চিকিৎসক ও যন্ত্রপাতিসংকট

0
111

নষ্ট ও মেরামতযোগ্য যন্ত্রপাতির বিষয়ে নিয়মিত চিঠি দেওয়া হয়। তবে সুফল মেলে না। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন দরিদ্র রোগীরা।

খুলনা শহরের কোল ঘেঁষে বয়ে চলা রূপসা নদী পার হয়ে পূর্ব রূপসা বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে রূপসা উপজেলার কাজদিয়া এলাকায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অবস্থান। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ৫০ শয্যার ওই হাসপাতালে প্রতিদিন ৪৫ জনের বেশি রোগী ভর্তি থাকেন। বহির্বিভাগে দিনে চিকিৎসা নেন তিন শতাধিক রোগী।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, এই হাসপাতালের জন্য চক্ষু, ফিজিক্যাল মেডিসিন, শিশু, মেডিসিন, চর্ম ও যৌন, অর্থোপেডিকস, নাক-কান-গলা, সার্জারি, হৃদ্‌রোগ, স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি (গাইনি) এবং অ্যানেস্থেসিওলজির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ রয়েছে। এর মধ্যে শিশু ও মেডিসিনবিশেষজ্ঞ দুজন চিকিৎসা করছেন। সার্জারিবিশেষজ্ঞ মিল্টন মল্লিক, স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ মামনি সুলতানা সপ্তাহে চার দিন এবং অ্যানেস্থেসিওলজির এ এফ এম আশিকুজ্জামান সপ্তাহে পাঁচ দিন ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট খুলনা জেনারেল হাসপাতালে কাজ করেন। ওই তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যোগদানের ১৫ দিন থেকে তিন মাসের মধ্যে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে শহরের হাসপাতালে সংযুক্ত হয়েছেন।

সূত্র আরও জানায়, হাসপাতালের জন্য অনেক আগে একটি এক্স-রে যন্ত্র দেওয়া হয়েছিল। ২০১৭ সালে সেটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর মেরামত করার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে একাধিক চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। একপর্যায়ে ২০১৯ সালে ঢাকা থেকে একটি দল এসে যন্ত্রটি ঘোষণা দিয়ে বন্ধ করে দিয়ে যায়। সেই যন্ত্রটি আজও হাসপাতালের এক্স-রে কক্ষে তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। হাসপাতালের আলট্রাসনোগ্রাম যন্ত্রটি ২০১৪ সালের দিকে আসার পর মাস ছয়েক সেটি চালু ছিল। এরপর রেডিওলজির টেকনোলজিস্ট না থাকায় ব্যবহার না হতে হতে যন্ত্রটি এখন বিকল হয়ে পড়েছে। তিনটি ইসিজি যন্ত্রের দুটিই অকেজো হয়ে রয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স ও এর জন্য একজন চালক আছেন। অ্যাম্বুলেন্সটি ঘন ঘন মেরামত করতে হয়। দন্তরোগীদের জন্য অপরিহার্য ডেন্টাল চেয়ারটি নষ্ট। হাসপাতালের পাঁচটি মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পদের চারটিই শূন্য। শুধু ডেন্টাল টেকনোলজিস্টের পদটি পূরণ আছে। তবে তিনি দীর্ঘদিন প্রেষণে থেকে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট খুলনা জেনারেল হাসপাতালে কাজ করছেন। হাসপাতালের সম্মেলনকক্ষটিও মাত্র ৩০ আসনের হওয়ায় মাসিক বিভিন্ন সভায় সংশ্লিষ্ট সবাই একসঙ্গে বসতে পারেন না। এতে সমন্বয়হীনতা তৈরি হয়।

রূপসা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শেখ সফিকুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট রয়েছে। সুপেয় পানির সমস্যা আছে। সমস্যা থাকলেও এভাবেই চালিয়ে নিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, নষ্ট ও মেরামতযোগ্য যন্ত্রপাতির বিষয়ে নিয়মিত চিঠি দেওয়া হয়। তবে সুফল মেলে না। এসব নানা সংকটের মধ্যেও বিভিন্ন সূচকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মূল্যায়নের ভিত্তিতে গত অক্টোবর থেকে জেলার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে হাসপাতালটি।

সরেজমিনে গত ১ মার্চ ওই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দেখা যায়, ৫০ শয্যার হাসপাতালের দুটি ভবন। ভবনের সামনেই প্রচুর ভ্যান দাঁড়ানো। রোগীরা আসছেন, তবে চিকিৎসকদের কর্মবিরতি থাকায় তাঁদেরকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বারান্দার মেঝেতেও বেশ কিছু রোগী রয়েছেন। হাসপাতালের ভেতরে মোটামুটি পরিষ্কার থাকলেও বাইরে রয়েছে প্রচুর ময়লা–আবর্জনা। অনেক রোগীর স্বজন কমপ্লেক্সের বাইরের এলাকা থেকে বোতলে পানি ভরে আনছেন।

ইলাইপুর গ্রামের সিরাজুল ইসলাম শ্বাসকষ্টসহ বেশ কিছু জটিলতা নিয়ে ৯ দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তিনি বলেন, ‘খাবার সময়মতো পাওয়া যায় না, খাবারের মান ভালো না। সবচেয়ে বড় কথা, হাসপাতালে খাবার পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। পাশের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পানি আনতে হয়। কিন্তু তা–ও সব সময় সম্ভব হয় না। যখন ওই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ থাকে, তখন কিনে খাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।’

তিলক গ্রামের বাসিন্দা লাকি বেগম অ্যাপেন্ডিসাইটিস অস্ত্রোপচারের জন্য তিন দিন ধরে হাসপাতালে আছেন। সপ্তাহের বুধবার ওই অস্ত্রোপচার করা হয় বলে তাঁকে জানানো হয়েছিল। তবে নির্ধারিত দিনে চিকিৎসকদের কর্মবিরতি থাকায় তিনি তা করাতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘তিন দিন ধরে ভর্তি আছি, জানি না অপারেশন কবে করাতে পারব।’

কোমর, পেট ও পায়ে ব্যথা নিয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন সামন্তসেনা গ্রামের বাসিন্দা আবদুর জব্বার। চিকিৎসক তাঁকে এক্স-রে ও আলট্রাসনোগ্রাম করার পরামর্শ দিলে তিনি শহরের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে এসব পরীক্ষা করান। তিনি বলেন, ‘এখানকার চিকিৎসা ভালো। তবে যন্ত্রপাতি নেই। হাসপাতাল থেকে বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষার খরচ কয়েক গুণ বেশি। এতে বয়স্ক ও গরিব রোগীদের সমস্যা হয়।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের চিকিৎসক ও কয়েকজন নার্স বলেন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, টেকনোলজিস্ট ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকায় হাসপাতালের চিকিৎসা থেকে মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন। ২০১৩ সালের পর হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটার (ওটি) দীর্ঘ সময় তালাবদ্ধ ছিল। ২০২১ সালে ওটি চালু করা হয়। শল্যচিকিৎসক ও অবেদনবিদ সপ্তাহে মাত্র এক-দুদিন আসায় বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রোপচার বন্ধ রাখতে হয়। এ ছাড়া গাইনি চিকিৎসক প্রতিদিন না বসায় জরুরি প্রসূতি সেবার বিঘ্ন ঘটে। জরুরি মুহূর্তে সি-সেকশনের প্রয়োজন পড়লে শহরের হাসপাতালে পাঠাতে হয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.