জ্বালানি ও ডলার সংকট নিয়ে উদ্বেগ কাটেনি ব্যবসায়ীদের। শিল্পে চাহিদা অনুসারে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি বছরের পর বছর ধরে ঝুলে রয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠানের গ্যাস সংযোগের আবেদন। অন্যদিকে, ডলার সংকটে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে এখনও সমস্যায় পড়ছেন উদ্যোক্তারা। এর ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠানে।
গতকাল শনিবার ঢাকায় চীনের দূতাবাস এবং বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিসিসিসিআই) আয়োজিত সেমিনারে এমন উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন ব্যবসায়ীরা। ‘স্টেকহোল্ডার কনসালটেশন উইথ চায়নিজ ইনভেস্টরস: চ্যালেঞ্জেস, এক্সপেক্টেশনস অ্যান্ড প্রসপেক্টস’ শীর্ষক ওই সেমিনারে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), তিতাসসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কমর্কতারা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে আকিজ গ্রুপের পরিচালক শেখ আমিন উদ্দিন মিলন বলেন, ১৩ বছর আগে সিএনজি প্লান্ট স্থাপন করে গ্যাস সংযোগের জন্য তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিসন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে আবেদন করে আকিজ গ্রুপ। তিতাসের কর্মকর্তাদের কথা অনুযায়ী কয়েক দফা প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ চারবার সিকিউরিটির মানি রিভাইজড করেও গ্যাস সংযোগ পায়নি দেশের অন্যতম বৃহৎ এ গ্রুপটি। অথচ টাঙ্গাইলের সিএনজি প্লান্টটিতে এক মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছেন তারা। কিন্তু গ্যাস সংযোগ না পাওয়ায় তা চালু করতে পারছেন না।
এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অনুষ্ঠানে তিতাসের ডিজিএম স্বাগতম কুমার সাহা বলেন, বিনিয়োগের জন্য শিল্পে গ্যাস সংযোগ পাওয়া খুবই জরুরি। কিন্তু গ্যাসের চাহিদা অনুযায়ী বর্তমানে সরবরাহ করা যাচ্ছে না। পেট্রোবাংলা এ সংকট দূর করতে এলএনজি আমদানি ও এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের চেষ্টা করছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই গ্যাস সংযোগ দেওয়া শুরু করা যাবে।
এ সময় বিডার মহাপরিচালক শাহ মোহাম্মদ মাহবুব আকিজ গ্রুপের পরিচালককে রোববার বিডা অফিসে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘বিডাতে আসেন, আপনার বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করব।’
অন্য একজন উদ্যোক্তা বলেন, ‘বিভিন্ন দেশের ব্যাংক এলসি খুলছে না। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে?’ জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ ইনভেস্টমেন্ট ডিপার্টমেন্টের যুগ্ম পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে এলসি খোলার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে। তবে বিষয়টি নিয়ে আমরা ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছি। আশা করছি, এ সমস্যার দ্রুত সমাধান হবে।’
চীনের একজন উদ্যোক্তা ভিসা পাওয়া ও নবায়নসংক্রান্ত জটিলতা এবং ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে সমস্যার কথা জানান। এ বিষয়ে বিসিসিসিআই সভাপতি গাজী গোলাম মুর্তজা বলেন, ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ বাড়ানোর প্রক্রিয়া জটিল হওয়ায় দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের। এ নিয়ে তাদের মধ্যে অনেক হতাশা আছে। সমস্যাগুলোর সমাধান হলে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ বাড়বে।
ওয়ার্ক পারমিটের জন্য বিডার গাইডলাইন পড়ার পরামর্শ দিয়ে বিডার মহাপরিচালক শাহ মোহাম্মদ মাহবুব বলেন, বর্তমানে সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্সের কাজটি ম্যানুয়ালি করা হয়। এজন্য সময় বেশি লাগে। তবে এ কাজটি ডিজিটালি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে সময় কম লাগবে।
বিদেশি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে জমি কিনতে বা লিজ নিতে সমস্যার কথা তুলে ধরেন একজন উদ্যোক্তা। জবাবে শাহ মোহাম্মদ মাহবুব বলেন, এই বিষয়ে কোনো সমাধান তাঁর কাছে নেই। তবে উদ্যোক্তাদের বেজার অর্থনৈতিক অঞ্চল ও বেপজার এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন, বিসিকের শিল্পনগরী কিংবা হাই-টেক পার্কে জমি নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
কাস্টমসে এলইডি টিভির এইচএস কোড নিয়ে জটিলতার প্রসঙ্গ তুলে ধরে তা সমাধানের বিষয়ে জানতে চান একজন উদ্যোক্তা। এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয় জানা থাকলে এনবিআরে যাওয়ার আহ্বান জানান সংস্থাটির প্রথম সচিব (শুল্ক, মূল্যায়ন ও পুরস্কার) খন্দকার নাজমুল হক। তিনি জানান, বর্তমানে প্রায় ৯০ শতাংশ পণ্য কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স পাচ্ছে এক দিনের মধ্যে। বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নের জন্য পোস্ট ক্লিয়ারেন্স অডিটের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিডার নির্বাহী সদস্য অভিজিত চৌধুরী বলেন, ‘আমরা জানি, বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধন করার পর জমি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়াসহ ট্যাক্স-কাস্টমসে উদ্যোক্তাদের অনেক সমস্যা হতে পারে। সেসব সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা আফটার কেয়ার সার্ভিস চালু করেছি।’
বিসিসিসিআইর সেক্রেটারি জেনারেল আল মামুন মৃধা বলেন, ২০১৯ সাল পর্যন্ত চীন বাংলাদেশে একক সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী ছিল। কভিড ও চীনের জিরো কভিড নীতির কারণে কয়েক বছর চীনের বিনিয়োগ কম এসেছে। তবে এখন অনেক বিনিয়োগ আসছে। চীনের বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে বিদ্যমান রিজার্ভ সংকট মোকাবিলা করা সহজ হবে।
সেমিনারে বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে প্রবন্ধে শাহ মোহাম্মদ মাহবুব বলেন, বিনিয়োগের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, কর সুবিধাসহ যেসব বিষয় বেশি দরকার, তার সবকিছু বাংলাদেশে রয়েছে। দেশে মোট বিদেশি বিনিয়োগের ৭০ শতাংশই পুনর্বিনিয়োগ হয়ে থাকে। অর্থাৎ এখানে যেসব বিদেশি উদ্যোক্তা ব্যবসা করছেন, তারা মুনাফা করায় আবার বিনিয়োগ করছেন।