রাতের ট্রেনের ভোর হলো গুজরাটের গ্রামাঞ্চলে। জানালা দিয়ে তিনি দেখলেন, এক শীর্ণ মূর্তি উঠে আসছে দিগন্তের কাছে। পেছনে সূর্য উঠছে। তার মাথায় গামছার মতো কিছু পেঁচানো, হাতে চিকন লাঠি। তাঁর মন চমকে উঠল, আরে এ তো গান্ধী! মহাত্মা করমচাঁদ গান্ধী। এক লহমায় তিনি গান্ধীর সঙ্গে নিম্নবর্গের কৃষকের যোগাযোগের সুতাটি ধরে ফেললেন। উপন্যাসে যেমনটা ধরেছিলেন সতীনাথ ভাদুড়ী তাঁর ‘ঢোঁড়াই চরিত’ মানসে। যাহা সুতা তাহাই সূত্র অর্থাৎ চিন্তা। এই সুতা ধরেই রচিত হতে থাকল নিম্নবর্গের ইতিহাসনামা। এই লোকটির নাম রণজিৎ গুহ, অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় শতবর্ষী এই মানুষটি প্রয়াত হলেন ২৯ এপ্রিল। ২৩ মে তাঁর শতবর্ষ পূর্ণ হওয়ার কথা ছিল।
রণজিৎ গুহের সেই ইতিহাসের ট্রেনটি সে সময়ের পূর্ব বাংলা দিয়ে যদি যেত, তাহলে তিনি দেখতে পেতেন মওলানা ভাসানীকে। লুঙ্গি পরা লম্বা দাড়ির মানুষটি; যার কাঁধে গামছা, মাথায় তালের টুপি–পুব-বাংলার কৃষকের আসল লেবাস। সেই লেবাসেই সন্তোষের লাল মওলানা হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের মজলুম মানুষের অবিসংবাদী নেতা। মজলুমের বিপরীত হলো জুলুমবাজ আর জুলুমের বিরুদ্ধে মজলুমের বিদ্রোহ তো ন্যায়সঙ্গত। রণজিৎ গুহ যেমন তাঁর ‘এলিমিন্টারি অ্যাসপেক্টস অব পিজ্যান্ট ইনসার্জেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’ নামের চিন্তা-কাঁপানো পুস্তকে লিখেছেন, উপনিবেশবাদের জরুরি বিবাদ (Anti-thesis) হলো বিদ্রোহ এবং কৃষকের নৈতিকতায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ন্যায্য। এই বইটার অন্যতম কীর্তি হলো, কৃষককে তাঁর নিজের ইতিহাসের চালক ও বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। একে বলা হয় ‘প্যারাডাইম শিফট’। রণজিৎ দেখান, জাতীয়তাবাদীরা ছাড়াও কলোনিয়াল-জমিদারি শাসনের অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন কৃষকরা। ইংরেজের প্রথম ১১১ বছরের ১১৮টি কৃষক বিদ্রোহ সেই দিকটাই নির্দেশ করে। জাতীয়তাবাদ ও কৃষক চৈতন্য চুলের বেণীর মতো অনেকদূর পরস্পরকে পেঁচালেও শেষ প্রান্তে কিন্তু আলাদাই থেকে যায়।
গান্ধীর বেশ কৃষকের হলেও বাংলার কেন, কোনো দেশের কৃষকই কোনোকালে অহিংস ছিলেন না। তাঁরা বরং এসএম সুলতানের মহাকাব্যিক চিত্রকলার বেশি কাছাকাছি। তাঁরা নদী সেচে আবাদ করেন, বানের মুখে বাঁধ দেন, বন কেটে বাঘ তাড়িয়ে আবাদ করেন, লাঠি হাতে জমিদারের জুলুম ঠেকান। রণজিৎ গুহের ছাত্র অধ্যাপক আহমেদ কামালের কাছে শোনা, গান্ধীর মতো ভাসানীকে নিয়েও বড় মাপের গবেষণা করার আগ্রহ ছিল রণজিৎ গুহের। যেমন স্বপ্ন ছিল পিতৃভূমি বরিশালের সিদ্ধকাঠিতে ফেরার; মাসের পর মাস বরিশালের নদনদীতে নৌকায় ঘুরবার। যাকে বলে ‘ফর্মেটিভ ইয়ার্স’, সেটা তো শৈশব। শৈশবের কাছে ফেরার কথা ফ্রয়েডীয় চিন্তায় আছে। রণজিৎ গুহের মনেও কি বাসনা ছিল?
সাহিত্য বা ইতিহাসচর্চার সঙ্গে দেশে ফেরার টান থাকতে দেখা যায়। বিশেষ করে পূর্ব বাংলা থেকে দেশান্তরী হওয়া সাহিত্যিক ও ইতিহাসবিদদের মধ্যে এই মায়া যেন এক ধ্রুবপদ। এককালে দেশহারা ইহুদিরা জ্ঞানের রাজ্যে নিজেদের ঠাঁই খুঁজেছিল। পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমে তাড়িত মনীষীরা সাহিত্য ও ভাবের জগতে বিরাট বৃক্ষ। তারপরও জীবনানন্দ দাশ আমৃত্যু কলকাতাবাসী থেকেও পূর্ববাংলার ভাব-প্রকৃতির জলছাপ ছাড়তে পারেননি। নীরদ সি চৌধুরীও বিদেশি হ্রদের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবেন, ‘প্রবাসে জল দেখিলে দেশের কথা মনে পড়ে।’ কিন্তু সেই ‘হারানো দেশ’ কিংবা ‘হতে পারত দেশে’র আদমসুরতটা কী?
দেশে ফেরা মানে শুধু ভূমিতে ফেরা না। আধুনিক ‘দেশ’ ধারণা আর কৃষকের ‘দ্যাশ’ এক না। এই ‘দেশ’ রাষ্ট্রের দরকারি আয়তন মাত্র না। উপনিবেশবাদ ও জাতীয়তাবাদের মতবাদিক ছানি কাটিয়ে দেখা গেলে হয়তো সেই ‘দ্যাশ’ দেখা যেত। রণজিতের ছাত্র আরেক জগৎ মাতানো ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তীর ভাষায় সেটা হলো, ‘হতে পারতো দেশ’। এই স্বদেশ আবিষ্কারের তাড়নায় মার্তিনিকের কবি এমে সেজেয়ার লিখেছিলেন মহাকাব্যিক ‘দেশে ফেরার খাতা’। আর সেই দেশের ইতিহাসের কাছে আরও গভীরভাবে ফেরার জন্যই বোধকরি রণজিতের এত সাধ্য-সাধনা।
সেই কাজে ইতিহাসের চোখ থেকে বাহারি চশমাগুলো তিনি একে একে খুলে নিয়ে খোদ ইতিহাসকেই দাঁড় করালেন আদিকালের চাষার সামনে, যে নাকি ভক্তিতে পতঙ্গের মতো উবু হয়, আবার বিদ্রোহী কোদালে ওলটপালট করে ফেলে ক্ষমতার ভিত। হ্যাঁ, আধিপত্য ও ক্ষমতার দেশজ খাসলত ব্যাখ্যার জরুরত ছিল। রণজিৎ গুহ সেখানে একজন দিশারি।
ইতিহাসের ওপর যার দখল, বর্তমানেও তারই দাপট। দাপটঅলাদের ইতিহাসযানের ইঞ্জিন পেছনে আংটা দিয়ে বেঁধে নিতে চায় শ্রমিক-কৃষক-আদিবাসী-নারী এমনকি প্রকৃতির ইতিহাসকেও। সাঁওতাল বিদ্রোহীরা কি বাবুদের ‘স্বাধীনতা’র জন্য লড়েছিলেন? তেভাগার কৃষকরা কি পাকিস্তান চেয়েছিলেন? আমাদের ষাট দশকের শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনগুলো কি জাতীয়তাবাদের বিজয়ের প্রাগৈতিহাস? ভাষা আন্দোলনে সামিল গ্রামীণ মজুররা কি চেতনার জন্য জান-কোরবান করতে রাজি ছিল? নাকি তার মধ্যে ছিল নিজস্ব ইমান ও নিশান (গৌতম ভদ্র), ছিল জান ও জবান বাঁচানোর জিদ? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কি শুধু মধ্যবিত্তের আকাঙ্ক্ষার দেশ পাওয়ার যুদ্ধ, নাকি ছিল কৃষকের স্বপ্নের ‘মুক্তি’র সংগ্রামও।
রণজিৎ গুহ এসব প্রশ্ন করতে শেখান। আমরা যারা ইতিহাসের ছাত্র নই, তাদের কাছে তিনি ছিলেন দ্রোণাচার্য। দ্রোণাচার্যের কাছে খাতির পেত না নিম্নবর্গের একলব্য। তাই দূর থেকে গুরুর অস্ত্রচালনা দেখে শেখা। আমরাও তাঁর একেকটি বই থেকে শিখেছি যে, ইতিহাসও এক ধরনের কল্পনা বা গল্প: জাতীয়তাবাদী কল্পনা, প্রাচ্যবাদী কল্পনা, উপনিবেশবাদী কল্পনা, ধর্মবাদী কল্পনা, সম্প্রদায়বাদী কল্পনা। সত্যিকারের ইতিহাসবিদের কাজ হলো, মাঠের আগাছা পরিষ্কারের আগে নিজের চোখটা পরিষ্কার করে নেওয়া। নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চা এভাবে অনেক মহান নায়ককে গদিছাড়া করে সেখানে বসায় কৃষক-দলিত-দমিত মানুষের যৌথ সংগ্রামকে। জয় দেখাবার জন্য না, পরাজয়ের ভেতর তার জয় এবং জয়ের ভেতর তার পরাজয়টাকে মনে করিয়ে দেবার জন্যও।
এভাবে কৃষক চৈতন্যের নিরিখ দিয়ে তিনি একে একে পরীক্ষা করেছেন উপনিবেশবাদকে, যারা দাবি করে তারা না এলে এশিয়া-ইউরোপ-আফ্রিকা সভ্য হতো না। তিনি জাতির ত্রাতা সেজে থাকা জাতীয়তাবাদী নেতাদের, জনগণের মুশকিল আসানকারী কমিউনিস্টদের সীমাটাও দেখান। কার্ল মার্কস ফরাসি দেশের কৃষকদের ‘আলুর বস্তার’ সঙ্গে তুলনা করেছিলেন, আবার সেই মার্কসই রুশ কৃষকদের সমবায়ী জোতের মধ্যে সমাজতন্ত্রের বীজ দেখেন। সেই ধারায় মাও সে তুং চীন দেশে কৃষকের বিপ্লবী সম্ভাবনাকে খোঁজেন। বৈপ্লবিক রাজনীতিতে মাও যে কাজ করেছিলেন, ইতিহাসচর্চার এলাকায় রণজিৎ গুহ সেই কাজেরই সাধক ছিলেন।
কিন্তু একটা আক্ষেপও রয়ে যায়। রণজিৎ গুহ প্রথম দফায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বাংলার সম্পত্তি মালিকানার নতুন আদল নিয়ে কাজ করলেন। দ্বিতীয় দফায় করলেন কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে গবেষণা এবং নিম্নবর্গের ইতিহাসমালা সম্পাদনা। তৃতীয় পর্বে তিনি ফিরলেন বাংলা ভাষায়। কিন্তু এই বাংলা বড়ই উচ্চবর্গীয়– সংস্কৃতঘেঁষা। তাঁর বাংলা গদ্য বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখ উচ্চবর্গীয় কবিদের মন বোঝার খতিয়ান। মহর্ষি রামমোহন রায়ের ওপর তাঁর বইয়ের নাম হলো ‘দয়া’। গুজরাট দাঙ্গার পরে তিনি এই বইয়ের মাধ্যমে খুঁজতে চাইলেন ভারতীয় মনের ভেতর মানবিকতার কোনো বিকল্প উৎস রয়ে গেছে কিনা। সেটা তিনি পেলেন দয়া ধর্মের মধ্যে। দয়া তো ক্ষমতাবান করে দুর্বলকে। দয়ার বদলে সুবিচার বা ইনসাফের কোনো উৎস কি এ অঞ্চলে আর ছিল না? জীবনানন্দ দাশ তো আরও আগেই ‘মায়া’র কথা বলে গেছেন। কৃষক জগতের এই ‘মায়া’র টান তো উচ্চ-নীচ মানে না।
এখান থেকেই প্রশ্ন, রণজিৎ গুহের শিষ্য গৌতম ভদ্র যখন ভারতীয় জ্ঞানতত্ত্ব খুঁজছেন, দীপেশ চক্রবর্তী যখন জলবায়ু পরিবর্তনের পটে মানুষকে ইতিহাস থেকে ভূগোলের মাস্তান হিসেবে চিনছেন, পার্থ চট্টোপাধ্যায় যখন বৈশ্বিক সুশাসনের ধারণা নির্মাণ করছেন, তখন কোথায় গেল নিম্নবর্গের সেই আদি প্রতিরোধী চেতনা? নিম্নবর্গের ইতিহাসতত্ত্ব এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকবে তা বলি না। কিন্তু চিন্তার প্রকল্পগুলো যে উচ্চে এবং পশ্চিমে সরে গেল, তার কী হবে? এবং নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চায় মুসলমান প্রশ্ন যে ঠিকঠাকমতো জাগলই না, সেটা কি কেবলই সময়ের অভাব নাকি ‘মায়া’রও অভাব?
দীপেশ চক্রবর্তীর বলা সেই ‘হতে পারতো’ দেশের কল্পনা কি দয়ায় গড়া নাকি মায়ায় ভেজানো?
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক
farukwasif0@gmail.com