একটা ইংরেজি কথা না বলে যেভাবে ঘুরে এলাম নিউইয়র্ক

0
239
নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের ডাইভার্সিটি প্লাজার ‘বাংলাদেশ ম্যুরাল’–এর সামনে পারিবারিক বন্ধু মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে লেখক

মার্কিন মুলুকের শহর নিউইয়র্কে গেলেন আপনি। কিন্তু ইংরেজিভাষীদের এই শহরে গিয়ে আপনাকে একটি ইংরেজি শব্দও খরচ করতে হলো না, আপনি সবই করলেন বাংলা ভাষা ব্যবহার করে, কেমন হলো ব্যাপারটা! হ্যাঁ, এমনটাই ঘটেছে। এই লেখায় বলা হয়েছে সে গল্পই।

আপনি যদি নিউইয়র্কে যান, আর আমার মতো সপ্তাহ দুয়েকের আমেরিকা সফর সেরে ফিরে আসেন, ফেরার পর খেয়াল করে দেখতে পারেন, আপনাকে একটা ইংরেজি বাক্য পুরো বলতে হয়নি! আ-মরি বাংলা ভাষাতেই পুরো সফরটা আপনি সেরে ফেলতে পেরেছেন।

কীভাবে সেটা সম্ভব হলো, সেই গল্পটাই বলছি। তার আগে বলতে হবে ২৮ বছর আগের কথা। ১৯৯৫ সাল। আমি প্রথমবার আমেরিকায় গেছি। সেবার আমি এক সপ্তাহ ছিলাম ওয়াশিংটন ডিসিতে আর চার সপ্তাহ কলোরাডো স্প্রিংসে। এই পাঁচ সপ্তাহে আমি ভাত খেতে পাইনি। শেষের চার সপ্তাহে কোনো বাঙালির দেখা পাইনি। কার্ড ফোনে প্রবাসী বাঙালি বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করা ছাড়া সামনাসামনি কারও সঙ্গে বাংলায় কথা বলিনি। ভাতের জন্য আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। রোজ সন্ধ্যায় আমার মোটেলের রুম থেকে হেঁটে হেঁটে যেতাম খাবারের সন্ধানে। এই পাহাড়ঘেঁষা ছবির মতো শহরটিতে আমি ছাড়া আর কেউ হাঁটত না, সবাই ছুটত গাড়িতে। আমি, নিঃসঙ্গ, দুঃখী, হোম–সিক, নির্জন পথে হেঁটে যেতাম, প্রথম দিকে ম্যাকডোনাল্ডসে। ভাতের বদলে বার্গার খেতে গিয়ে তার গন্ধে আমার নাড়ি-ভুঁড়ি উগলে উঠতে চাইত। আজও আমি কোনো বার্গারের গন্ধ সহ্য করতে পারি না। একদিন একটা স্প্যানিশ রেস্তোরাঁয় ভাত খেতে চাইলাম। রুটির ভেতরে ভরে দিল ভাত, সেটা নিয়ে আমি কী করব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না। শেষে আবিষ্কার করলাম কেএফসি। রোজ আমি রাতে কেএফসিতে খেতাম, অর্ডার দিতাম এইভাবে—‘ফ্রায়েড চিকেন, টার্কি, লেগ, উইথ বিস্কুট, সেভেনআপ, নো আইস।’

নিউইয়র্কের বাংলাদেশ স্ট্রিট
নিউইয়র্কের বাংলাদেশ স্ট্রিট

টানা পাঁচ সপ্তাহ ভাত না খেয়ে উন্মাদের মতো টেলিফোন ডাইরেক্টরিতে বাঙালি নাম খুঁজতে লাগলাম আমি। শেষে আমার মোটেলের ম্যানেজার আমাকে জানালেন, বাঙালি পাওয়া গেছে। ঢাকা পদাতিকের বিখ্যাত অভিনেতা যুগল মৌসুমী মার্টিন আর মার্টিনের এক আত্মীয় আমাকে নিতে এলেন গাড়িতে করে, তাঁর নাম সম্ভবত ছিল লিওনার্দো, বাঙালি কিন্তু এই রকম ছিল তাঁর নাম, তিনি ইউএস আর্মিতে কাজ করতেন। আমাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তিনি গরম ভাত আর মাংসের গরম মসলাদার ঝোল খেতে দিলে আমি গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম। তারপর কলোরাডো স্প্রিংস থেকে উড়ে গেলাম নিউইয়র্কে। এয়ারপোর্ট থেকে নেমে যে ট্যাক্সিওয়ালাকে পেলাম, তিনি বাংলাদেশি। আমাকে দেখে খুশি হননি। কারণ, নিউইয়র্কে ট্যাক্সিতে বকশিশ দিতে হয়। তিনি ভেবেছিলেন, আমি বকশিশ দেওয়ার নিয়ম জানি না। কিন্তু আমি তাঁকে ২৫ শতাংশ টিপস দিয়েছিলাম। এরপর আমাকে ম্যানহাটনের হোটেলে রাখা হলো। নিচে নামলাম খেতে, নিচেই খাবারের দোকান, দোকানি বাঙালি, আমাকে বললেন, খাবার নিয়ে চলে যান, দাম দিতে হবে না। মেট্রো রেলে বাংলায় কথা, সিলেটিতে কথোপকথন শুনেছি প্রচুর। টিউব স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা ঠিকানা জানার জন্য পথিককে ইংরেজিতে প্রশ্ন করলে তিনি বাংলায় উত্তর দিলেন, দুই বাড়ি পরে ডানেরটা। ২৮ বছর আগে নিউইয়র্ক যদি এই রকম হয়, এখনকার নিউইয়র্ক তবে কী? আরেকটা ঢাকা।

আমি আর মেরিনা নিউইয়র্কে নামলাম প্লেন থেকে। মেরিনার জন্য হুইলচেয়ার বলে রাখা হয়েছিল। যিনি হুইলচেয়ার ঠেলছেন, তিনি পরিষ্কার বাংলায় বললেন, ‘আনিস ভাই, কেমন আছেন? পথে কোনো কষ্ট হয়নি তো।’ তিনিই ইমিগ্রেশন পার করে নিলেন। ইমিগ্রেশন অফিসার একটা প্রশ্নও করলেন না। তবে কাস্টমস আমাদের লাগেজ স্ক্যান করার লাইনে ঠেলে দিল। সেখানে যিনি কর্তব্যরত অফিসার, তিনি বাঙালি, বাংলায় বললেন, ‘আপনারা চলে যান।’ বাইরে আমাদের জন্য কবি আবু রায়হানের আসার কথা। তিনি ভুল করে অন্য টার্মিনালে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাদের হুইলচেয়ারের ভাই আমাদেরকে তাঁর ফোনটা ধার দিলেন কল করার জন্য।

আমরা জ্যাকসন হাইটস এলাকায় গিয়ে হাজির হলাম। ওটা তো ঢাকার চেয়েও বেশি বাঙাল মুলুক এখন। দোকানে দোকানে সাইনবোর্ড বাংলায়। এখানে একটা স্ট্রিটের নাম বাংলাদেশ। ডাইভার্সিটি প্লাজায় একটা ম্যুরাল আছে, বাংলাদেশ ম্যুরাল। আশপাশে দোকানের নাম ইত্যাদি, বৈশাখী, আলাউদ্দীন, সাগর। আমরা নবান্ন রেস্তোরাঁয় ভাত, শুঁটকি, ভুঁড়ি, শর্ষে ইলিশ, নানা ধরনের ভর্তা খেয়ে এমন মজা পেয়ে গেলাম যে মেরিনা আর পদ্য আরও দুবার ম্যানহাটন থেকে ট্রেনে করে এসে নবান্ন-এর ভুঁড়ি খেয়ে গেছে।

আমরা গিয়ে উঠলাম ম্যানহাটনে, আমাদের ভাগনে কল্পর স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে। ‘সিক্সিটিনাইন’ নাটকের সেই কল্প। নিচে আমাদের মেয়ে পদ্য দাঁড়িয়েছিল, নিয়ে গিয়ে ঘরে তুলল। আমরা খেতে নিচে নামতাম। নিচে বাংলাদেশি মালিকের বিখ্যাত বেগেলের দোকান। সাদা, কালো, বাদামি নারী–পুরুষ সেই বাঙালি রেস্টুরেন্টের বেগেল খাওয়ার জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন সব সময়। সেই দোকানে গিয়ে আমরা অর্ডার দিলাম বাংলায়। তার পাশেই ডানকিন ডোনাটস। সেটার ভেতরে সব কর্মী বাঙালি। তাঁরা বিনা পয়সায় কফি খাওয়ালেন।

নিউইয়র্কে ওয়ার্ল্ড মিডিয়া কংগ্রেসে বিশ্ব মিডিয়া পুরস্কার ২০২৩–এ দুটি পুরস্কার পেয়েছে প্রথম আলো। সেই পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে
নিউইয়র্কে ওয়ার্ল্ড মিডিয়া কংগ্রেসে বিশ্ব মিডিয়া পুরস্কার ২০২৩–এ দুটি পুরস্কার পেয়েছে। সেই পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে

এরপর আমরা জ্যাকসন হাইটস এলাকায় গিয়ে হাজির হলাম। ওটা তো ঢাকার চেয়েও বেশি বাঙাল মুলুক এখন। দোকানে দোকানে সাইনবোর্ড বাংলায়। এখানে একটা স্ট্রিটের নাম বাংলাদেশ। ডাইভার্সিটি প্লাজায় একটা ম্যুরাল আছে, বাংলাদেশ ম্যুরাল। আশপাশের দোকানের নাম ইত্যাদি, বৈশাখী, আলাউদ্দীন, সাগর। আমরা নবান্ন রেস্তোরাঁয় ভাত, শুঁটকি, ভুঁড়ি, শর্ষে ইলিশ, নানা ধরনের ভর্তা খেয়ে এমন মজা পেয়ে গেলাম যে মেরিনা, পদ্য আর কল্প আবার ম্যানহাটন থেকে ট্রেনে করে এসে নবান্ন–এর ভুঁড়ি খেয়ে গেছে। এখানেই মুক্তধারা বাংলা বইয়ের দোকান। এক রোববার বিকেলে সেখানে একটা লেখক-পাঠক আড্ডাও হয়ে গেল।

নিউইয়র্কে জ্যাকসন হাইটসে মুক্তধারার বইয়ের দোকানে লেখক–পাঠকের আড্ডা
নিউইয়র্কে জ্যাকসন হাইটসে মুক্তধারার বইয়ের দোকানে লেখক–পাঠকের আড্ডা

আমরা কয়েকবার উবার নিয়েছিলাম। ছয়বারের মধ্যে পাঁচবারই চালক পেলাম বাংলাদেশি। তাঁরা বললেন, ‘ভাই, ট্রিপ ক্যানসেল করেন, পয়সা লাগবে না।’ আমি বলি, ‘আরে ভাই, পয়সা তো নেবেনই, আমি টিপসও দেব। আবার ফাইভ স্টার রিভিউ দেব।’

আমি মেরিনা, পদ্য ও কল্পকে বললাম, চলো, টাইমস স্কয়ারে যাই। ওখানে অলিভ গার্ডেন নামের একটা ইটালিয়ান রেস্টুরেন্ট আছে। খুব ভালো। একেবারে ম্যানহাটনের হৃৎপিণ্ডে ওটার অবস্থান। খাওয়া খুব ভালো, কিন্তু দাম ঢাকার মতো।

নিউইয়র্কে আছে ঢাকার মতো রিকশা। তেমন একটি রিকশার সামনে লেখক
নিউইয়র্কে আছে ঢাকার মতো রিকশা। তেমন একটি রিকশার সামনে লেখক

ফেরার সময় এয়ারপোর্টে চেকইন কাউন্টারে যিনি আছেন, তাঁকে বাংলায় জিজ্ঞাসা করলাম, দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে কী বলব, গুড…তিনি বললেন, ‘গুড আফটারনুন।’ মেরিনা অবাক। আপনি বাংলাদেশি? আমি বলি, এ হলো নিউইয়র্ক। এখানে একটা ইংরেজি না বলেই একটা সফর সেরে ফেলে যায়।

আমাদের এক বড় ভাই—শরিফ ভাই—থাকেন বস্টনে। তাঁরা পাঁচ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে নিউইয়র্কে আসেন নিয়মিত। শরিফ ভাই বলেন, নিউইয়র্ক হলো সেরা শহর। কারণ, এখানে কাচ্চি বিরিয়ানি পাওয়া যায়। শুধু কাচ্চি বিরিয়ানি খেতে আর বাংলাদেশি দোকান থেকে কেনাকাটা করতে তিনি ১০ ঘণ্টা গাড়ি চালাতে একটুও ক্লান্তি বোধ করেন না।

তো এভাবে এভাবে আপনি কোনো ইংরেজি না বলেই এখন নিউইয়র্ক সফর করে ফেলতে পারেন।

একদমই কি ইংরেজি বলতে হবে না?

হ্যাঁ। তিনটা কথা আপনাকে বলতে হতে পারে, ইয়েস, নো, ভেরি গুড।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.