মা কখনো বাক্‌রুদ্ধ, কখনো সংজ্ঞাহীন

0
135
প্রবাসী দুই ভাইয়ের কফিনের সামনে স্বজনদের আহাজারি

সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে দুই ছেলের কফিন যখন উঠানে নিয়ে আসা হয়, তখন বাড়ির সামনে ভিড় করেছেন কয়েক শ প্রতিবেশী-স্বজন। তাঁদের কান্না-আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে চারপাশ। তবে ছেলেদের কফিন আসার খবর পেয়েও নিজের কক্ষ থেকে বের হননি মা। কখনো তিনি শোকে বাক্‌রুদ্ধ, কখনো আবার সংজ্ঞাহীন হয়ে ছিলেন।

ওমানে সাগরে ডুবে নিহত চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির নাজিরহাট পৌরসভার চরগাঁও পাড়ার প্রবাসী আব্বাস হোসেন (২৫) ও আজাদ হোসেনের (২০) বাড়িতে গিয়ে আজ বৃহস্পতিবার দেখা যায় এই চিত্র। সকাল সাড়ে ১০টায় বাড়িতে নিয়ে আসা হয় দুই ভাইয়ের লাশ। এরপর লাশ দুটি রাখা হয় তাঁদের সদ্য প্রয়াত বাবা আহমদ হোসেনের করা নতুন পাকা বাড়িটির একটি কক্ষে।

বাড়িতে আসা স্বজনেরা কেউ লাশ ঘিরে আহাজারি করছেন, কেউ আবার বাড়ির ভেতরে নিহত দুই তরুণের মা সেলিনা আকতারের কক্ষে ভিড় করেছেন। ভিড় ঠেলে বাড়ির সদস্যদের নিয়ে সেলিনা আকতারের কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে রয়েছেন। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফেরে তাঁর। তিনি প্রলাপ বকতে থাকেন—এত মানুষ কেন বাড়িতে? তাঁরা কি আমার বড় ছেলের বিয়েতে এসেছেন?

এ সময় কক্ষে অবস্থান করা সেলিনা আকতারের বাবা আবু তাহেরের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, স্বামী হারানোর পরপরই ছেলে হারানোর শোক। এতে সকাল থেকেই এলোমেলো কথা বলতে শুরু করেছেন সেলিনা আকতার।

বিকেল চারটার দিকে জানাজা ও দাফনের জন্য দুই ছেলের লাশ যখন ঘর থেকে বের করা হচ্ছিল, তখন শোবার ঘর থেকে ছুটে আসেন সেলিনা আকতার। ছেলেদের কফিন ধরে বুক চাপড়াতে থাকেন কিছুটা সময় ধরে। বলতে থাকেন, ‘তোদের বাবা এত বড় বাড়ি কার জন্য বানাল? নিজের আর তোদের লাশ রাখার জন্য? বলেছিল ছেলেদের জন্য বউ নিয়ে ঘরে উঠবে। নিজেও গেল, দুই ছেলেকেও নিয়ে গেল।’

আসরের নামাজের পর নাজিরহাট বড় মাদ্রাসা মাঠে দুজনের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর দুজনকে শায়িত করা হয় বাবার কবরের পাশে।

দাফন শেষ হওয়ার পরও প্রতিবেশী ও স্বজনদের মুখে মুখে নিহত তরুণদের কথা। স্বজনেরা জানান, তিন দশক ধরে সন্তানদের নিয়ে সেলিনা আকতার ও তাঁর স্বামী আহমদ হোসেন ওমানে বসবাস করে আসছিলেন। তিন মাস আগে নির্মাণাধীন বাড়ির কাজ দেখতে দেশে এসে হৃদ্‌রোগে মারা যান আহমদ হোসেন। তখন আহমদ হোসেনের স্ত্রী এবং ছয় ছেলে ওমানে ছিলেন। পরে স্ত্রী-ছেলেরা দেশে আসেন। দেশ থেকে ফিরে যাওয়ার পর গত রোববার রাতে সাগরে ডুবে মৃত্যু হয় সেলিনা আকতারের দুই ছেলের।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিহত দুই ছেলের বাবা পৈতৃক বাড়ি থেকে ৫০০ মিটার দূরে ৫ হাজার বর্গফুটের নতুন বাড়িটির নির্মাণকাজ শুরু করেন ছেলেদের বিয়ের কথা চিন্তা করে। বাড়িটির নির্মাণকাজ শেষ হলেও এখনো থাকা শুরু করেননি পরিবারের সদস্যরা। তবে আহমদ হোসেন ও তাঁর দুই ছেলের লাশ রাখার জন্য নতুন পাকা ঘরটি ব্যবহার হয়েছে।

নিহত দুই তরুণ ওমানে বাংলাদেশ স্কুল, মাসকট থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর তাঁরা পারিবারিক ব্যবসার দেখাশোনা করতেন। পরিবার সূত্রে জানা গেছে, নিহত আব্বাস ও আজাদ গত রোববার দিবাগত রাত তিনটার দিকে ওমানের হামিরিয়া এলাকায় অবস্থিত তাঁদের বাসা থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের আশ শিফা সৈকতে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে হইহুল্লোড়ের একপর্যায়ে সাগরে গোসল করতে নেমে দুই ভাই পানির স্রোতে তলিয়ে যান। পরে সোমবার ভোরে তাঁদের লাশ পাওয়া যায়।

ছয় ভাইয়ের মধ্যে নিহত আব্বাস দ্বিতীয় এবং আজাদ চতুর্থ ছিলেন। তাঁদের কফিনবাহী ফ্লাইটটি আজ সকাল সাড়ে নয়টায় চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসে। লাশ সঙ্গে করে নিয়ে আসেন ছেলেদের মামা নাসির উদ্দিন ও ভাই আরফাত হোসেন।

লাশের সঙ্গে আসা নিহত ছেলেদের বড় মামা নাসির উদ্দিন বলেন, নিহত ছেলেদের সঙ্গে তাঁদের আরেক ভাই আরাফাতও সেদিন ডুবে গিয়েছিল। পরে ভাগ্যক্রমে সাঁতরে পাড়ে চলে আসে। যে দুজনের মৃত্যু হয়েছে, তাঁরা সাঁতার জানতেন না।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.