অকেজো পিয়ানো, হাত পড়ে না হারমোনিয়াম-তবলায়

0
94
নষ্ট পড়ে থাকা পিয়ানো দেখাচ্ছেন বিদ্যালয়ের অফিস সহায়ক মোহাম্মদ আকতার। সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরের আনন্দবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে

শিক্ষকেরা বলছেন, প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ না দেওয়ার কারণে বাদ্যযন্ত্রগুলো কোনো কাজে আসেনি।

বিদ্যালয়ের পরিত্যক্ত ভবনের একটি কক্ষে পড়ে আছে লাখ টাকা মূল্যের পিয়ানো। এটি ঢেকে রাখা হয়েছে বড়সড় কাপড়ে। ধুলার ভারী আস্তরণ জমেছে সে কাপড়ের ওপর। কাপড় সরিয়ে দেখা গেল, বাদ্যযন্ত্রটির অর্ধেকের বেশি ‘কি’ই নষ্ট।

চট্টগ্রামের হালিশহরের আনন্দবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সম্প্রতি পিয়ানোর এ চিত্র দেখা গেছে। ২০১১ সালে কোরিয়ার বুইয়ং কোম্পানি নামের একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য পাঁচ হাজার পিয়ানো অনুদান দিয়েছিল। ওই সময় আনন্দবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বাদ্যযন্ত্রটি পায়। তবে পিয়ানো বাজাতে পারদর্শী শিক্ষক না থাকায় এটির ব্যবহার হয়নি। মাঝেমধ্যে পিয়ানোতে রেকর্ড করা গান বাজানো হতো। দেড় বছর আগে বাদ্যযন্ত্রটি একেবারেই নষ্ট হয়ে যায়।

অবশ্য শুধু আনন্দবাজার নয়, সে সময় বুইয়ং কোম্পানির দেওয়া পিয়ানো পেয়েছিল চট্টগ্রাম জেলার ২০৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়গুলোতে দুই ধাপে বাদ্যযন্ত্র দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে নগরের ৫০টি বিদ্যালয় ছিল। এই ৫০ বিদ্যালয়ের মধ্যে ২০টিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাবে কোনো বিদ্যালয়েই পিয়ানো বাজানো হয় না। অন্তত ১০টি বিদ্যালয়ের পিয়ানো নষ্ট হয়ে গেছে।

একই অবস্থা ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন ও বিকাশ’ শীর্ষক কর্মসূচির আওতায় ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রতিটি উপজেলা ও থানা এলাকার বিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হারমোনিয়াম ও তবলারও। শুরুর দিকে কয়েক বছর ব্যবহার হলেও দীর্ঘদিন ধরে সংগীতের এসব সরঞ্জামে আর হাত পড়ে না।

শিক্ষকেরা বলছেন, প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ না দেওয়ার কারণে বাদ্যযন্ত্রগুলো কোনো কাজে আসেনি। শিক্ষার্থীরা কোনো কিছুই শিখতে পারেনি। আর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় কিংবা থানা শিক্ষা কর্মকর্তারাও তেমন তদারক করেননি। ফলে ব্যবহার না করতে করতে এগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

চট্টগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, বাদ্যযন্ত্রগুলো ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার আলোচনা চলছে। খুব শিগগির শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে।

পড়ে আছে নষ্ট পিয়ানো

বরাদ্দ পাওয়া পিয়ানোর অবস্থা সম্পর্কে জানতে চট্টগ্রাম নগরের আনন্দবাজার ছাড়া আরও পাঁচটি বিদ্যালয়ে সরেজমিনে খোঁজ নেওয়া হয়। বহদ্দারহাট এলাকার এখলাছুর রহমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, প্রধান শিক্ষকের কক্ষের ভেতরেই এক পাশে রাখা আছে ডিজিটাল পিয়ানোটি।

লাল কাপড়ে ঢেকে রাখা হয়েছে সেটি। প্রধান শিক্ষক আলেয়া সুলতানা চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যালয়ে যোগ দেন। তিনি বলেন, বিদ্যালয়ে এসে পিয়ানোটি নষ্ট পেয়েছেন। সহকারী শিক্ষকেরা তাঁকে জানিয়েছেন, বছরখানেক আগে বিদ্যালয়ে বৃষ্টির পানি ঢুকেছিল। তখন পিয়ানোটি নষ্ট হয়ে যায়।

নগরের সরাইপাড়া হাজী আবদুল আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিয়ানোটিও বছরখানেক আগে নষ্ট হয়ে গেছে। অন্যদিকে ভেলুয়ার দিঘি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষককে ২০১৬ সালের মার্চে পিয়ানো বাজাতে পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু পিয়ানো বাজাতে পারেন, এমন কোনো দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

এ কারণে এটি কাজে লাগানো যায়নি বলে জানান বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তুহিন আকতার। নগরের চান্দগাঁও থানার ওয়াপদা কলোনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিয়ানোটিও গত বছর নষ্ট হয়ে যায়। জলাবদ্ধতার কারণে ওই বিদ্যালয়ে পানি ঢুকে গিয়েছিল। তখন পিয়ানোর একটি অংশ পানিতে ডুবে যায়।

লাভ লেন এলাকার সরকারি ন্যাশনাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ও পেয়েছিল পিয়ানো। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে পিয়ানো চালানোর এডাপটারটি চুরি হয়ে যায়। এরপর থেকেই পিয়ানোটি পড়ে আছে। প্রধান শিক্ষক বদরুন্নেছা বেগম জানান, পড়ে থাকতে থাকতে এটি নষ্ট হয়ে গেছে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে সংগীতচর্চার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের সভাপতি সোমেনজিৎ চক্রবর্তী। তিনি বলেন, প্রাথমিক পর্যায়েই শিল্পচর্চা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্ক গড়ে ওঠে। এ জন্য প্রশিক্ষণ নয়; পিয়ানো, হারমোনিয়াম বা তবলা বাজাতে পারদর্শী এমন ব্যক্তিদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া দরকার।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.