সরকারের ঘরে বল ঠেলে নিস্তার চায় ইসি

0
181

নির্বাচন কমিশন (ইসি) কাজের পরিধি ধীরে ধীরে ছোট করে আনছে। একই সঙ্গে সংকুচিত হয়ে আসছে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশও। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত এবং সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞাসহ সব ইস্যুতেই সরকারের পায়ে বল ঠেলে দিয়ে নিস্তার পেতে চাইছে সাংবিধানিক এই সংস্থাটি।

এদিকে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারের তরফ থেকে সহযোগিতার আশ্বাস পেয়েছেন জানিয়ে ইইউর কাছে গতকাল রোববার চিঠি পাঠিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো আরেকটি ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ নির্বাচন আন্তর্জাতিক মহল কিংবা দেশের জনগণ কেউই বর্তমান কমিশনের কাছে প্রত্যাশা করছে না। আবারও ‘অগ্রহণযোগ্য’ নির্বাচনের পথে হাঁটলে দেশের গণতন্ত্র আরও নাজুক হবে; অর্থনীতিতে পড়বে নেতিবাচক প্রভাব।

এদিকে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই ঢাকঢোল পিটিয়ে সংলাপ করলেও এর বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ইসির কোনো অগ্রগতি এখনও দৃশ্যমান নয়। এর মধ্যেই আগামী ৪ অক্টোবর অভিজ্ঞতা বিনিময়ে এবার সাবেক নির্বাচন কমিশনারদের কর্মশালায় ডেকেছে ইসি। কর্মশালার প্রথম ধাপ হয়েছিল গত ১৩ সেপ্টেম্বর। সে সময়ও ইসির এ আয়োজন নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল।

গত বছর সংলাপ শেষে ‘সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে’ কর্মপরিকল্পনায় ১৪টি চ্যালেঞ্জ বা বাধা চিহ্নিত করেছিলেন বিশিষ্টজন। সেসব বাধা উত্তরণে কিছু উপায়ও বাতলে দিয়েছিলেন। এর প্রথমটি ছিল, ‘বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক দলগুলোর
সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সংবিধান ও নির্বাচনী আইন অনুযায়ী যে সুপারিশ অধিকাংশজন করেছেন, তা বাস্তবায়ন।’ কিন্তু বাস্তবে সংলাপে আসা সুপারিশ বাস্তবায়নে তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।

ইসি-সংশ্লিষ্টরা অবশ্য বলছেন, রাজনৈতিক বিরোধ চলমান রেখে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের নজির দেশে নেই। বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার সময় থেকেই রাজনৈতিক বিরোধ চলছিল, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান কমিশনের সদস্যরাও মনে করছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। যে কোনো উপায়ে একটা নির্বাচন তাদের করতেই হচ্ছে। ফলে ইইউসহ অন্য বিদেশি পর্যবেক্ষক আসা-না আসা তাদের কাছে এখন ‘গুরুত্বহীন’। কারণ ইসি ধরেই নিয়েছে, রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়াই জাতীয় নির্বাচন হবে এবং তা কাঙ্ক্ষিত মানেরও হবে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান জানান, আইনকানুনের মধ্য থেকে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। পাশাপাশি বর্জনের ঘোষণা দেওয়া দলগুলোকে নির্বাচনে অংশ নিতে আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছেন। তপশিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত এই চেষ্টা অব্যাহত থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত যারা অংশ নেবে, তাদের নিয়েই নির্বাচন করতে হবে।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে করণীয় পুরোপুরি সরকারের বিষয়। ইসি তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করে যাবে। এ কাজটি ইসি ঠিকভাবে করছে কিনা, সেটাই দেখার বিষয়।

ইইউর চিঠির জবাবে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের চিঠি পাঠানোর তথ্য জানিয়ে এই কমিশনার বলেন, ইসি সরকার ও অন্যদের কাছ থেকে যেভাবে সহায়তা পাচ্ছে, এটি অব্যাহত থাকলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে কমিশন সক্ষম হবে।

ইসি-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে পরিচালিত ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের (এনডিআই) একটি প্রতিনিধি দল আগামী ৭ থেকে ১৩ অক্টোবর বাংলাদেশ সফর করবে। প্রাক-নির্বাচন মূল্যায়ন মিশন (পিইএএম) পরিচালনা করতে তারা আসবে।

এর আগে ইইউর পক্ষ থেকে আসা প্রতিনিধি দল দুই সপ্তাহ বাংলাদেশে অবস্থান করে ফিরে যায়। ওই প্রতিনিধি দলের মূল্যায়নের ভিত্তিতেই গত বৃহস্পতিবার পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানিয়ে ইসির কাছে চিঠি পাঠানো হয়।

একইভাবে গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভিসা নীতি ঘোষণা করে বলা হয়, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টিকারীরা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবেন না। এরই অংশ হিসেবে গত শুক্রবার নিষেধাজ্ঞা আরোপ শুরুর কথা জানায় তারা।

আগামী নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের এমন অবস্থান দেশের জন্য অত্যন্ত হতাশাজনক উল্লেখ করে সুশসানের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির অন্তরায়গুলো নির্বাচন কমিশন খুঁজে পায় না। কিন্তু ইইউ প্রতিনিধি দল দুই সপ্তাহ ঢাকায় অবস্থান করে ঠিকই চিহ্নিত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে নিষেধাজ্ঞা আরোপ শুরু করেছে। সামনে আরও করতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, সরকারের একাধিক ডিসি ও ওসিরা প্রকাশ্যে স্থানীয় মন্ত্রী-এমপি এবং সরকারি দলের পক্ষে ভোট চাওয়া শুরু করেছে। এই প্রশাসন রেখে কীভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের আশা করছে বর্তমান কমিশন।

বদিউল আলম মজুমদার আরও বলেন, ইসি সমস্যাগুলো খুঁজে পায় না, নাকি তাদের আগ্রহ নেই? আবারও একটা একতরফা নির্বাচন পুরো জাতিকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, সরকারের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে তারা যেনতেন নির্বাচন করে পার পেতে চায়। তবে তাদের এই প্রচেষ্টা সংবিধানের লঙ্ঘন। কারণ, সংবিধান তাদের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য পর্যাপ্ত ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু সেই ক্ষমতা প্রয়োগ না করে তারা নিজেদের সরকারের আজ্ঞাবহ হিসেবে নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে।

ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভিসা নিষেধাজ্ঞা শুরুর পরবর্তী পরিস্থিতিতে অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশ সফরে আসা যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী দলের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসছে না বলেই মনে করছেন ইসির কর্তারা। এর আগে ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় মার্কিন পর্যবেক্ষক সংস্থা আইআরআই এবং এনডিআই নির্বাচন পর্যবেক্ষণে এলেও ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আসেনি। একইভাবে ২০০৮ সালের পর ইউই পর্যবেক্ষক পাঠায়নি। ২০১৮ সালের ভোটে ইইউর পক্ষ থেকে দুই সদস্যের একটি নির্বাচন বিশেষজ্ঞ দল এসেছিল। সাধারণত নির্বাচন পর্যবেক্ষণ শেষে প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে তাদের মত তুলে ধরা হয়। কিন্তু গত নির্বাচনে এমন ঘটনা ঘটেনি। তবে গত নির্বাচনে সার্কভুক্ত ইসির সংগঠন ফেমবুসা, মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ওআইসি এবং কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সংগঠনের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক এলেও তাদের বিষয়ে ইসিতে কোনো তথ্য নেই বলে জানা গেছে।

২০০৮ সালের নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্বে থাকা ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে অনেক দেশের সাবেক মন্ত্রী, বিচারপতি, বিভিন্ন দেশের প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনে কাজ করা সাবেক কর্মকর্তারা এসেছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক দলের সদস্য হয়ে।

ইইউকে সিইসির চিঠি

ইসি সচিবালয় সূত্র জানায়, চিঠিতে সিইসি বলেছেন, ‘আমি আপনাদের নিশ্চিত করতে চাই যে, নির্বাচন কমিশন সরকারের কাছ থেকে তাদের চাহিদামতো সহযোগিতা পেয়েছে। অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে কমিশন সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। সরকারও বারবার তাদের প্রতিশ্রুতির বিষয়টি তুলে ধরছে।’

চিঠিতে আরও বলা হয়, নির্বাচনে যত বেশি দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক থাকবে, নির্বাচন তত বেশি স্বচ্ছ হবে এবং সবার ওপর এক ধরনের চাপ থাকবে। দেশে-বিদেশে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাও এতে বাড়বে।

চিঠি দেওয়ার তথ্য জানিয়ে নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন পূর্ণাঙ্গ দল পাঠাবে না বলে জানিয়েছে। তারা কিন্তু ছোট পরিসরে যে পাঠাবে না, তা বলেনি। আমরা আশা করতে পারি, যত বেশি পর্যবেক্ষক ইলেকশন প্রসেসটা মনিটর করবে, সেটা অবজারভার দিয়ে হোক, সাংবাদিক হোক, যত বেশি থাকবে তা স্বচ্ছ হবে। আমাদের আশা সব সময় থাকবে। দেশি-আন্তর্জাতিক যত বেশি অবজারভার থাকবে, আমাদের জন্য ভালো হবে। নির্বাচন যত বেশি মনিটর হবে, আমাদের ওপর তত চাপ পড়বে। আমাদের মধ্যে উপলব্ধি থাকবে– সবাই আমাদের দেখছে। এতে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে।’

সাবেকদের সঙ্গে বসছে ইসি

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যখন নির্বাচনের সহায়ক পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, তখন ভোটকেন্দ্র প্রার্থী ও পোলিং এজেন্টের ভূমিকা স্পষ্ট করতে সাবেক নির্বাচন কমিশনারদের ডেকেছে ইসি। এমন উদ্যোগের সমালোচনা করে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সব দলের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পরিবেশ তৈরি না করে ভোটকেন্দ্রের মধ্যে প্রার্থী ও পোলিং এজেন্টদের ভূমিকা নিয়ে এই আয়োজন নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গেই তামাশা। এর মাধ্যমে পরিষ্কার হচ্ছে, ইসি আবারও একটা একতরফা নির্বাচনের সব আয়োজন সম্পন্ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

আগামী ৪ অক্টোবর বেলা ১১টায় আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে এ কর্মশালায় সাবেক নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে নির্বাচন কর্মকর্তা ও সিনিয়র সাংবাদিকদেরও ডাকা হয়েছে।

এ আয়োজনের বিষয়বস্তু তুলে ধরে গতকাল নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘অবাধ ভোটাধিকার প্রয়োগ জনগণের সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ মৌলিক মানবাধিকার। দীর্ঘ সময় ধরে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় অনিয়ম ও কারচুপির বিভিন্ন মহলের অভিযোগসহ কালো টাকা ও পেশিশক্তির কারণে অবাধ ভোটাধিকার হরণ বা ব্যাহত হয় বলে অধিকাংশের ধারণা। এটা কখনও প্রত্যাশিত হতে পারে না।’

আহসান হাবিব খান বলেন, ‘এ কর্মশালার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আলোচনার মাধ্যমে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতকরণে প্রার্থী ও পোলিং এজেন্টের ভূমিকাকে স্পষ্ট করা এবং সর্বসাধারণ, বিশেষত সম্মানিত ভোটার সাধারণ, রাজনীতিবিদ ও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী-প্রার্থীদের গণমাধ্যমের বদান্যতায় তা অবহিত করা।

মসিউর রহমান খান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.