অর্জন রক্ষা জরুরি

0
107
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

৫২ বছরে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অর্জন নিঃসন্দেহে নজর কাড়ার মতো। স্বাধীনতা যুদ্ধের ভেতর দিয়ে আসা রাষ্ট্রকে কার্যকর ও টেকসই হিসেবে দাঁড়ানোর জন্য রাষ্ট্রের সব অনুষঙ্গ, যেমন– মুদ্রাব্যবস্থা, আর্থিক ব্যবস্থা, করব্যবস্থা থেকে শুরু করে বৈদেশিক সম্পর্ক– সবই নতুনভাবে দাঁড় করাতে হয়েছে। এক কোটি শরণার্থীকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। মিত্র সেনাবাহিনীকেও দ্রুত বিদায় জানাতে পেরেছি। সেহেতু অর্জনগুলো কম না। এখানে এক ধরনের জাতীয় ঐক্য হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি নাগরিক সমাজও স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে উৎসারিত স্বেচ্ছাপ্রণোদনায় পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় জড়িয়েছে। এর মধ্য দিয়ে যেমন ব্র্যাক ও গণস্বাস্থ্যের মতো প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি বহু বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান সেই সময়ে এসেছে।

পরে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক নীতিমালায়ও পরিবর্তন এসেছে। আশির দশক থেকে বিরাষ্ট্রীয়করণ, বাজার অবমুক্তকরণ, বৈশ্বিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আরও বেশি যুক্ত হওয়া ইত্যাদি ঘটে। আশি, নব্বই দশকের পর দেখা যায়, যে-ই ক্ষমতায় থাকুক, এক ধরনের নীতি-ঐক্য গড়ে উঠেছে। এ জন্য দুই দলের অর্থনৈতিক চিন্তায় খুব বেশি তারতম্য দেখা যায় না। এর সুফলের দিক হলো, নীতির ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা এসেছে এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় দেশীয় ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছে।

দুর্ভিক্ষ-মন্বন্তর থেকে আমরা শিখেছি, খাদ্যনিরাপত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা শিখেছি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেহেতু আমাদের রপ্তানিতে জোর দিতে হবে, রেমিট্যান্সে জোর দিতে হবে। আমরা বুঝেছি, আমাদের দেশে সেই অর্থে প্রাকৃতিক সম্পদ নেই, তাই মানবসম্পদের ওপর জোর দিতে হবে এবং সে জন্য শিক্ষার গুণগত মান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানবসম্পদ বিকাশের অন্য দিক হলো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা; সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে। বুঝেছি যে দারিদ্র্য শুধু প্রবৃদ্ধি দিয়ে দূর করা সম্ভব না, এ জন্য সামাজিক সুরক্ষার দরকার পড়বে। প্রয়োজনে সর্বজনীন পেনশন স্কিম দরকার হবে।

কিন্তু নীতিগুলো বাস্তবায়নের বেলায় বিভিন্ন ধরনের বিকৃতির সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী প্রাতিষ্ঠানিক বিকৃতির সুযোগ নিয়ে নীতিগুলোকে পূর্ণাঙ্গভাবে জনমানুষের পক্ষে কাজ করতে দেয়নি। বাংলাদেশ এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি বৈষম্যপূর্ণ দেশ। হয়তো মাথাপিছু গড় আয় ইত্যাদি বেড়েছে, তবে গড়ে-গড়ে পার্থক্যও অনেক বড় হয়ে গেছে। সেটা শুধু আয়ের ক্ষেত্রে না, ভোগের ক্ষেত্রেও হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বৈষম্য হয়েছে সুযোগ এবং অধিকার বাস্তবায়নের বেলায়। মানুষের প্রতি রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় যে দায়িত্ব, তা থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয়। এটা শুধু গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে কথা বলার অধিকার, ভোট অর্জন রক্ষা জরুরি দেওয়ার অধিকার না; সেবা পাওয়ার অধিকার, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার। যে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার কথা, শিক্ষা পাওয়ার কথা, সে বিষয়গুলো বাকি রয়ে যাচ্ছে। আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে শিখেছি কিন্তু সামাজিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে পারছি না।

বিচারব্যবস্থা বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বলেন, অধিকার সুরক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর না থাকলে, রাজনৈতিক প্রভাব বড় হয়ে দাঁড়ালে সমস্যা দেখা দেয়। তাই আমরা যখন মুক্তিসংগ্রামের কথা বলি, তখন কিন্তু চেতনার কোন অংশ নিয়ে বলি তা পরিষ্কার হয় না। আমরা জাতীয়তাবাদের কথাও বলি। ব্যক্তি মানুষকে বাদ দিয়ে, পিছিয়ে পড়া মানুষকে বাদ দিয়ে জাতি বাড়তে পারে কিনা? এখন তো আর ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয় না। আমরা যে অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলি, তার মধ্যে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু ঠিকমতো অধিকার পেল কিনা, তা বোঝা যায় না। আমরা নারীর ক্ষমতায়নে অনুপ্রাণিত। কিন্তু পোশাক শ্রমিক, খেটে খাওয়া নির্মাণ শ্রমিক, মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া নির্যাতিত মেয়েদের কথা এবং গার্হস্থ্য নিপীড়নের শিকারদের কথা কতটা বলা হয়? চিত্রটি আরেকটু সূক্ষ্ম ও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। যাঁরা এই বিশ্লেষণ করেন, যাঁরা এই মানবতাবাদী চিন্তা থেকে, নাগরিকদের দায়িত্ববোধ থেকে কথাগুলো বলেন, তাঁরা কিন্তু কোনোভাবে বাংলাদেশের অর্জনকে খাটো করে দেখেন না। বরং বাংলাদেশের অর্জনকে প্রকৃতভাবে টেকসই, সর্বজনীন করার জন্যই তাঁরা এসব কথা বলা দায়িত্ব বলে মনে করেন।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: অর্থনীতিবিদ, সিপিডির ডিস্টিংগুইশড ফেলো

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.