবে স্বচ্ছতা আনতে ২০২৬ সালের মধ্যে ৩ লাখ ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিন বসানোর কার্যক্রম শুরু হয়েছে, যার মাধ্যমে ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বাড়তি রাজস্বের আশা করছে এনবিআর। এ ছাড়া আরও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে করের আওতায় আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এনবিআর।

এদিকে করের পরিমাণ বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড প্রশাসনিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সুনির্দিষ্ট ছয়টি কর্মকৌশল নিয়েছে। এর আওতায় সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণের মাধ্যমে প্রত্যেক কর্মচারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য সুস্পষ্ট করা হবে। কর্মজীবন পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়ন, প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা নির্দিষ্ট করা হবে। কর্মচারীদের জন্য প্রয়োজনীয় আইটিসহ অন্যান্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মদক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। সর্বোপরি যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করা হবে।

দেশের অর্থনীতির আকার বিবেচনায় বাংলাদেশে কর আদায়ের হার তথা কর-জিডিপির অনুপাত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম। এর কারণ শুধু করের আওতা কম কিংবা কর ফাঁকি নয়, বিপুল অঙ্কের কর অব্যাহতি বা ছাড়ও। কর অব্যাহতির এ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। বাংলাদেশ তাতে সম্মতি দিয়ে ব্যতিক্রমধর্মী জনস্বার্থমূলক কার্যক্রম ছাড়া শুল্ক-কর অব্যাহতি কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, কর অব্যাহতি দেওয়া হয় শিল্প খাতের সক্ষমতা বাড়াতে। তাই এ কারণে কর জিডিপির অনুপাত হলে চিন্তার কিছু নেই। কারণ অন্যভাবে দেশের জনগণ এর ফল পায়। তবে প্রাসঙ্গিক কারণেই অব্যাহতি আগামীতে যৌক্তিক করা হবে। এটি চলমান প্রক্রিয়া।

অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩১ সালে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ উন্নত দেশে রূপান্তরিত হওয়ার জন্য রাজস্ব বাড়ানোর বিকল্প নেই। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী রাজস্ব বাড়ানো কঠিন। তারপরও সরকার অংশীজনদের নিয়ে সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে প্রস্তুত রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, প্রতি বছর প্রায় ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয় সংস্থাটিকে। কিন্তু সে লক্ষ্যমাত্রাই অর্জন করা সম্ভব হয় না। তা ছাড়া বর্তমানে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। এ পরিস্থিতিতে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ১৮ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব হবে না। তবে দেশের স্বার্থেই রাজস্ব বাড়াতে হবে।

এদিকে আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী কর-জিডিপির অনুপাত বাড়াতে এনবিআরকে কোন বছর কী পরিমাণ রাজস্ব বাড়াতে হবে, সম্প্রতি তার একটি হিসাব প্রকাশ করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)। এতে বলা হয়, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কর-জিডিপির অনুপাত ৭ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৩ শতংশে উন্নীত করতে হবে। এ জন্য কী কী উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে, তা আগামী জুনের মধ্যে সংস্থাটিকে জানাতে হবে। এরপর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা আরও দশমিক ৫ শতাংশ পয়েন্ট বাড়াতে হবে। তা ছাড়া আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে আরও দশমিক ৭ শতাংশ পয়েন্ট বাড়িয়ে সাড়ে ৯ শতাংশে উন্নীত করতে হবে।

গত পাঁচ অর্থবছরে গড়ে এনবিআরের রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১২ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে সংস্থাটি রাজস্ব আহরণ করেছে ৩ লাখ ৭২৭ কোটি টাকা। আইএমএফের শর্ত পূরণে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে প্রায় ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতে হবে। পিআরআই আরও বলছে, আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে বর্তমানে রাজস্বে যে হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, সেটি অব্যাহত রাখার পরও এনবিআরকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে অতিরিক্ত ৬৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতে হবে। এর পরের অর্থবছর (২০২৪-২৫) অতিরিক্ত রাজস্ব আয় করতে হবে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির সর্বশেষ বছর, অর্থাৎ ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এনবিআরকে অতিরিক্ত ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে।

কোন খাত থেকে কী পরিমাণ রাজস্ব বাড়ানো সম্ভব, তারও একটি হিসাব দিয়েছে সংস্থাটি। তাদের তথ্য অনুযায়ী কর দিতে সক্ষম প্রত্যেক মানুষকে করের আওতায় আনতে পারলে জিডিপি প্রায় ২ দশমিক ১ শতাংশ অতিরিক্ত রজস্ব আহরণ সম্ভব। এ ছাড়া কর অব্যাহতি কমিয়ে জিডিপির প্রায় ২ দশমিক ৩ শতাংশ, ভ্যাট সংস্কারের মাধ্যমে প্রায় শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে করপোরেট করের আওতায় আনার মধ্যমে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আহরণ সম্ভব বলে মনে করছে সংস্থাটি। তবে এসব বাস্তবায়নে সরকারের আর্থরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের পাশাপাশি রাজস্ব প্রশাসনে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন বলেও জানিয়েছে পিআরআই।

পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এনবিআরে বড় ধরনের সংস্কার ছাড়া এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে না। তবে আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি সম্পন্ন করতে লক্ষ্য অর্জন ছাড়া কোনো উপায় নেই।
তিনি আরও বলেন, সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩১ সালে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার জন্য এর চেয়ে বেশি হারে রাজস্ব আহরণ প্রয়োজন। সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিকীর তথ্য অনুযায়ী ২০২৫ সাল শেষে কর-জিডিপির অনুপাত সাড়ে ১২ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। সুতরাং আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি অনুযায়ী সরকার যদি শর্ত পূরণ করে, তারপরও অষ্টম পঞ্চবার্ষিকীর লক্ষ্য অর্জন হবে না। তাই শুধু আইএমএফের শর্ত পূরণই নয়, দেশের স্বার্থেই প্রয়োজনীয় সংস্কার করে রাজস্ব বাড়াতে হবে।

মেসবাহুল হক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.