বাংলাদেশের অর্থনীতি মন্দ ঋণ বা খেলাপি ঋণ–ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এর শুরু অনেক বছর আগে, এখন সেটা বাড়তে বাড়তে পাহাড়সম বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতি যত বড় হচ্ছে, মন্দ ঋণের বোঝা ততই বড় হচ্ছে। সামগ্রিক অর্থনীতি, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতের জন্য এখন খেলাপি ঋণ একটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। আমাদের অর্থনীতি অবিচ্ছেদ্যভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত, মন্দ ঋণের কারণে আমাদের ব্যাংকগুলো বিদেশি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ছে। চূড়ান্তভাবে তাতে আমাদের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আমাদের বেশির ভাগ ঋণখেলাপিই প্রথম প্রজন্মের উদ্যোক্তা। দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও ঋণখেলাপি হওয়ার ঘটনা থাকলেও সংখ্যার দিক থেকে তা কম।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, প্রথম প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের একেবারে কিছুই থাকে না, কিন্তু খুব দ্রুত উন্নতি করতে গিয়ে ব্যবসাটাকেই তাঁরা একেবারে লাটে তুলে দেন। কোনো একটা ব্যাংক তাঁদের ঋণ দিয়েছে, দেখাদেখি অন্য ব্যাংকগুলোও তাঁদের ঋণ দিয়েছে। কিন্তু ব্যাংকের ঋণ ব্যবহার করে ব্যবসা বাড়ানোর জন্য অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনার সক্ষমতাসহ আরও অনেক কিছু দরকার হয়। এসব ঘাটতির কারণেই উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠতে না উঠতেই তাঁরা মুখ থুবড়ে পড়েন।
দেশে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি এতটা প্রকট হওয়ার একটা কারণ অবশ্য রাজনৈতিক প্রভাব। সরকারি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চাপে এ ধরনের কিছু ঋণ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সামগ্রিক বিচারে খেলাপি ঋণ বাড়ার বড় কারণ হলো বাংলাদেশে এখন এত বেশি ব্যাংক এবং ব্যাংকগুলোর মধ্যে এত বেশি প্রতিযোগিতা যে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে একটা নেতিবাচক প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। ব্যাংক পরিচালনা বোর্ড ব্যাংকারদের ওপর চাপ দিচ্ছে। ব্যাংকাররা সেই চাপে তড়িঘড়ি করে ঋণ বিতরণ করতে গিয়ে ক্রেডিট অ্যানালিসিসটাও ঠিকমতো করছে না।
সাধারণ মানুষ ব্যাংকে যে আমানত রাখেন, তার একটি অংশ উদ্যোক্তা ব্যবসায় বিনিয়োগের জন্য নেন। যাঁরা প্রকৃত উদ্যোক্তা, যাঁরা প্রকৃত ব্যবসায়ী, দেশে যাঁরা বিনিয়োগ করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে চান, তাঁদের খেলাপি ঋণ পুনর্নবায়ন সুযোগ রাখা প্রয়োজন। কিন্তু নানা প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যাঁরা ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ হচ্ছেন, তাঁদের শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের বড় সমস্যা। এটা এখন মাথাব্যথার অনেক বড় কারণ হয়ে উঠেছে। গণমাধ্যমের খবরে দেখছি, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছেন, অথচ তাঁরা বিদেশে চলে গেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, এ সুযোগ তাঁরা কীভাবে পেলেন?
সম্প্রতি মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের’ নিয়ন্ত্রণে আনতে বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইনে কয়েকটি পরিবর্তন নিয়ে আসার জন্য একটি প্রস্তাবিত খসড়া অনুমোদিত হয়েছে। প্রস্তাবিত খসড়ায় কোনো পরিবার থেকে পরিচালক তিনজনে নামিয়ে আনা; গাড়ি, বাড়ি ও কোম্পানির মালিকানা নেওয়ায় বাধা; ব্যাংকের পরিচালকদের ঋণ গ্রহণের সুযোগ কিছুটা সংকুচিত করা; কিছু রাজনৈতিক বিধিনিষেধ; বিদেশে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা; নতুন ঋণ নেওয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা—এ ধরনের পরিবর্তনগুলোর প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রয়োজনে ফৌজদারি মামলার কথাও বলা হয়েছে। খসড়াটি বিল আকারে সংসদে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (শর্ত) অনুযায়ীই সরকার খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক আইন সংস্কারের পদক্ষেপ নিয়েছে। এ পদক্ষেপকে আমি ইতিবাচকভাবেই দেখতে চাই। করোনা মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মতো বড় দুটি অভিঘাতে আমাদের অর্থনীতিও আক্রান্ত। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে যাওয়ায় আমরা ডলার-সংকটে ভুগছি।
আইএমএফের ঋণের কারণে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকাসহ অন্যান্য উৎস থেকে বিদেশি ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে আইএমএফ যে সংস্কারের শর্ত দিয়েছে, সেগুলোর কথা দীর্ঘদিন ধরেই এ দেশের বিশেষজ্ঞরা বলে আসছিলেন। ব্যাংকিং আইন সংস্কারের মধ্য দিয়ে ঋণখেলাপিদের কিছুটা হলেও যদি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, খেলাপি ঋণ যদি কিছুটা আদায় হয়, তাতে তো ক্ষতি নেই। ফৌজদারি মামলার ভয়ে কেউ যদি টাকা ফেরত দেয়, তাতে সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতই লাভবান হবে।
এখন আমাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার মতো। মোট ঋণের ৯ শতাংশ খেলাপি ঋণ। বাস্তবে খেলাপি ঋণের অঙ্ক আরও অনেক বড়। খসড়ায় ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের’ বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়াসহ যে ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, সেগুলো যাতে বাস্তবায়িত হয়, সেই পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে তাদের পাসপোর্ট স্থগিত করতে হবে।
ফৌজদারি মামলাও হতে পারে তাদের বিরুদ্ধে। যাঁরা ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রয়োজনে ইন্টারপোলের শরণাপন্ন হতে হবে। এ অর্থ তো বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত আমানত, ব্যাংকাররা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সেগুলো সংগ্রহ করেন। সেই টাকা নিয়ে পালিয়ে গিয়ে কেউ যেন পার না পেতে পারে।
খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে উদ্যোগগুলো লোকদেখানো ও প্রতারণাপূর্ণ
খেলাপি ঋণের একটা অংশ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, সেটা বাস্তবতা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপের দেশগুলোতে বৈধ পথে টাকা পাচার করা খুব কঠিন। তাদের ব্যাংকিং আইন খুব কড়া। সেখানে কোনো একটা ব্যাংকে বিদেশি কেউ অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলেও বৈধ আয়ের উৎস প্রমাণ করতে হয়। ফলে দেশ থেকে অর্থ পাচারের বড় উৎস হলো হুন্ডি। হুন্ডির মাধ্যমে কীভাবে টাকা পাচার হয়, সেটা বের করার জন্য গবেষণা হওয়া উচিত। হুন্ডি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন।
খেলাপি ঋণ শেষ পর্যন্ত ব্যাংকের ব্যালান্সশিটের ওপর প্রভাব ফেলে। বিদেশি ব্যাংকের সঙ্গে করেসপনডেন্ট রিলেশনশিপেও প্রভাব তৈরি করে। মন্দ ঋণ বেড়ে গেলে ব্যাংকের করপোরেট গভর্ন্যান্স নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়। বিদেশি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আমাদের ব্যাংকগুলোর নেগোসিয়েশন সক্ষমতা কমে যায়। ফলে আমদানি ঋণপত্র খুলতে সমস্যায় পড়ছে আমাদের ব্যাংকগুলো।
আমাদের ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে হবে, সেগুলোকে খেলাপি ঋণের ব্যাধি থেকে মুক্ত করার বিকল্প নেই। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের কঠোর শাস্তির মধ্যে আনতে হবে। কিন্তু যাঁরা ভালো উদ্যোক্তা কিন্তু কোনো কারণে সমস্যায় পড়েছেন, তাঁরা যেন তাঁদের ব্যবসা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে।
দেশের অর্থনীতির স্বার্থেই সেটা প্রয়োজন। একটি ব্যাংক কিংবা প্রয়োজনে দশটা ব্যাংক একসঙ্গে বসে কোম্পানিগুলোর সম্পদ, জমি, জনবল, যন্ত্রপাতি—সামগ্রিকভাবে সবকিছু মূল্যায়ন করে তাদের ঋণ রিস্ট্রাকচার করা প্রয়োজন।
- আনিস এ খান সাবেক চেয়ারম্যান, অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)