এমন একটা বিদায়ী সংবর্ধনার স্বপ্ন কে না দেখে! লা বোমবোনেরা স্টেডিয়াম তখন আলো-আঁধারিতে মিশে আছে। প্রায় ৫৪ হাজার আসনের গ্যালারিতে তিল ঠাঁই নেই। প্রায় সবার গায়েই বোকা জুনিয়র্সের নীল ও সোনালি রংয়ের জার্সি। আর্জেন্টিনার জার্সিও পরে এসেছিলেন কেউ কেউ। আর হুয়ান রোমান রিকেলমে? খেলা ছাড়ার ৯ বছর পর আনুষ্ঠানিকভাবে এমন বিদায়ী সংবর্ধনা পাওয়া কি তাঁকে ছুঁয়ে যায়নি?
মেসি–রিকেলমে জুটি: আর্জেন্টিনার এক আক্ষেপের নাম
এমন কিছু না হওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না। বোকা জুনিয়র্স কিংবদন্তি খেলা ছেড়েছেন ২০১৫ সালে। ৮ বছর পর আয়োজিত তাঁর এই বিদায়ী ম্যাচে কে ছিলেন না! লিওনেল মেসি, লিওনেল স্কালোনি, আনহেল দি মারিয়া তো ছিলেনই, ছিলেন বোকার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দল রিভার প্লেটের কিংবদন্তি হাভিয়ের স্যাভিওলাও। এমন আবেগী ম্যাচে মেসির বদলি হয়ে স্যাভিওলা মাঠে নামার সময় বোকার সমর্থকেরা চুপ করে থাকতে পারেননি। হাজার হোক চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দলের খেলোয়াড় তো! দুয়ো শুনতে হয়েছে স্যাভিওলাকে। মেসিরও একটু মন খারাপ হতে পারে তাতে।
তবে স্টেডিয়ামের স্পিকারে আনহেল দি মারিয়ার নাম ঘোষণা হওয়ার সময় দর্শকেরা যেভাবে চিৎকার করেছেন, মেসির বেলায় ততটা দেখা যায়নি। তাই বলে আর্জেন্টিনাকে ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ জেতানো এই তারকার অমর্যাদাও করেননি বোকার সমর্থকেরা। মেসি মাঠে ঢুকতেই ‘ওলে, ওলে, ওলে, মেসি, মেসি, মেসি’ বলে গান ধরেছিলেন। দুই হাত তুলে দর্শকদের অভিবাদনের জবাব দিয়েছেন মেসি। বেশ ব্যস্ত সময়ই কাটছে তাঁর।
গত শনিবার নেমেছিলেন সাবেক সতীর্থ ম্যাক্সি রদ্রিগেজের বিদায়ী ম্যাচে। কাল বিদায় জানালেন রিকেলমকে। মেসির বিদায়ও কি তাহলে সামনে?
জন্মদিনে মেসির অন্য রকম হ্যাটট্রিক
সে তো বটেই। তবে দ্রুতই যে এমন কোনো কিছু ঘটবে না, তা বোঝা গেল প্রীতি ম্যাচ শেষে। মেসি আপাতত ইন্টার মায়ামি নিয়েই ভাবছেন। পিএসজি ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ সকারের (এমএলএস) দল মায়ামির হয়ে শুরু করবেন নতুন মৌসুম। ম্যাচ শেষে এ নিয়ে ৩৬ বছর বয়সী তারকা বলেছেন, ‘(মায়ামির হয়ে খেলা) এটার জন্য মুখিয়ে আছি। পরিবারের সঙ্গে সময়গুলো এবং ছুটির দিন উপভোগ করতে চাই।’
আর্জেন্টিনার জার্সিতে মেসি যখন ঝলক দেখাতে শুরু করেছেন, রিকেলমে তখন খ্যাতির মধ্যগগণে। ২০০৬ বিশ্বকাপে দুজন আর্জেন্টিনা দলে থাকলেও একসঙ্গে সেভাবে ঝলক দেখাতে পারেননি। আর্জেন্টিনার হয়ে মাত্র ২৭ ম্যাচে জুটি বেঁধে খেলতে পেরেছিলেন দুজন। ম্যারাডোনার ওপর অভিমান করে ২০০৯ সালে আর্জেন্টিনা দল থেকে অবসর ঘোষণার আগে জাতীয় দলের হয়ে ৫১ ম্যাচে ১৭ গোল করেছিলেন রিকেলমে। জাতীয় দলকে তাঁর যে আরও অনেক কিছু্ই দেওয়ার ছিল, সেটা যে কেউ স্বীকার করেন। দুর্ভাগ্যক্রমে তা না হলেও রিকেলমের বিদায়ী ম্যাচকে আর্জেন্টাইন ফুটবলের জন্য বিশেষ একটা উপলক্ষ বলেই মনে করেন মেসি।
ম্যাচ শেষে বলেছেন, ‘তার জন্য এই সংবর্ধনায় থাকতে পেরে খুব ভালো লাগছে। আর্জেন্টাইন ফুটবল এবং বোকার জন্য এটা বিশেষ কিছু। আবারও লা বোমবোনেরা স্টেডিয়ামে ফিরলাম। এটা একটা বিশেষ দিন।’
মেসিকে এমবাপ্পে—শুভ জন্মদিন কিংবদন্তি
ম্যাচটা আসলে ছিল উৎসবের উপলক্ষ। মেসির আর্জেন্টিনা বনাম রিকেলমের বোকা জুনিয়র্স। জাতীয় দলের জার্সি পরে মাঠে নেমেছিল মেসির দল। রিকেলমের গায়ে বোকার সেই সোনালি-নীল জার্সি এবং নম্বরটা ১০-আবারও ৯ বছর পর গায়ে চড়িয়েছিলেন! টসের সময় মেসিকে একবার বুকে টেনে নেন রিকেলমে। খেলা শুরুর আগে মাঠে ঢুকেও আরেকবার বুকে টেনেছেন তাঁকে। বোকার সমর্থকেরাও এক কাঠি সরেস। ফুটবলে মেসির কোনো কিছু জেতার বাকি না থাকলেও বোকার সমর্থকদের কাছে রিকেলমেই বেশি প্রিয়! সেটি ক্লাবের প্রতি সমর্থকদের আনুগত্য ও ভালোবাসার প্রকাশ।
দুই দফায় বোকায় ১৩ বছরের ক্যারিয়ারে ক্লাবের কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন ৪৫ বছর বয়সী রিকেলমে। লিগ জিতেছেন একাধিকবার, তার সঙ্গে জিতেছেন দক্ষিণ আমেরিকার চ্যাম্পিয়নস লিগের সমমর্যাদার টুর্নামেন্ট কোপা লিবার্তোদোরেস। পরে ক্লাবের সহ-সভাপতির দায়িত্ব নিয়েও পেয়েছেন সাফল্য। বোকার সমর্থকেরা তাই গ্যালারিতে সুরে তুলেছিলেন, ‘মেসি, মেসি, মেসি—আমাদের ক্ষমা করে দাও। বোকায় রোমানই সেরা।’
তবে মেসি-স্কালোনিরাও খালি হাতে ফেরেননি বোকার মাঠ থেকে। কাতার বিশ্বকাপ জেতায় বিশেষ স্মারক উপহার পেয়েছেন আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের কোচ স্কালোনি, মেসি ও লিয়ান্দ্রো পারেদেস। রিকেলমের বয়সটা ম্যাচে বোঝা গেলেও ছড়িয়েছেন ‘অলস সৌন্দর্য’, পেয়েছেন গোলের দেখা। গোলের দেখা পেয়েছেন মেসিও। সেটি বিরতির পর আর সেই গোলে উল্লাস করেছেন বোকা জুনিয়র্স সমর্থকেরাও! শেষ পর্যন্ত অবশ্য বোকাই জিতেছে। মেসির আর্জেন্টিনাকে ৫-৩ গোলে হারিয়েছে রিকেলমের বোকা জুনিয়র্স।
মেসির গল্পে ড্রুরিও আছেন
বোকায় বিদায়ী ম্যাচ হবে আর কেউ ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে স্মরণ করবেন না, তা হয় না। প্রয়াত ’৮৬ মহানায়কের প্রতি যত অভিমানই থাকুক, রিকেলমে এদিন ম্যারাডোনার জার্সিও পরেছিলেন।
ম্যাচ শেষে বলেছেন, ‘আমি সর্বকালের সেরার সঙ্গে খেলেছি, তিনি ম্যারাডোনা।’ এরপর মেসিকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তুলনাটা এড়াতে পারলেন না, ‘সময় গড়িয়ে চলার সঙ্গে আমি বুড়ো হয়েছি এবং সে (মেসি) আরও বড় মাপের খেলোয়াড় হয়ে উঠেছে। আমি জানি না সে ম্যারাডোনাকেও ছাড়িয়ে গেছে কি না। তবে তারা দুজনই আমার দেখা সবচেয়ে বড় মাপের খেলোয়াড়। এখানে তাকে পাওয়াটা খুব আনন্দের। আরও কয়েকটা দিন এখানে থাকতে বাধ্য হওয়ায় আমি তার পরিবারের কাছে ক্ষমা চাইছি। সে সব সময়ই আমার ডাকে সাড়া দিয়েছে। এখানে তাকে পেয়ে আমি ভাগ্যবান।’
রিকেলমে শেষ কথাটা বলেছেন বোকার সমর্থকদের প্রতি, ‘আমার বাবা আমাকে তোমাদের মতোই পাগল বানিয়েছে। আমি জানি, তোমাদের মতো এমন পাগলামি নিয়েই মরব। ধন্যবাদ। প্রতিদিন সকালে উঠে প্রার্থনা করি এই সম্পর্কটা (ভক্তদের সঙ্গে) টিকে থাকুক। তোমাদের ছাড়া আমি বাঁচতে পারতাম না। খুব ভালোবাসি।’
গ্যালারিতে তখন কেউ কেউ চোখ মুছলেন।