চট্টগ্রামকেন্দ্রিক মোবাইল ব্যাংকিংয়ের একটি ডিস্ট্রিবিউটর হাউস ৪৬ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। আল-কাদের অ্যান্ড কোম্পানি নামে এই প্রতিষ্ঠান হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার করে। দীর্ঘদিন অনুসন্ধান করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) অর্থ পাচারের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে ১৪ ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বুধবার চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানায় মামলা করে সিআইডি।
মামলায় আসামিরা হলেন প্রতিষ্ঠানটির মালিক খোন্দকার আশফাক হোসেন কাদেরী, সুশান্ত নাথ, জালাল হোসেন, মো. আবদুল্লাহ আল নোমান, মো. শিমুল উদ্দিন, আতিকুর রহমান, রাসেদুল হক ওরফে রাসেল, মো. সজীব, শিকদার বনি আমীন, মেরাজুল ইসলাম, আবু খায়ের নয়ন, কামরুল হাসান মজুমদার ও হারুন। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে।
সিআইডির অনুসন্ধানে জানা যায়, আল-কাদের অ্যান্ড কোম্পানির নামে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের সাতটি অ্যাকাউন্টে ১ হাজার ৮৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা জমা এবং সমপরিমাণ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এই অর্থ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লেনদেন করা হয়েছে। এই ডিস্ট্রিবিউশন হাউসের আওতাধীন চট্টগ্রামের চকবাজার ও কোতোয়ালি থানা এলাকা। তবে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক হিসাব নম্বরে পাচারের উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা ৪৬ কোটি ২ লাখ ১৭ হাজার ১২৫ টাকা জমা করেন।
আল-কাদের অ্যান্ড কোম্পানির চট্টগ্রামে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের নিজাম রোডের শাখার হিসাব নম্বরে (০৫৮২১১২০০০০০০৫৭৩) লেনদেন হয়েছে ৪০৯ কোটি টাকা। ঢাকার বিভিন্ন শাখা থেকে ২০২১ সালের আগস্ট থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত এই টাকা লেনদেন হয়েছে। এই টাকার মধ্যে আসামি জালাল হোসেনের কর্মচারী শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরী ৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা, আতিকুর রহমানের কর্মচারী বাবুল আহমেদ ১ কোটি ৯৪ লাখ ৭০ হাজার, আবদুল্লাহ আল নোমানের কর্মচারী ওমর ফারুক ১ কোটি ২৭ লাখ ৩৭ হাজার টাকা এবং কর্মচারী মো. মানিক মিয়া ৬২ লাখ ৫০ হাজার, রাসেদুল হক রাসেলের কর্মচারী ওমর কাইয়ুম ৩৫ লাখ, সজীবের কর্মচারী ওমর কাইয়ুম ৫৮ লাখ, শিমুল উদ্দিন ১ কোটি ৫০ লাখ, শিকদার বনি আমিন ১ কোটি ৬ লাখ ৫০ হাজার, মেরাজুল ইসলাম ১১ কোটি ৬০ লাখ, মোহাম্মদ মাসুদ মীরের কর্মচারী উজ্জ্বল মিয়া ২৬ লাখ, আশরাফুল আলমের কর্মচারী সাজ্জাত হোসেন ৩ কোটি ৪ লাখ, আলাউদ্দিন আবিদ ৫০ লাখ ৫০ হাজার ও রাহাত কবিরের কর্মচারী সুবর্ণ আহমেদ ১৫ লাখ ৯১ হাজার টাকা এই হিসাব নম্বরে জমা করেন।
চট্টগ্রামের ওয়ান ব্যাংকের আন্দরকিল্লা শাখার হিসাব নম্বরে (৬৭১০২০০০৫৪৯৯) এক বছরে ৩৭৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে অভিযুক্ত জালাল হোসেনের কর্মচারী শাহাদাৎ হোসেন ১ কোটি ৯৪ লাখ, কর্মচারী এনামুল হক ৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, কামরুল হাসান মজুমদার ৩ কোটি ৩২ লাখ, সৌদিপ্রবাসী অভিযুক্ত হারুনের হয়ে তাঁর কর্মচারী আবুল এহসান ৪ কোটি ৬১ হাজার টাকা এবং কর্মচারী একরাম উদ্দিন ও করিম ৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা জমা করেন। চট্টগ্রাম সিটি ব্যাংকের চকবাজার শাখার একটি হিসাব নম্বরে এই সময়ে ১৮০ কোটি ৩৩ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে আবু খায়ের নয়নের কর্মচারী লেমন জাকির হোসেন ১ কোটি ১৮ লাখ ও মৃত ইব্রাহিমের হয়ে তাঁর কর্মচারী মাইন উদ্দিন ১ কোটি ১২ লাখ ৯৬ হাজার টাকা জমা করেন। এক বছরে মেসার্স আল-কাদের অ্যান্ড কোম্পানির হিসাব নম্বরে সারাদেশ থেকে ৪৬ কোটি ২ লাখ ১৭ হাজার ১২৫ টাকা জমা হয়। এই টাকা বিভিন্নভাবে সৌদি আরব, চীনসহ কয়েকটি দেশে পাচার হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আসামিদের মধ্যে জালাল হোসেন আল-কাদের অ্যান্ড কোম্পানির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার করেছেন। অভিযুক্ত সৌদিপ্রবাসী হারুন কর্মচারী এহসানের মাধ্যমে হুন্ডিতে মুদ্রা পাচার করেছেন। আবদুল্লাহ আল নোমান বিদেশ থেকে বেশি মূল্যে শিট ক্রয় করে এলসিতে কম মূল্য দেখিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করেন। এ ছাড়া রাজধানীর মোতালিব প্লাজার ব্যবসায়ী আসামি শিমুল উদ্দিন চীন থেকে মেমোরি কার্ড নিয়ে আসতেন। এর মূল্য হুন্ডির মাধ্যমে পরিশোধ করা হতো। একই কাজ করতেন রাজধানীর বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সের মোবাইল ব্যবসায়ী আতিকুর রহমান, বসুন্ধরা সিটির ডিভাইস অ্যান্ড গ্যাজেটস ব্যবসায়ী রাসেদুল হক রাসেল, লাগেজ পার্টি থেকে পণ্য কিনে বিক্রির সঙ্গে জড়িত সজীব, নবাবপুরের হার্ডওয়্যার ও টুলস আমদানিকারক ব্যবসায়ী আবু খায়ের নয়ন, কসমেটিকস ও বোর্ড ব্যবসায়ী ইব্রাহিম। এ ছাড়া চীন থেকে অবৈধভাবে টাইলস, স্টিল ও এসি আমদানি করতেন ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মাসুদ মীর, খেলনা আমদানি করতেন ব্যবসায়ী আশরাফুল আলম সরদার। একই প্রক্রিয়ায় চীনের সোলার প্যানেল, টোনার কার্টিজ, ইউপিএস, ইউপিএস ব্যাটারি, চার্জার ফ্যান আমদানি করতেন রাহাত কবির। এ ছাড়া বেল্ট, বকলেস, মানিব্যাগ আমদানি করতেন আলাউদ্দিন আবিদ। ইলেকট্রনিকস অ্যাকসেসরিজের ব্রোকার একরাম উদ্দিন, করিম ও মাসুম একই পদ্ধতিতে মূল্য পরিশোধ করতেন। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠানের কারও বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির লাইন্সেস না থাকায় তাঁরা আল-কাদের অ্যান্ড কোম্পানির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার করে মূল্য পরিশোধ করেছেন। মোহাম্মদ মাসুদ মীর, আশরাফুল আলম, একরাম উদ্দিন, রাহাত কবির ও আলাউদ্দিন আবিদ মেসার্স আল-কাদের অ্যান্ড কোম্পানির দেওয়া পণ্য ক্রয়ের রসিদের ফটোকপি জমা দিয়েছেন।