বেসরকারি কোম্পানি হাতের মুঠোয় পুরছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি

0
197
সি চিন পিং

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের এক কনকনে শীতের সকালে চীনের মধ্যাঞ্চলের আনহুই প্রদেশের ইংশ্যাং শহরে স্থানীয় বড় ব্যবসায়ীদের জন্য এক অনুষ্ঠান আয়োজন করে দেশটির ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির স্থানীয় শাখা। তিনজন সরকারি কর্মকর্তা ডায়াসে বসে ছিলেন। ব্যবসায়ীদের নতুন কিছু প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবগত করতে সেই অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।
দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেই কর্মকর্তারা ছিলেন ইংশ্যাং বাজার নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের লোক, যে কর্তৃপক্ষের কাজ হচ্ছে কোম্পানির নিবন্ধন দেওয়া। এ ছাড়া বেসরকারি ফার্মের অভ্যন্তরীণ পার্টি কমিটির কাজকর্ম দেখাশোনা করাও এদের কাজ।

দুই দশক ধরে চীন কাজটি করে আসছে। তারা চেষ্টা করছে যত বেশি সম্ভব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে পার্টির পক্ষ থেকে সংগঠন তৈরি করা যায়, তা নিশ্চিত করার। সি চিন পিং ২০১২ সালে ক্ষমতায় আসার পর এই কার্যক্রম আরও গতি পেয়েছে। চাপ প্রয়োগ করে ২০১৫ সালের ভেতরে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সনদে পার্টির কেন্দ্রীয় ভূমিকা নিশ্চিত করা হয়। এরপর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। যেসব কোম্পানিতে বিদেশি বিনিয়োগ আছে, তারাও চাপ অনুভব করছে। মোদ্দা কথা হলো, কোম্পানিগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ও কারখানায় পার্টির ভূমিকা শক্তিশালী হচ্ছে।

তবে এটা নতুন কিছু নয়, আগে থেকেই এই ধারা শক্তিশালী। সবাই জানে, পার্টির পদপদবি সরকারি পদপদবির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় সরকারের মেয়র স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদকের অধীন। কোনো কোনো মন্ত্রী পলিটব্যুরোর স্থায়ী কমিটি বা এমনকি পলিটব্যুরো সদস্যও নন।
পার্টির ভূমিকা কেমন, তার একটা নজির দেখা যাক। গত মাসে বেইজিং–ভিত্তিক এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) যোগাযোগ বিভাগের প্রধান কানাডীয় নাগরিক বব পিকার্ড ব্যাংকে পার্টির আধিপত্যের অভিযোগ তুলে পদত্যাগ করেন (ব্যাংকের সনদে বলা আছে, প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত কোনো সদস্যের রাজনৈতিক চরিত্র দ্বারা নির্ধারিত হবে না)।

পিকার্ড বলেন, পার্টির ভূমিকা প্রমাণ করা কঠিন। অনেক ঘটনা আছে, তবে সেগুলোর মধ্যে যোগসূত্র নিশ্চিত করা কঠিন। এআইআইবির সদস্য কানাডা পিকার্ডের এ অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছে, যদিও বিষয়টি তদন্তাধীন। পিকার্ড মনে করেন, তাঁর সহকর্মীরা পার্টির সদস্য। ব্যাংকের মধ্যে পার্টির গোপন প্রভাব আছে, পার্টির সঙ্গে একধরনের অস্বচ্ছ সম্পর্ক আছে। এটা প্রকাশ্য করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টি চায়, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও সেভাবে পরিচালিত হোক। ‘টু ওয়ে এন্ট্রি অ্যান্ড ক্রস অ্যাপয়েন্টমেন্ট’—এই শব্দবন্ধটি ব্যবহার করে পার্টি। এর অর্থ হলো, কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ও পার্টির শাখা নেতৃত্বকে একীভূত হতে হবে।

পার্টি একসময় পর্দার পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ত, কিন্তু সেই দিন শেষ হয়ে গেছে। এখন পার্টি ও কোম্পানির মধ্যে ভেদ থাকছে না।
কিন্তু সমস্যা হয়েছে বিদেশি বিনিয়োগপুষ্ট যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর। ২০১৭ সালে বেইজিংভিত্তিক ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেম্বার অব কমার্স বিষয়টিকে গুরুতর উদ্বেগের বলে উল্লেখ করে। তারা বলে, কোম্পানিগুলোর স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এটি বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
বিষয়টির সঙ্গে সম্পৃক্ত এক পশ্চিমা আইনজীবীর ভাষ্য, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নানা ধরনের অনুরোধ সব সময়ই আসছে, বিষয়টি নিয়মিত ঘটনা হয়ে গেছে। এসব ক্ষেত্রে না বলারও অবকাশ নেই। এক বিদেশি ব্যবসায়ী দ্য ইকোনমিস্টকে বলেছেন, পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে তাদের অংশীদার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বড় সিদ্ধান্তগুলো পার্টিপ্রধানের সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়ার জন্য বারবার পীড়াপীড়ি করছে।

এতে নানা ধরনের সমস্যাও হচ্ছে, পার্টির অনেক শাখায় গোত্রসংস্কৃতি গড়ে উঠছে। অর্থাৎ কোম্পানির যে সদস্যরা পার্টির সদস্য, তাঁদের আত্মীয়স্বজন পার্টির শাখা কমিটিতে আধিপত্য বিস্তার করছে।
এদিকে বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, বেসরকারি খাতের ওপর এই চীনের কমিউনিস্ট পার্টির এই নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির কারণে দেশটির প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব পড়ছে। অর্থাৎ চীনের পুনরুদ্ধার যে গতি পাচ্ছে না, তার অন্যতম কারণ হিসেবে বেসরকারি খাতে কমিউনিস্ট পার্টির হস্তক্ষেপের দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে।
এ ছাড়া উল্লেখ করা দরকার, সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হলে কী হতে পারে, তার নজির হচ্ছেন জ্যাক মা। তিনি বেশ কিছুদিন নিখোঁজ ছিলেন। বাতিল করা হয়েছিল আলিবাবার আইপিও।

কিন্তু সমালোচনা সত্ত্বেও চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসবে না বলেই মনে করছে দ্য ইকোনমিস্ট। তারা বলছে, তিয়ানজিন অর্থনৈতিক অঞ্চলের যেসব ফার্মে শতাধিক কর্মী আছে, তারা সবাই গত তিন বছরে কোম্পানির সনদে পার্টির সনদ অন্তর্ভুক্ত করেছে, বিদেশি কোম্পানিসহ। এমনকি বিষয়টি উদ্‌যাপনে অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়।
ফলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এই প্রক্রিয়া চলতে থাকবে এবং আনন্দ আয়োজন থেমে থাকবে না।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.