নিজের বটতলায় জীবন পার

0
132
নিজের হাতে লাগানো বটগাছের তলায় শামীমের চায়ের দোকান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইবলিশ চত্বরে।

কিছুদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের হবিবুর রহমান হলের টোকাই ছিলেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের কোনায় একটা চায়ের দোকান দিয়ে বসেন। কিছুদিন পর কর্তৃপক্ষ সেখান থেকে তুলে দিল। ছাত্ররা আবার তাঁকে নিয়ে মমতাজ উদ্দিন কলাভবনের সামনের আমতলায় বসালেন। কিছুদিন পর সেখান থেকেও কর্তৃপক্ষ তুলে দিল। ছাত্ররা ধরে নিয়ে ইবলিশ চত্বরে পুকুরপাড়ে বসিয়ে দেন। তখন সেখানে খাঁ খাঁ রোদ। সবাই এসে বলেন, একটু ছায়া হলে ভালো হতো।

শামীম ভাবেন, বট, পাকুড় আর নিমগাছের ছায়া ভালো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিমপাড়ার একটি বাসার ছাদে কয়েকটি বটের চারা পেয়ে যান। দুই পাতার সেই চারা এনে ইবলিশ চত্বরে পুঁতে দেন। শামীমের মনে আছে, তখন এরশাদের আমল। তাঁর লাগানো তিনটি বটগাছ আর তিনটি পাকুড়গাছ বেড়ে উঠেছে। তবে ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইবলিশ চত্বর ঘেষে পুকুরটির চারপাশ দিয়ে তালগাছের চারা লাগিয়ে দেয়। অল্প জায়গায় বট, পাকুড়ের ছয়টি গাছ হওয়ার কারণে মাঠের দিকে একটি গাছ শুধু ডালপালা মেলতে পেরেছে। এখানেই সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত চা বিক্রি করেন শামীম।

গত ১৬ জানুয়ারি দুপুরে ইবলিশ চত্বরে গিয়ে চায়ের দোকানে পাওয়া যায় শামীমকে। দোকানে তাঁর সহায়তা ছিল ছোট ছেলে হাসান। গাছের গল্প তুলতেই শামীম বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ও ছাত্র তাঁর এই গাছের গল্প জানেন। এর মধ্যে মাতিন স্যার (বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সাদেকুল আরেফিন মাতিন) একজন। মুঠোফোনে উপাচার্য সাদেকুল আরেফিন যেন মুখস্থ বলে গেলেন, ‘আমি ১৯৮১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হিসেবে ঢুকেছি। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিই। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে মাত্র দুই বছর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম। তার আগে এই পুরো সময়ই শামীম ভাইকে দেখছি। তাঁর হাতেই ওই বটগাছ হলো।’

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চার শিক্ষার্থী তখন বটতলায় দুটি বেঞ্চে বসে ছিলেন। তাঁরা কেউ জানেন না শামীম আর বটগাছের সম্পর্ক। ইতিহাসটা শুনে তাঁরা একবার বটগাছের দিকে তাকান, আরেকবার শামীমের মুখের দিকে তাকান। তাঁদের মধ্যে সাকিব হাসান বললেন, বটগাছ আর ওনার বয়সটা মিলে যায়।

এরই মধ্যে এলেন দুজন শিক্ষক। একজন সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক মো. এমাজ উদ্দিন। তিনি বললেন, ‘৩৩ বছর ধরে এই ক্যাম্পাসে আছি। শামীম আছেন ৪০ বছর ধরে। তাঁর হাতেই এই বট-পাকুড়ের গাছ মানুষ হলো। এখান থেকে পাস করে যাওয়া শিক্ষার্থীরা সচিব হোন আর যত বড় কর্মকর্তাই হোন, ক্যাম্পাসে এলে আগে শামীম ভাইকে জড়িয়ে ধরবেন।’

শামীম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে মেহেরচণ্ডী এলাকায় স্ত্রীর জমিতে থাকার জায়গা করেছেন। অপর তিন সন্তান এখানে-ওখানে কাজ করে।

শামীম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কিছুর সাক্ষী। এটা সবাই জানেন। পুলিশও তা-ই মনে করে। বিএনপি-জামায়াতের হরতালের সময় পুলিশ এসে তাঁকে ধরে কাজলা ফাঁড়িতে নিয়ে যায়। ‘এত বোমা কারা ফাটায়, তুই জানিস’—এ-ই ছিল পুলিশের কথা। শামীম বলেন, তিনি যতই না বলেন, ততই পুলিশ লাঠি দিয়ে পায়ের তলায় পেটাতে থাকে। পেটাতে পেটাতে দুই পায়ের তলা ফাটিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত কোনো তথ্য না পেয়ে চিকিৎসার খরচ দিয়ে হাসপাতালে পাঠায়। চিকিৎসক দেখে বলেছিলেন, ‘ভারী বয়সে মারটা খেল, শীতের সময় ভুগবে।’ শামীম বলেন, ‘সত্যিই শীতের সময় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। সকালে এসে ছেলেকে চায়ের দোকানটা জ্বালিয়ে দিয়ে চলে যাই।’

শামীম চলে গেলেন। বটতলায় আড্ডা চলতেই থাকে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.