অপরিকল্পিত উন্নয়নে বাড়ছে বন্যার ঝুঁকি

0
78

চট্টগ্রাম নগরকে জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচাতে ৩ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে আউটার রিং রোড। এই প্রকল্পে আছে ১১টি স্লুইসগেট। কিন্তু খালের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ নেই এগুলোর। এটি নগরের একাংশে জলাবদ্ধতা তৈরি করতে পারে বলে ২০১৮ সালে প্রকল্পটির নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে উঠে আসে। কিন্তু সে প্রতিবেদন উপেক্ষা করে এখন বাস্তবায়ন হচ্ছে রিং রোড প্রকল্প। তাই সামান্য বৃষ্টিতেই এখন জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে চট্টগ্রামের একাংশে। ডুবে যাচ্ছে কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলার বিস্তীর্ণ ভূমি। এসব জেলায় নির্বিচারে উজাড় হয়েছে প্রাকৃতিক বন। পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হয়েছে স্থাপনা। হচ্ছে অপরিকল্পিত উন্নয়ন। এখন বৃষ্টি হলেই পানির সঙ্গে নেমে আসছে পাহাড়ের মাটি। এতে ভরাট হচ্ছে ভাটির নদী কর্ণফুলী, শঙ্খ ও মাতামুহুরী। গবেষণা অনুযায়ী, দুই দশকে কর্ণফুলী নদীর প্রশস্ততা ৫০ থেকে ২৫০ মিটার পর্যন্ত কমে গেছে। নাব্য হারিয়েছে শঙ্খ ও মাতামুহুরী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব কারণে চট্টগ্রামসহ পার্বত্যাঞ্চলে নতুন করে বেড়েছে বন্যার ঝুঁকি। প্রতিবছর ক্ষতি হচ্ছে হাজার কোটি টাকা।

১৯৬১ সালের মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী চট্টগ্রাম নগরে খাল ছিল ৭০টি। এখন আছে ৫৭টি। হারিয়ে গেছে ১৩টি খাল। যেগুলো আছে সেগুলোর মধ্যেও অনেক খাল বিলুপ্তির পথে। ১৯৯৫ সালে হয় আরেকটি মাস্টারপ্ল্যান। সেটিতে নতুন করে চারটি খাল খনন ও পুরোনো খাল সংস্কারের কথা বলা আছে। কিন্তু এই পরিকল্পনা উপেক্ষা করে ১১ হাজার কোটি টাকার চারটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে চট্টগ্রামে। এসব প্রকল্পে এরই মধ্যে ব্যয় হয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সুফল মেলেনি। উল্টো দখল হয়ে গেছে নদীর দুই পাড়; গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ স্থাপনা। জলাধার দখল করে গড়া হচ্ছে আবাসিক এলাকা। উঠছে একের পর এক বহুতল ভবন। এমন দখল-বেদখলের খেলায় বেড়ে যাচ্ছে নদীতীরের বসতি।

নাসার স্যাটেলাইটে ধারণ করা বাংলাদেশ অংশের রাতের ছবি বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বলছেন, গত দুই দশকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে এমন ঝুঁকিপূর্ণ বসতি বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। নদীতীরের প্লাবন ভূমিতে বসবাস করে এখন বন্যার ঝুঁকিতে থাকা এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। গত বছরের ২২ জুন গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বই ও জার্নাল প্রকাশনা কোম্পানি টেইলর অ্যান্ড ফ্রান্সিসের ‘জিওকার্টো ইন্টারন্যাশনাল’ প্রকাশনায়।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চের ইমিরেটাস অধ্যাপক ও পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, আগে পানির গতিপথে প্রতিবন্ধকতা ছিল না। বেশি বৃষ্টি হলেও পানি ভাটিতে নেমে যেত। এখন অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে পানির পথে বাধা তৈরি হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে বাড়ছে বন্যার ঝুঁকি। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনও একই রকম ঝুঁকি তৈরি করেছে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে। স্থানীয়রা রেললাইনের কারণে বন্যার যে ভয়াবহতার কথা বলছেন, সেটাই সঠিক। রেললাইন আটকে দিয়েছে পানি। আগে পানি আটকাত না, তাই এমন বন্যাও হয়নি। এর পুরোটাই প্রকৌশল ও নকশার ব্যর্থতা। বড় প্রকল্প নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্টদের পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভাবতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বন্যার ঝুঁকি নিয়ে গবেষণা করা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যার বিভাগীয় প্রধান ড. মাহবুব মোর্শেদ বলেন, যখন বৃষ্টি হয় তখন অধিকাংশ পানি পাহাড়ের ভূগর্ভে ধারণ হয়। অল্প পানি গড়িয়ে পড়ে, যা খাল, ঝিরি হয়ে বিল বা নদীতে মিশে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাকৃতিক কোনো বন নেই। অক্ষত পাহাড়ও নেই। ফলে ভারী বর্ষণ হলে যে পানি ভূগর্ভে যাওয়ার কথা, সেটি মাটিসহ গড়িয়ে পড়ায় আকস্মিক বন্যা বাড়ছে। সর্বশেষ বিপর্যয়ে হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবানে।

কমে গেছে কর্ণফুলীর প্রশস্ততা
চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পানি নিষ্কাশনের পথ কর্ণফুলী নদী। এই নদীর মোহনায় বন্দর থাকায় এটিকে দেশের অর্থনীতির ‘লাইফ লাইন’ বলা হয়। কিন্তু দখল-দূষণে এই নদী নাব্য হারিয়েছে। জমেছে পলি। ২০১৫ সালের চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ে ২ হাজার ১১২টি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। এটি এখন আরও বেড়েছে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের সাবেক অধ্যাপক ইদ্রিস আলীর এক গবেষণা অনুযায়ী, ২০১০ সালের আগে শাহ আমানত সেতু এলাকায় কর্ণফুলী নদীর প্রশস্ততা ছিল ৯০০ মিটার, যা এখন ৫২০ মিটার। ফলে নদীর দৈহিক ক্ষতি হয়েছে। হারিয়েছে নগরের পানি নিষ্কাশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৩টি খাল।

জলাভূমিতে আবাসিক এলাকা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের তৎকালীন অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলামের ১৯৮১ সালের গবেষণা জরিপ অনুযায়ী, চট্টগ্রামে জলাশয়ের সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৯৪১। ১০ বছর পর ১৯৯১ সালে তাঁর করা আরেক জরিপ অনুযায়ী প্রায় ১৩ হাজার জলাশয় হারিয়ে যায়। ২০০৬-০৭ সালে সিডিএ জরিপ অনুযায়ী, নগরে জলাশয়ের সংখ্যা মাত্র ৪ হাজার ৫২৩টি। বর্তমানে কী সংখ্যক জলাশয় আছে, এর সঠিক চিত্র সংশ্লিষ্ট কোনো বিভাগের কাছে নেই। তবে বিশেষজ্ঞরা নগরের গুগল ম্যাপ পর্যালোচনা করে বলছেন, নগরের পুকুর ও দিঘির সংখ্যা এখন হাজারের নিচে। পুকুর ভরাট করে গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন। নগরের বায়েজিদ ও চান্দগাঁও এলাকায় জলাভূমি ভরাট করে অনন্যা আবাসিক এলাকা গড়ে তুলেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। একইভাবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বন্যার বিষয়টি উপেক্ষা করে ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন।

পাহাড় কেটে অবৈধ বসতি
একটি গবেষণার বরাত দিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ান হাসান সম্প্রতি চট্টগ্রামে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জানান, বন্দরনগরীতে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ছোট-বড় ১২০টি পাহাড় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামে ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার পাহাড় ছিল। ২০০৮ সালে তা কমে ১৪ দশমিক ২ বর্গকিলোমিটারে নেমে আসে। শুধু চট্টগ্রাম নয়; পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারেও নির্বিচারে ধ্বংস করা হচ্ছে পাহাড়। ২০১৭ সালে ভয়াবহ এক পাহাড় ধসে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ১৬০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। পাহাড়ের মধ্যে নির্বিচারে তৈরি করা হচ্ছে বসতি। সামান্য বৃষ্টিতেই এখন ধসে পড়ছে পাহাড়ের মাটি। ভাটিতে থাকা কর্ণফুলী, শঙ্খ ও মাতামুহুরী তাই ভরাট হয়ে নাব্য হারিয়েছে। সম্প্রতি আকস্মিক পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয়েছে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবানের বিস্তীর্ণ ভূমি। পাহাড় কাটা বন্ধ না হলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.