মারামারির ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় হাফিজ আল আসাদ নামের এক যুবককে। ছুরিকাঘাতে এক হাত প্রায় বিচ্ছিন্ন অবস্থায় তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। চিকিৎসকের পরামর্শে তাঁর জরুরি অপারেশনের সিদ্ধান্তে ভর্তি করা হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে। অস্ত্রোপচারের উদ্দেশ্যে কয়েকজন পুলিশ সদস্যের হেফাজতে রেখে তাঁকে ঢোকানো হয় অপারেশন থিয়েটারে। কিন্তু পুলিশ, ডাক্তার-নার্সসহ সবাইকে ফাঁকি দিয়ে অপারেশন থিয়েটার থেকেই হঠাৎ ‘উধাও’ হয়ে যান তিনি! বেশ কয়েক দিন বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করেও তাঁকে আর পাওয়া যায়নি। গত ১৬ অক্টোবরের এই ঘটনা চমেক হাসপাতাল ও পুলিশ প্রশাসনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।
শুধু চিকিৎসাধীন থাকা হাফিজই নন; অপারেশন থিয়েটারের পাশাপাশি চমেক হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকেই প্রতিদিন গড়ে অন্তত ২৫ জন রোগী চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওয়ার্ড থেকে হারিয়ে যায়।চট্টগ্রাম অঞ্চলের বৃহৎ এই সরকারি হাসপাতালের দুই মাসের তথ্য পর্যালোচনা করে প্রতিদিন রোগী উধাও হওয়ার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি রোগী গেছে হাসপাতালের চতুর্থ তলার ২৬ নম্বর অর্থোপেডিক ও ২৮ নম্বর সার্জারি ওয়ার্ড থেকে। এভাবে গত দুই মাসে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় দেড় হাজারের বেশি রোগী হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যায়। মে মাসে পালানো ৭৩৯ জন রোগীর মধ্যে ১৮২ জন অর্থোপেডিক এবং ১১০ জন নিউরো সার্জারি ওয়ার্ড থেকে। এ ছাড়া হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি, মেডিসিন, শিশু, বার্ন, মানসিক, মেডিসিন ওয়ার্ড থেকেও প্রতিদিন রোগী উধাও হওয়ার তথ্য উঠে এসেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওয়ার্ড থেকে রোগী পালানোর নেপথ্যে রয়েছে দালাল চক্র ও বহিরাগত কিছু লোক। তারা রোগী ও তাদের স্বজনদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিসহ নানা লোভ দেখিয়ে ফুসলিয়ে ওয়ার্ড থেকে নিজেদের ল্যাব-ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। আর তাদের কথায় পা দিয়ে অনেকে পড়েন বিপদে। অনেকে কয়েক গুণ বেশি বাড়তি টাকা খরচ করেও পান না সঠিক চিকিৎসা; হয়ে পড়েন নিঃস্ব। বিশেষ করে বিকেল থেকে রাত– এ সময়টিতে ওয়ার্ডে বেশি সক্রিয় থাকে দালাল চক্র। কারণ দুপুরের পর থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা হাসপাতাল ত্যাগ করেন। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগায় দালালরা।
তবে এভাবে বহিরাগতরা রোগীদের ভাগিয়ে নিয়ে গেলেও তা তদারকি করার ক্ষেত্রে নীরব ভূমিকা রয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। ওয়ার্ড থেকে রোগী চলে যাওয়ার অনেক পরে তা জানতে পারেন সংশ্লিষ্টরা। ততক্ষণে দেখা যাচ্ছে রোগী দালালের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হয়ে যান।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় গত ১৩ মে এক দিনেই সর্বোচ্চ ৪৩ জন রোগী ‘পলাতক’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে হাসপাতালের রেকর্ড বইয়ে। ওইদিন গাইনি ওয়ার্ড থেকে সর্বোচ্চ ১৫ ও মেডিসিন ওয়ার্ড থেকে ১০ জন পালিয়ে যায়। এর আগে ৬ মে এক দিনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪১ জন রোগী পালিয়ে গেছে। জুন মাসের প্রথম দিনে উধাও হয় ২৬ জন। এর পরের দিন ২ জুন ১৯ জন, ৪ জুন ২১ জন ও ৫ জুন ২৩ জন রোগী লাপাত্তা হয়ে যায়। চিকিৎসা নিতে এসে রোগীর সন্ধান পেতে অনেককে থানায় করতে হয় সাধারণ ডায়েরি (জিডি)। কেউ কেউ রোগীর খোঁজ পেতে ‘সন্ধান চাই’ এমন লেখা সংবলিত পোস্টারও লাগায় হাসপাতাল এলাকায়।
হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে গত ১৪ মে উধাও হয়ে যাওয়া ২৪ জনের মধ্যে একজন মোহাম্মদ ছালেহ। হাসপাতালের ১৩ নম্বর মেডিসিন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় তিনি কোথায় গেছেন– তা কেউ বলতে পারেননি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাঁর কোনো খোঁজ না পাওয়ায় নগরের পাঁচলাইশ থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করে ভুক্তভোগী পরিবার। নিখোঁজ ব্যক্তির স্ত্রী পারভীন আক্তার বলেন, আমার স্বামী উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছিলেন। হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তির দুই দিনের মাথায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ২টা থেকে ৩টার মধ্যে ওয়ার্ডের ২৩ নম্বর শয্যায় তাঁকে আর খুঁজে পাইনি।
পাঁচলাইশ থানার এসআই জাকির হোসেন বলেন, পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, ওই ব্যক্তি হাঁটাচলার পরিস্থিতিতে ছিলেন না। এর পরও তিনি কীভাবে ওয়ার্ড থেকে অন্যত্র চলে গেছেন, সেটি ভাবিয়ে তুলছে। অপারেশন থিয়েটার থেকে মামলার আসামি পালিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে পতেঙ্গা থানার তৎকালীন ওসি জাহেদ নুর বলেন, অপারেশন থিয়েটারে পুলিশের প্রবেশের অনুমতি নেই। তাই পুলিশ বাইরে ছিল। কিন্তু আসাদ পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায়।
রোগী নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, প্রতিদিন বিভিন্ন ওয়ার্ডে এমন অনেক চিকিৎসাধীন রোগীর হদিস পাওয়া যায় না; যাদের আমরা রেকর্ড বইয়ে পলাতক হিসেবে লিপিবদ্ধ করি। এর নেপথ্যে রয়েছে দালাল চক্র। যাদের বেশ কয়েকজনকে আমরা এরই মধ্যে আটক ও অনেককে জেলজরিমানাও করেছি। কিন্তু এর পরেও তাদের থামানো যাচ্ছে না। এভাবে হুটহাট করে রোগী যাওয়ার ঘটনায় আমরাও বিব্রত।
হাসপাতালে নিরাপত্তার ঘাটতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিরাপত্তা বাড়াতে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর থেকে পর্যাপ্ত আনসার ও নিরাপত্তাকর্মী চেয়ে একাধিকবার চিঠি দিয়েছি। পর্যাপ্ত জনবল ছাড়া বিশাল হাসপাতালের চারপাশ ও প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করা অসম্ভব। হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. রবিউল করিম বলেন, অনেক সময় দেখি ফাইল আছে, রোগী নেই। আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায়ও অনেক রোগীকে খুঁজে পাওয়া যায় না।
চমেক হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ নুরুল আলম আশেক বলেন, হাসপাতালে নিরাপত্তার জন্য মাত্র ছয়জন পুলিশ রয়েছে। ২৪ ঘণ্টা তিন শিফটে পালা করে তারা দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তাদের দিয়ে হাসপাতালে আসা প্রতিদিন কয়েক হাজার রোগী ও স্বজনদের যাবতীয় বিষয় তদারকি ও নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা কঠিন। হাসপাতালের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে নেই সিসিটিভি ক্যামরাও।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, সরকারি হাসপাতাল থেকে কেউ যদি রোগীদের অন্যত্র ভাগিয়ে নিয়ে যায়– সেটি ভয়াবহ ঘটনা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কীভাবে রোগী চলে যায়– বিষয়টি উদ্বেগের। এর সঙ্গে নিশ্চয় হাসপাতালের কেউ না কেউ জড়িত আছে।